ভোক্তাকন্ঠ ডেস্ক: মহামারিতে নতুন এক আতঙ্ক তৈরি করেছে গত নভেম্বরের শেষের দিকে দক্ষিণ আফ্রিকায় প্রথম শনাক্ত হওয়া করোনাভাইরাসের অতি-সংক্রামক ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্ট। বিশ্বজুড়ে এই ভ্যারিয়েন্টের সংক্রমণ লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে; বিশেষ করে ইউরোপের দেশগুলোতে ওমিক্রনের ব্যাপক আধিপত্য চলছে। প্রতিবেশী ভারতেও এই ভ্যারিয়েন্টের সংক্রমণ ব্যাপক বিপজ্জনক পরিণতি ডেকে আনতে পারে বলে দেশটির সংবাদমাধ্যম এনডিটিভির এক বিশ্লেষণে উঠে এসেছে।
এনডিটিভির মেহের পান্ডে এবং সৌরভ গুপ্ত দেশটিতে বর্তমান সংক্রমণের বিশেষ তথ্য বিশ্লেষণের পর বলেছেন, ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্টের দাপটে ভারতে প্রত্যেক দিন গড়ে ৬০ হাজারের মতো মানুষকে হাসপাতালে ভর্তি করার মতো পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে।
দেশটির সরকারি তথ্য অনুযায়ী, ভারতে মোট করোনা রোগীর মধ্যে ২ শতাংশেরও কম বর্তমানে ওমিক্রনে আক্রান্ত। কিন্তু এনডিটিভির গবেষণা বলছে, প্রকৃত চিত্র আসলে এরচেয়ে ভয়াবহ। ভারতে ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্ট আধিপত্যশীল হয়ে ওঠায় শিগগিরই দেশটির স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় সংকট তৈরি হতে পারে বলে সতর্ক করে দিয়েছেন মেহের পান্ডে এবং সৌরভ গুপ্ত।
ভারতের স্বাস্থ্য বিভাগের তথ্যে দেশটিতে বর্তমানে ওমিক্রন আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা প্রায় দেড় হাজার বলে ধারণা করা হলেও প্রকৃত সংখ্যা তার চেয়ে ১০ গুণেরও বেশি। অর্থাৎ এই মুহূর্তে ভারতে ১৮ হাজার মানুষ ওমিক্রনে আক্রান্ত হয়েছেন এবং প্রত্যেক দিন সেই সংখ্যা ক্রমান্বয়ে বাড়ছে।
বিশ্বের অন্যান্য দেশের পথে হাঁটছে ভারতও; অনেক দেশে বর্তমানে যারা নতুন করে করোনায় আক্রান্ত হচ্ছেন তাদের প্রায় ৯০ শতাংশই ওমিক্রনে সংক্রমিত। ওমিক্রন শনাক্তের জন্য অপরিহার্য জিনোম সিকোয়েন্সিং ব্যবস্থা, পরীক্ষাগার ও ল্যাবরেটরির সংখ্যা কম হওয়ায় ভারতে ওমিক্রন রোগীর সরকারি চিত্র এখনও অনেক কম।
তবে ওমিক্রন শনাক্ত করতে সক্ষম এমন দুটি ল্যাবের তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করেছে এনডিটিভি। সেই তথ্য বিশ্লেষণে পাওয়া ওমিক্রন রোগীর সংখ্যা সরকারিভাবে ঘোষিত সংখ্যার ভিন্ন গল্প বলছে।
প্রধান দুটি ল্যাব—যার একটি দিল্লি এবং অপরটি মুম্বাইয়ে ওমিক্রন পরীক্ষা করে। তাদের পরীক্ষার তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, করোনা আক্রান্ত সব রোগীর মধ্যে প্রায় ৬০ শতাংশের নমুনায় ওমিক্রন পাওয়া গেছে। মুম্বাইয়ের অপর একটি ল্যাবের তথ্যও একই ধরনের কথা বলছে। সেই ল্যাবে করোনা পজিটিভ রোগীদের মধ্যে প্রায় ৬০ শতাংশের নমুনায় ওমিক্রন পাওয়া গেছে। এক সপ্তাহ আগেও সেখানে এই হার ছিল সর্বোচ্চ ৩৭ শতাংশ।
এনডিটিভি বলছে, বিশেষ উদ্বেগজনক সত্য হলো ওমিক্রন সংক্রমণ ডেল্টার তুলনায় অনেক দ্রুত বাড়ছে। দুই থেকে তিন সপ্তাহ আগে মোট কোভিড রোগীর প্রায় ২ শতাংশের ওমিক্রন ছিল; তারপর কয়েক দিন আগে সেটি ৩০ শতাংশ হলেও এখন তা ৬০ শতাংশের কাছাকাছি। এই সময়ের মধ্যে ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টে আক্রান্তের সংখ্যা ক্রমাগত কমেছে এবং ওমিক্রন ভারতে আধিপত্য বিস্তারকারী ভ্যারিয়েন্টে পরিণত হয়েছে।
তবে এই সংবাদ ভারতের জন্য একদিক থেকে ভালো মনে হলেও অন্যদিক থেকে খারাপ। সুসংবাদ হলো ডেল্টার তুলনায় ওমিক্রন কম গুরুতর অসুস্থতা তৈরি করে। কারণ ডেল্টায় আক্রান্ত উচ্চসংখ্যক রোগীকে হাসপাতালে ভর্তি করাতে হয় এবং ওমিক্রনের তুলনায় ডেল্টায় মৃত্যুর হারও বেশি।
কিন্তু ভারতের জন্য উদ্বেগজনক খবর হলো, ওমিক্রন ডেল্টার চেয়ে দ্রুতগতিতে ছড়িয়ে পড়ে। নতুন এই ধরন ডেল্টার চেয়ে ৪ থেকে ৫ গুণ বেশি সংক্রামক বলে ধারণা করা হচ্ছে। সুতরাং এটি এমন এক ইঙ্গিত দিচ্ছে যে, সারা বিশ্বের মতো ভারতেও যদি করোনার তৃতীয় ঢেউ আছড়ে পড়ে, তাহলে দেশটি সংক্রমণের চূড়ায় পৌঁছালে প্রত্যেক দিন ১৬ থেকে ২০ লাখ পর্যন্ত মানুষ এই ভাইরাসে আক্রান্ত হতে পারেন। দেশটিতে দ্বিতীয় ঢেউয়ের সময় ডেল্টা সংক্রমণের সর্বোচ্চ চূড়ায় যে সংখ্যা ছিল ৪ লাখ।
এনডিটিভি বলছে, এমন পরিস্থিতি ভারতের চিকিৎসা ব্যবস্থার ওপর নিয়ন্ত্রণহীন চাপ তৈরি করবে। হাসপাতালের শয্যা, অক্সিজেন সিলিন্ডার, চিকিৎসক এবং ওষুধপ্রাপ্তির মতো সংকট দেখা দেবে। ওমিক্রনে আক্রান্তদের মধ্যে কয়েক শতাংশকে হাসপাতালে ভর্তির প্রয়োজন হলেও মোট রোগী এবং সংক্রমণের সংখ্যা অনেক বেশি হবে।
ভারতীয় এই সংবাদমাধ্যমের গবেষণা বলছে, ডেল্টায় আক্রান্ত ১০০ জনের মধ্যে অন্তত ৬ জনকে হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়। কিন্তু ওমিক্রনের ক্ষেত্রে সেই সংখ্যা ডেল্টার তুলনায় অর্ধেক। অর্থাৎ ওমিক্রনে আক্রান্ত ১০০ জনের মধ্যে তিনজনকে হাসপাতালে ভর্তির প্রয়োজন হয়।
ওমিক্রন এবং ডেল্টায় হাসপাতালে ভর্তির এই তথ্য অনুযায়ী, ভারতে সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউ চূড়ায় পৌঁছানোর সময় দৈনিক সর্বোচ্চ ৪ লাখ মানুষ ডেল্টায় আক্রান্ত হয়েছিলেন। এর মধ্যে শতকরা হিসেবে দৈনিক প্রায় ২৪ হাজার মানুষকে হাসপাতালে ভর্তি করাতে হয়। কিন্তু সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতিতে তৃতীয় ঢেউ চূড়ায় পৌঁছালে দেশটিতে দৈনিক ওমিক্রন রোগী পাওয়া যাবে ২০ লাখ। শতকরা হিসেবে ওমিক্রন আক্রান্ত এই রোগীদের মধ্যে দৈনিক প্রায় ৬০ হাজার মানুষকে হাসপাতালে ভর্তি হতে হবে।
ডেল্টা-চালিত দ্বিতীয় ঢেউয়ের সময় ভারতের চিকিৎসা ব্যবস্থা প্রায় ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়েছিল। ওমিক্রনে আক্রান্ত ৩ শতাংশ মানুষকে হাসপাতালে ভর্তির প্রয়োজন হলেও ভারত বড় ধরনের স্বাস্থ্য সংকটের মুখে পড়তে পারে। তবে ভারত একটি ইতিবাচক আশা করতে পারে যে, ওমিক্রনের প্রাদুর্ভাব ডেল্টার চেয়ে অনেক বেশি খারাপ হলেও বেশিদিন স্থায়ী নাও হতে পারে।
কারণ দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে পাওয়া তথ্য-উপাত্তে দেখা গেছে, ওমিক্রন সংক্রমণের ঢেউ ডেল্টার চেয়ে দ্রুত বৃদ্ধি পায় এবং দ্রুতই শেষ হয়ে যায়।