জুমের সোনালী ধানে রাঙামাটির পাহাড়গুলো চকচক করছে। শুরু হয়েছে ধান কাটার উৎসব।
জুম চাষিদের চোখে-মুখে এখন আনন্দের ফোয়ারা বইছে। পাকা ধান ঘরে তুলতে ব্যস্ত সময় পার করছেন জুমিয়ারা। পার্বত্য চট্টগ্রামের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীদের প্রধান পেশা হচ্ছে কৃষি।
বৃহস্পতিবার (২১ অক্টোবর) অনেকে জুমের ফসল কাটতে শুরু করেছেন।
রাঙামাটি সদর উপজেলার মগবান ইউনিয়নের বিলাইছড়ি পাড়ার বাসিন্দা জুমচাষি সুমিত্রা চাকমা বাংলানিউজকে বলেন, দুই একর জমিতে আমি সাত কেজি তুর্কি ধান লাগিয়েছিলাম। ফসল কাটছি এখন। আমি বরকল উপজেলায় গেলে আমার এক আত্মীয় ভারতের মিজোরাম থেকে আনা তুর্কি ধানের বীজ উপহার দেন। এগুলো এনে জমিতে লাগিয়েছিলাম। শুনেছি, জাতটির ধান অত্যন্ত ভালো এবং ফসল ভালো হয়।
একই এলাকার জুমচাষি বসু দেব চাকমা বলেন, আমি অন্যান্য ফসলের সঙ্গে এবার তিন একর জায়গায় তুর্কি ধান রোপণ করেছি। আশা করছি, ভালো ফসল পাব। পাশাপাশি মরিচ, করলা, বরবটি, ঝিংগা. চিচিংগা, চাল কুমড়া, কাকরোল লাগিয়েছি।
সুরেশ দেবী চাকমা বলেন, আমি ছুড়ি ধান রোপণের পাশাপাশি দুই একর জমিতে নতুন জাত তুর্কি ধান রোপণ করেছি। এটা ভারত থেকে আনা জাত। ভালো ফলন হয়। তাই পাশের লোকজনের কাছ থেকে বীজ নিয়ে আমার জমিতে লাগিয়েছি। ছুড়ি ধান কাটা শুরু করেছি। এরপর তুর্কি ধান কাটব।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর রাঙামাটি কার্যালয় থেকে জানা গেছে, জুমে নানাবিধ ফসল চাষ হয়ে থাকে। এর মধ্যে- স্থানীয় এবং উফশী জাতের ধান, মিষ্টি কুমড়া, মারফা, চিনাল, শিম, শসা, করলা, ঢেঁড়শ, তিল, ভুট্টা, মরিচ, কাউন, বিলাতী ধনিয়া, করলা, বরবটি, ঝিংগা. চিচিংগা, চাল কুমড়া, কাকরোল, পুঁইশাক, জুমকচু, মুখিকচু, বেগুন, লাউ, ধুন্দল, আদা, হলুদ, যব, তুলা, পাহাড়ি আলু (যা ঠান্ডা আলু হিসেবে পরিচিত) ইত্যাদি।
সূত্রটি আরও জানায়, জুম চাষের পদ্ধতিও ভিন্ন রকম। পৌষ-মাঘ মাসে সুবিধাজনক সময়ে চাষের জন্য পাহাড় নির্বাচন করা হয়। তারপর জঙ্গলের সমস্ত গাছ, বাঁশ, ঝাড়-জঙ্গল কেটে ফেলা হয়। কাটার পর সেগুলো রোদে শুকানো হয় চৈত্র মাস পর্যন্ত। চৈত্র ও বৈশাখের শুরুতে এতে আগুন জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। তাতে শুকিয়ে যাওয়া গাছপালা পুড়ে ছাই হয়ে যায়। সেই সঙ্গে ওপরের এক-দুই ইঞ্চি মাটিও পুড়ে যায়। ছাই ও পোড়া মাটির জন্য জমি ঊর্বর হয়। এরপর দু-এক পশলা বৃষ্টি হলে জমি ভিজে নরম হয়। তারপর বীজ বোনার কাজ শুরু হয়।
সূত্রটি বলছে, রাঙামাটি জেলায় এ বছর পাঁচ হাজার ৫৮০ হেক্টর পাহাড়ে জুম ধান (উফশী) চাষ করা হয়েছে। এবারের আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় ও সঠিক পরিমাণে বৃষ্টিপাতের কারণে এবার জুমের ফলন ভালো হয়েছে। জুম ধানের মধ্যে দেশীয় বিরি ধান ২৪, ২৬, ২৭, ৪৮ জাতের ধান চাষ করা হয়েছে। পাশাপাশি কালবিনি, সাদাবিনি, গেলং, কবারক, আমেই, বাদোয়ে, বিনি ধান জাতের চাষ হয়েছে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর রাঙামাটি অঞ্চলের উপ-পরিচালক কৃষ্ণ প্রসাদ মল্লিক বলেন, গত বছরের তুলনায় এ মৌসুমে জুমের ভালো ফলন হয়েছে। জুম চাষিদের স্থানীয় বীজের পাশাপাশি খড়া সহিষ্ণু ফলনশীল বিরি ধান- ২৪, ২৬, ২৭, ৪৮ জাতের ধান চাষ করা হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, জুম চাষ পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর হলেও পাহাড়িদের জন্য এ চাষের কোনো বিকল্প নেই। এটি পাহাড়িদের ঐতিহ্যও বহন করে। এজন্য পাহাড়ের ভূমি ক্ষয়রোধে জুম চাষিদের পাহাড় আড়াআড়ি কেটে চাষ করতে বলা হচ্ছে।
রাজস্থলী উপজেলার কাপ্তাই মৌজা, কমলছড়ি এলাকা, চিংকং মৌজা, জুরাছড়ি উপজেলার মৈদং, বাঘাইছড়ি উপজেলার সাজেক এলাকায় জুম চাষ ছাড়া কোনো বিকল্প নেই বলেও জানান তিনি।
তুর্কি ধানের বিষয়ে তিনি বলেন, আমরা স্থানীদের মাধ্যমে শুনে জুমিয়াদের বাড়িতে গিয়েছি। তারা বলেছেন, এটা ভারতীয় ধান। আমাদের কাছে এ ধান নিয়ে কোনো তথ্য নেই। যদি এ বছর কৃষকরা তুর্কি ধান থেকে ভালো ফলন পান, তাহলে আমি ধানটি বিবেচনায় আনব।