বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশন (বিএডিসি) সার পরিবহন ঠিকাদার সিন্ডিকেটে কালো টিএসপি ও এমওপি সারের বাজার নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়েছে।
আসন্ন ভরা রবি মৌসুমে কৃষকের পছন্দের তিউনেশিয়ার কালো টিএসপির সরবরাহে ঘাটতি থাকায় ‘সোনার হরিণে’ পরিণত হয়েছে, আর এই সুযোগে খুচরা পর্যায়ে সরকার নির্ধারিত দামের চেয়েও ৪০০-৫০০ টাকা বেশি দরে বিক্রি হচ্ছে।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, সার পরিবহনের কাজে নিয়োজিত কিছু পরিবহন ঠিকাদারই এ অপকর্মের হোতা। বিএডিসি’র কিছু অসাধু কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগসাজশ করেই ভরা মৌসুমে কৃষকের সার নিয়ে অবৈধ বাণিজ্যে মেতেছেন। এতে কৃষি বান্ধব সরকারের সুনাম ক্ষুন্ন হচ্ছে।
অভিযোগ পাওয়া গেছে, বিতরণ ব্যবস্থায় সরকারের সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা মেনে বিএডিসি কর্মকর্তারা তদারকি না করায় এমন সংকট সৃষ্টি হয়েছে। আসন্ন রবি মৌসুমে সারের চাহিদা অনুযায়ী সরকার আগেভাগেই জেলায়-জেলায় বরাদ্দ দিয়েছেন। তবে, সরেজমিনে দেখা গেছে খোলা আকাশের নিচে বরাদ্দের সার পড়ে থাকলেও সময়মতো সরকারি গুদামে যাচ্ছে না।
২০২১-২০২২ অর্থবছরে তিউনেশিয়া থেকে এমভি ভোলা নামের একটি মাদার ভ্যাসেলে ৩৩ হাজার মেট্রিক টন টিএসপি আনা হয়। ৩১ আগস্ট বিএডিসির এক কার্যাদেশে, ২০ হাজার মেট্রিক টন খুলনা হতে বিভিন্ন গুদামে এবং ১৩ হাজার মেট্রিক টন চট্টগ্রাম থেকে বিভিন্ন গুদামে পৌঁছে দেওয়ার নির্দেশনা দেওয়া হয়। আর এ কাজের জন্য আগেভাগেই প্রায় ৩ কোটি টাকা ব্যয়ে পরিবহন ঠিকাদার নিয়োগ করা হয়। এ দায়িত্ব পেয়েছিল মেসার্স পোটন ট্রেডার্স নামের প্রতিষ্ঠানটি।
তবে, ৩১ আগস্ট কার্যাদেশ পেলেও সময়মতো পরিবহন শুরু না করায় এখনও বিভিন্ন অঞ্চলে আকাশের নীচে প্রায় সাড়ে ৮ হাজার মেট্রিক টন কালো টিএসপি সার পড়ে রয়েছে।
এছাড়াও তিউনিশিয়া হতে ২০২০-২০২১ অর্থবছরের চুক্তির আওয়তায় ২০২১-২০২২ অর্থবছরে এমভি ববিক নামের একটি জাহাজে দ্বিতীয় লটে আমদানির ৩০ হাজার ২৬০ মেট্রিক টন কালো টিএসপি আনা হয়। ১১ অক্টোবর বিএডিসির এক কার্যাদেশে, খুলনা হতে ১৮ হাজার ২৬০ মেট্রিক টন বিভিন্ন গুদামে এবং চট্টগ্রাম থেকে ১২ হাজার মেট্রিকটন বিভিন্ন গুদামে পোঁছানোর নির্দেশনা দেওয়া হয়।
এ কাজের পরিবহন ঠিকাদার ছিল মেসার্স কে. এন এন্টারপ্রাইজ নামের একটি প্রতিষ্ঠান। তবে, সরকারি কয়েক কোটি টাকায় চুক্তিবদ্ধ এ প্রতিষ্ঠানও সার সাপ্লাই দিচ্ছে ঢিলেঢালাভাবে। খুলনা ও চট্টগ্রামের খোলা আকাশের নিচে এখনও প্রায় সাড়ে ২৬ হাজার মেট্রিক টন টিএসপি সার পড়ে রয়েছে।
কৃষি সংশ্লিষ্টদের মতে, অক্টোবরের ১৫ তারিখ থেকে মার্চের ১৫ তারিখ পর্যন্ত সময়কালকে রবি মৌসুম বলে। এই সময়ে রবিশস্য হিসেবে আলু, গম, মসুর, শর্ষে, ডাল, পেঁয়াজ, মটরশুঁটি, শীতকালীন সবজির বীজ বপন করা হয়। এতে অ-ইউরিয়া সারের ব্যবহার বাড়ে বহুগুণে। বাংলাদেশের কৃষক এসব চাষাবাদে কালো টিএসপিকে বেশি পছন্দ করে, তবে সরকার সরবরাহ ঠিক রাখতে পর্যাপ্ত সার আমদানি করলেও বিএডিসির তদারকির অভাবে সরবরাহ ঠিকমতো না হওয়ায় ডিলার পর্যায়ে সংকট তৈরি হয়েছে।
নীতিমালা অনুযায়ী, বিদেশ থেকে সারের জাহাজ বন্দরে পৌঁছালে তা পরিদর্শন করে বরাদ্দ দেওয়া হয়। এবং সংশ্লিষ্ট পরিবহন ঠিকাদারকে চিঠি দিয়ে বরাদ্দ অনুযায়ী সার সংশ্লিষ্ট গুদামে পৌঁছানোর নির্দেশনা দেওয়া হয়। এরপর সার পরিবেশকরা (ডিলার) স্ব-স্ব জেলার বিএডিসি গুদাম থেকে সার উত্তোলন করবেন। তবে, পরিবহন ঠিকাদাররা এই সরকারি সার বহনের পথে কোটি কোটি টাকার সরকারি সার ‘হজম করে ফেলেছেন’ এমন নজিরও রয়েছে।
২০১৯-২০২০ অর্থ বছরে রাশিয়া থেকে তিনটি মাদার ভ্যাসেলে আনা ৯২ হাজার মে.টন এমওপি সারের মধ্যে এখনও ২৫ হাজার মে. টন এমওপি এখনও সরকারি গুদামগুলোতে পৌঁছায়নি, যার আনুমানিক দাম প্রায় ৩৩ কোটি টাকা। ওই সারের পরিবহন ঠিকাদার ছিল সার সেক্টরের আলোচিত প্রতিষ্ঠান মেসার্স পোটন ট্রেডার্স।
কৃষক পর্যায়ে সরকারনির্ধারিত খুচরা মূল্য প্রতি বস্তা টিএসপি (৫০ কেজি) ১ হাজার ১০০ টাকা (প্রতি কেজি ২২ টাকা), এমওপি (মিউরেট অব পটাশ) ৭৫০ টাকা (১৫ টাকা কেজি) টাকা বিক্রয় দাম নির্ধারণ করা হলেও সংকটে কৃষকদের জিম্মি করে প্রতি বস্তা সার ৪০০ থেকে ৬০০ টাকা পর্যন্ত বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে।
এদিকে সারের জন্য হাহাকার করছে কৃষক। যশোরের কৃষক রহিম হাওলাদার নিজের তিন বিঘা জমিতে শীতের সবজি ও গম চাষ করেন। তিনি বলেন, সময়মতো সার ও যত্ন না নিলে আগে আগে সবজি তোলা যায় না। ফলে বাজারের বিক্রি করে ভালো দামও আসে না। সব কিছুর দাম বেশি, বিশেষ করে সারের। এত খরচ করে কৃষিকাজ করে এখন সংসার চালানো কঠিন হয়ে গেছে।
সার পরিবহন ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান মেসার্স পোটন ট্রেডার্সের জেনারেল ম্যানেজার (জিএম) শাহাদৎ হোসেন বলেন, জাহাজগুলো বন্দরে আসা মাত্রই তো আনলোড করা যায় না। বিভিন্ন জেলায় পাঠাতে সময় লাগে। সেভাবেই দ্রুত গতিতে কাজ চলছে। আশা করছি, দ্রুতই সমস্যার সমাধান হবে। তবে, তাদের প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অভিযোগের বিষয়ে তিনি সদুত্তর দিতে পারেননি।
বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশন (বিএডিসি) খুলনা অঞ্চলের যুগ্ম পরিচালক মো. রোকনুজ্জামান বলেন, ‘আমরা বরাদ্দ অনুযায়ী সার পৌঁছানোর চেষ্টা করছি, তবে যেসব গুদাম বরাদ্দের সার পাবে, দ্রুতই তাদেরকে পৌঁছে দেওয়া হবে। বিলম্ব প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আগে একটি জাহাজের সার পরিবহনের জন্য অন্তত ৩জন ঠিকাদার কাজ করতেন। তবে এখন একজন ঠিকাদার তারপরও সপ্তাহে বন্ধের দিন রয়েছে, সব মিলিয়ে কিছুটা সময় লাগছে। সার ঠিকাদাররা গুদামে পৌঁছে না দিয়ে ডিলারদের ড্যাম্প থেকে সার নিতে বাধ্য করছেন এমন অভিযোগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এটা সম্পূর্ণ বেআইনি। এ ব্যাপারে কেউ অভিযোগ করলে ব্যবস্থা নেব।