এখন ফসলের মাঠগুলোতে ঢেউ খেলছে আমন ধান। যেগুলোর কোথাও ফুল ফুটে (ফ্লাওয়ারিং স্টেজ) রয়েছে, আবার কোথাও শুরু করেছে ধানে চালও হতে (মিল্কিং স্টেজ)। কিন্তু বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিনা) উদ্ভাবিত আমন মৌসুমের আগাম জাতের ধান এরই মধ্যে কাটা হয়ে গেছে। অর্থাৎ, প্রায় একমাস আগেই এসব ধান উঠছে কৃষকের ঘরে।
তাই এসব আগাম জাতের ধান নিয়ে রীতিমতো উৎসব চলছে বিভিন্ন এলাকায়। কারণ উচ্চফলনশীল হওয়ায় এবছর জাতগুলোর ফলনও হয়েছে বেশ ভালো। কম সময়ে চাষ করা গেছে বলে খরচও হয়েছে কম। তাই বিনা উদ্ভাবিত স্বল্প সময়ের জাত বিনা ধান-৭, বিনা ধান-১১, বিনা ধান-১৬, বিনা ধান-১৭, বিনা ধান-২০ এবং বিনা ধান-২২ এরই মধ্যে জনপ্রিয়তা পেতে শুরু করেছে সারাদেশে।
দেখা যায়, এসব জাতের বিঘাপ্রতি ফলন প্রায় ছয় টন। যা আমনে চাষ হওয়া অন্য গতানুগতিক জাতের চেয়ে এক থেকে দেড় টন বেশি। পাশাপাশি স্বল্প সময়ের কারণে দ্রুত ধান কেটে রবিশস্যের চাষ করা যাচ্ছে একই জমিতে, যে জমি আগে ইরি-বোরো পর্যন্ত অনাবাদি থাকতো। এ কারণে বেশি লাভবান হচ্ছেন কৃষক।
নওগাঁর নিয়ামতপুর উপজেলার শালাবাড়ি গ্রামের কৃষক ইব্রাহিম খলিল তার চার বিঘা জমিতে বিনা-১৭ জাতের ধান চাষ করেছিলেন এবছর। গত ১২ অক্টোবর তার ধান কাটা হয়েছে। এখন তিনি ওই জমিতে রবিশস্য চাষ করছেন। ধান কাটার দিন ইব্রাহিম বলেন, শালবাড়ির এ মাঠে এখনো কোনো ধান পাকেনি। আমি কেটে ফেলেছি। সবাই আশ্চর্য।
প্রথম চাষের অভিজ্ঞতা নিয়ে তিনি বলেন, এ জাতের ধান চাষে সেচ, সার, কীটনাশক খরচ অনেকটাই কম। একসঙ্গে রোপণ করার পর আমার জমির ধান কাটা হচ্ছে একমাস আগে। অন্যদের আরও ৩-৪টি সেচ দিতে হবে। একমাস পরিশ্রম বেশি করতে হবে। আর আমি সে সময়ে শস্য চাষ করবো।
জানতে চাইলে ইব্রাহিম বলেন, আগে এ জমিতে স্বর্ণা-৫ জাতের ধান আবাদ করতাম। সে তুলনায় বিঘাপ্রতি আমার ২-৩ হাজার টাকা খরচ কম পড়েছে। ফলনও হয়েছে বিঘায় ৪-৫ মণ বেশি। এখন আমার দেখাদেখি অনেকে এ জাত চাষ করতে চাচ্ছে। বীজ নিতে চাচ্ছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, দেশের শস্যভাণ্ডারখ্যাত নওগাঁ জেলায় এবছর ১ লাখ ৯৭ হাজার ১১০ হেক্টর জমিতে আমনের আবাদ হয়েছে। এর মধ্যে প্রথমিকভাবে বিনা-১৭ জাতের ধান চাষ হয়েছে ১ হাজার ৩০ হেক্টর জমিতে। তার মধ্যে রানীনগরে ৫২০ হেক্টর, ধামইরহাটে ১২৫ হেক্টর, নিয়ামতপুরে ৫ হেক্টর ও মান্দায় ২০ হেক্টরসহ অন্য উপজেলায় কমবেশি এ জাতটির চাষ হয়েছে। অক্টোবরের ২০ তারিখের মধ্যে প্রায় সবগুলো এলাকায় শেষ হয়েছে এ ধান কাটা।
এ প্রসঙ্গে বিনা উপকেন্দ্র চাঁপাইনবাবগঞ্জের ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মো. হাসানুজ্জামান বলেন, নতুন জাত চাষ করায় এ এলাকায় এখন বোরো লাগানোর আগে প্রায় দুই মাস সময় পাবে কৃষক। আগে আমন কাটার পরে বোরো লাগানোর মাঝের সময় এলাকার সব জমি অনাবাদি থাকতো। এখন রবিশস্য হিসেবে সরিষা, মসুর ডাল, আলু বা তিল চাষ করা যাবে। রবিশস্য উঠিয়ে আবার বোরো ধান লাগানো যাবে। অর্থাৎ এসব দুই ফসলি জমি এখন তিন ফসল হবে। পাশাপাশি মাটির উর্বরতাও বাড়াবে।
তিনি জানান, বিনাধান-১৭ বা ১৬ তে পানি কম লাগার কারণে একে গ্রিন সুপার রাইস নামেও অভিহিত করেছেন অনেকে। আর খরা এলাকায় এ জাতটি আশীর্বাদ হতে পারে। এ দুটি জাতের ধান চাষে ইউরিয়া সার এক-তৃতীয়াংশ ও সেচ ৫০ শতাংশ কম লাগে। এ ধানের জীবনকাল ১১০-১১৫ দিন। এর প্রতি শীষে ২০০-২৫০টি দানা থাকে এবং ফলনও আশাব্যঞ্জক হওয়ায় কৃষকের জন্য এ জাতের ধান চাষ খুবই লাভজনক। প্রতি বিঘায় প্রায় ২২ থেকে ২৫ মণ ফলন হয়েছে এ ধানের।
এদিকে, ময়মনসিংহে এবছর বেশি চাষ হয়েছে বিনা-১১। স্বল্প সময়ের পাশাপাশি এ জাতটি বন্যাসহিষ্ণু। সদরের ব্রহ্মপুত্রের চরে ছাতিয়ানতলা গ্রামের বেশকিছু জমিতে এখন দুলছে পাকা ধান। এর মধ্যে ১৬ অক্টোবর কৃষক আবু সায়ীদের ৩৩ শতাংশের ধান কাটা হয়েছে। যা অন্য আমনের জাতের সঙ্গে গত জুলায়ের মাঝামাঝি রোপণ করা হয়েছিল।
আবু সায়ীদ বলেন, বিনা কর্মকর্তাদের পরামর্শে পরীক্ষামূলকভাবে চাষ করেছিলাম এ জাত। এবছর দুই বিঘায় আবাদ করেছি। প্রথমে ছোট ক্ষেতের ধান পেকেছে। অন্যরাও আমার দেখাদেখি উৎসাহিত হয়ে এই ধান চাষ করেছে। এখন অন্য ধানের চেয়ে বিনা-১১ এর ফলন ভালো পাচ্ছি। অল্প দিনেই ঘরে তোলা যায়, এজন্য পরিশ্রমও কম।
এ ধান উদ্ভাবন করেছেন বিনার মহাপরিচালক ড. মির্জা মোফাজ্জল ইসলাম নিজেই। তিনি বলেন, এ ধানটির সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট এটি বন্যা ও জলমগ্নতা সহিষ্ণু। এজন্য চর এলাকায় এ ধান চাষ করা হচ্ছে। এ ধান ২০ থেকে ২৫ দিন বন্যার পানিতে ডুবে থাকতে পারে। চারা পচে গেলেও আবার শিকড় থেকে চারা গজাবে। সেই প্রযুক্তি দিয়ে উদ্ভবন করা হয়েছে।
বিনার এসব নতুন জাত দিয়ে দেশে মঙ্গা ও দুর্ভিক্ষ চিরতরে বিদায় করা সম্ভব হবে বলে মন্তব্য করে মহাপরিচালক বলেন, টেকসই কৃষি উন্নয়নের জন্য কৃষি গবেষণার কোনো বিকল্প নেই। এরই ধারাবাহিকতায় গবেষণার মাধ্যমে উদ্ভাবন করা হচ্ছে বিভিন্ন ফসলের টেকসই ও উন্নত জাত। উত্তরবঙ্গের মঙ্গা দূরীকরণসহ সমগ্র দেশের ফসলের নিবিড়তা বাড়াতে উচ্চফলনশীল বিনা ধান-১৬ এবং বিনা ধান-১৭ সেরা। ফলনে সবচেয়ে সুপার ভ্যারাইটি এ দুই জাত। আবার বন্যা ও জলমগ্নতার জন্য বিনা ধান-১১।
বিনা বলছে, বিনা ধান-১৬ এর জীবনকাল মাত্র ৯৫-১০০ দিন এবং গড় ফলন হেক্টরপ্রতি ৬ টন (বিঘাপ্রতি ২৪ মণ)। বিনা ধান-১৭ এর জীবনকাল ১১০-১১৫ দিন এবং গড় ফলন হেক্টরপ্রতি ৬ দশমিক ৫ টন (বিঘাপ্রতি ২৭ মণ)। অতীতে আমন ধানের অন্য জাতের জীবনকাল ছিল ১৬০-১৭০ দিন এবং ফলন ছিল বিঘাপ্রতি মাত্র ৪-৫ মণ। পাশাপাশি বন্যা ও খরার সময় আমনের গতানুগতিক ধানগাছ লম্বা হওয়ায় ঢলে পড়তো। সে বিষয়ও খেয়াল রেখে নতুন জাতগুলোর গাছ ছোট করা হয়েছে।
বিনা বলছে, জুন মাসের শেষ সপ্তাহ থেকে জুলাইয়ের দ্বিতীয় সপ্তাহ (আষাঢ়ের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে শেষ সপ্তাহ) পর্যন্ত বীজতলা তৈরি করে ২০-২৫ দিনের চারা রোপণ করলে ভালো ফসল পাওয়া যায়। তবে জুলাইয়ের শেষ (শ্রাবণের দ্বিতীয়) সপ্তাহ পর্যন্তও বীজতলা করা যায় এসব আগাম জাতের।
ড. মির্জা মোফাজ্জল ইসলাম বলেন, দীর্ঘ জীবনকাল বিশিষ্ট হওয়ায় উত্তরবঙ্গসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের কৃষকরা বছরে দু’টির বেশি ফসল চাষ করতে পারতো না। প্রায় ১৫/২০ বছর আগে দুর্ভিক্ষের মতো অবস্থা হতো। উত্তরবঙ্গসহ যমুনা পাড়ের অঞ্চলগুলোতে মঙ্গা বা মরা কার্তিক নামে এ সময়টি পরিচিত ছিল। এই মরা কার্তিককে ভরা কার্তিকে রূপান্তর করার জন্য এসব নতুন ধান খুবই কার্যকর হবে।
বিনার আমনের জাতগুলোর জীবনকাল কম হওয়ায় পানি ও অন্য উপকরণ খরচ কম লাগে। তথ্য বলছে, বিনা ধান-১৭ জাতে ইউরিয়া সার এক-তৃতীয়াংশ কম প্রয়োজন হয়। এছাড়া ৫০ শতাংশ সেচের অর্থ সাশ্রয় হবে। সার্বিকভাবে অন্য জাতের আমনের চেয়ে বিনার জাতগুলোর খরচ কমপক্ষে ৩০ শতাংশ কম। পাশাপাশি অমৌসুমে ধান কাটায় গোখাদ্য হিসেবে ধানের খড়ের সরবরাহ বাড়বে, ভালো দাম পাবেন কৃষক।