এবার সারের বাজারে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টির পাঁয়তারা চলছে। এক শ্রেণির ডিলারের কারসাজির কারণে নির্ধারিত মূল্যে পর্যাপ্ত সার পাচ্ছে না কৃষক। সম্প্রতি দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে এ অভিযোগ পাওয়া গেছে। তবে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে সারের পর্যাপ্ত মজুত আছে। কোনো সংকট সৃষ্টির সুযোগ নেই। বিষয়টি কঠোর নজরদারির আওতায় আনা হচ্ছে। অপরদিকে পরিস্থিতি পর্যালোচনা করতে রোববার সন্ধ্যায় বাংলাদেশ ফার্টিলাইজার অ্যাসোসিয়েশন (বিএফএ) জরুরি বৈঠক করেছে। এতে ডিলার পর্যায়ে নির্ধারিত মূল্যে সার বিক্রি নিশ্চিত করতে চিঠি দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে এসব তথ্য।
জানতে চাইলে কৃষি মন্ত্রণালয়ের সার ব্যবস্থাপনা ও উপকরণ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব মো. মাহবুবুল আলম রোববার রাতে বলেন, সরকারের কাছে সারের পর্যাপ্ত মজুত আছে। কোনো ডিলার সার নেই বললে হবে না। আমরা প্রত্যেক ডিলারকে পর্যাপ্ত বরাদ্দ দিয়েছি। এক্ষেত্রে কোনো ডিলার সার দেরিতে উত্তোলন করে সার সংকট বলে চালিয়ে দেবে সেটি হতে দেওয়া হবে না। এ ব্যাপারে মন্ত্রণালয় থেকে কঠোর মনিটরিং করা হচ্ছে। বিশেষ করে বরাদ্দ পাওয়া পর কোনো ডিলার দেরিতে উত্তোলন করছে কিনা, ফেলে রাখছে কিনা সেটি দেখা হচ্ছে। তবে শেষ কথা হচ্ছে সারের কোনো ঘাটতি নেই। জানতে চাইলে বিএফএর প্রেসিডেন্ট কামরুল আশরাফ খান পুটন রোববার বলেন, মাঠপর্যায়ে সারের কোনো সংকট নেই। পর্যাপ্ত মজুত আছে। এরপরও কিছু ডিলার মূল্য বেশি নিচ্ছে এমন সংবাদ আসছে। ডিলার পর্যায়ে সঠিক মূল্য নিশ্চিত করতে আজ অ্যাসোসিয়েশন থেকে নির্দেশ দেওয়া হবে। তিনি বলেন, সার পরিস্থিতি নিয়ে কিছু দিন আগে প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিবের সঙ্গে বৈঠক হয়েছে। সেখানেও দেখা গেছে সারের মজুত গত বছর এই সময় যা ছিল এবারও একই পর্যায়ে আছে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর বলছে, দেশের ১৭ জেলায় বাংলাদেশ ফার্টিলাইজার অ্যাসোসিয়েশনের (বাফা) গুদামে এক লাখ ১১ হাজার ৮৮৬ টন সার মজুত আছে।
সূত্র জানায়, বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশন (বিসিআইসি) কর্তৃক কাফকো বাংলাদেশ থেকে ৩০ হাজার টন ইউরিয়া সার কেনার প্রস্তাব অনুমোদন দেওয়া হয় ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠকে। এতে ব্যয় হবে ১৮৬ কোটি টাকা। এছাড়া বিসিআইসি কাতারের মুনতাজাত থেকে ৩০ হাজার টন ইউরিয়া সার এবং এসএবিআইসি সৌদি আরব থেকে ৩০ হাজার টন বাল্ক গ্র্যানুলার ইউরিয়া সার কিনবে। দাম হবে ২৮০ কোটি টাকা। কৃষি মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা জানান, মজুতের পাশাপাশি বিদেশ থেকে সার কেনা অব্যাহত আছে। এর আগের সপ্তাহে ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠকে সার আমদানির প্রস্তাব অনুমোদন হয়েছে।
এদিকে রংপুর, কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, রাজশাহী, ময়মনসিংহ, মানিকগঞ্জ, লক্ষ্মীপুরসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে অভিযোগ পাওয়া গেছে। শীতকালীন সবজি, ভুট্টা ও বোরো আবাদের এ সময়ে বিপাকে পড়েছেন কৃষকরা। এর ফলে এ বছর উৎপাদন কম হওয়ার আশঙ্কা করছেন কৃষিবিদরা। রবিশস্যের বীজ বপনের সময়কাল ১৬ অক্টোবর থেকে ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত। এই সময়ে মূলত অ-ইউরিয়া সার ব্যবহার করা হয়। চারা গজানোর পর ব্যবহার করা হয় ইউরিয়া সার। অ-ইউরিয়া সারগুলোর একটি হচ্ছে টিএসপি।
কৃষিসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, এ দেশের কৃষকেরা তিউনিসিয়ার কালো টিএসপি (ট্রিপল সুপার ফসফেট) সার বেশি পছন্দ করেন। মাঠপর্যায়ে টিএসপি সার ব্যবহার নিরুৎসাহিত করা হলেও তাতে এখনও সেভাবে সাড়া মেলেনি। সরকার কৃষকদের চাহিদা অনুযায়ী ভর্তুকি দিয়ে এই সার আমদানি করছে। এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে আমদানিকারক ও ব্যবসায়ীরা কৌশলে বেশি দাম নিচ্ছেন। কুড়িগ্রামের আমিন বাজার ক্রেতার মোড় বেলগাছার কৃষক নিজাম উদ্দিন বলেন, এখন ধান পেকেছে। সারের চাহিদা কিছুটা কম।
তবে অন্যান্য অঞ্চলে অভিযোগ থাকলেও তাদের এলাকাতে সার নিয়ে সংকটের অভিযোগ এখনও পায়নি।
কৃষক পর্যায়ে সরকার নির্ধারিত খুচরা মূল্য প্রতি বস্তা (৫০ কেজি) টিএসপি ১ হাজার ১০০ টাকা (প্রতি কেজি ২২ টাকা), এমওপি (মিউরেট অব পটাশ) ৭৫০ টাকা (১৫ টাকা কেজি) এবং ডিএপি (ডাই অ্যামোনিয়াম ফসফেট) ৮০০ টাকা (১৬ টাকা কেজি)। কৃষকরা বলছেন, প্রকারভেদে বস্তায় এবার তাদের সারের জন্য ১০০ থেকে ৪০০ টাকা পর্যন্ত বেশি খরচ করতে হচ্ছে।
রংপুরের বদরগঞ্জের কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, উপজেলার ১০টি ইউনিয়নের জন্য ১০ জন সার ডিলার নিয়োগ দেওয়া হলেও কেউই ইউনিয়নে গিয়ে সার বিক্রি করছেন না। সবাই বদরগঞ্জ পৌর শহরে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান খুলে সার বিক্রি করছেন। প্রত্যন্ত এলাকা থেকে সার নিতে পৌরসভায় আসতে হচ্ছে কৃষকদের। পাশাপাশি প্রতি বস্তায় সরকার নির্ধারিত দামের চেয়ে ৫০ থেকে ১০০ টাকা বেশি দিতে হচ্ছে। রাজশাহীতে ইউরিয়া, টিএসপি, পটাশসহ সব ধরনের সারের দাম বস্তাপ্রতি বেড়েছে ৩০০ থেকে ৫০০ টাকা।
লালমনিরহাটের পাটগ্রামের কৃষক সোহেল রানা বলেন, এখনও পুরোদমে ভুট্টার চাষ শুরু হয়নি, তাতেই বেশি দাম ছাড়া সার পাওয়া যাচ্ছে না।
কুড়িগ্রামের রৌমারীতে সারের দাম বেশি রাখার বিষয়ে উপজেলা কৃষি কর্মকর্তার কাছে লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন ভুক্তভোগী কৃষকরা। তাদের অভিযোগ, কৃষি অফিসের কর্মকর্তারা নিয়মিত সারের বাজার মনিটর না করায় এমন অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে।