আজ আন্তর্জাতিক নারী দিবস: নারী আন্দোলনের ইতিহাসে এক গৌরবময় দিন

নিজস্ব প্রতিবেদক: আজ আন্তর্জাতিক নারী দিবস।  এবারের নারী দিবসের প্রতিপাদ্য বিষয় হলো, ‘টেকসই আগামীর জন্য, জেন্ডার সমতাই আজ অগ্রগণ্য’। অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিকসহ উন্নয়নের সব ক্ষেত্রে নারীর সমান অংশীদারি এবং সম-অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও সরকারি-বেসরকারিভাবে যথাযোগ্য মর্যাদায় দিবসটি পালিত হচ্ছে। 

আন্তর্জাতিক নারী দিবস উপলক্ষে সংবাদপত্রে বিশেষ ক্রোড়পত্র প্রকাশ করা হয়েছে। মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় দেশব্যাপী ব্যাপক কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। দিবসটি উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আলাদাভাবে বাণী দিয়েছেন।

বানীতে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ বলেছেন, ‘নারীর ক্ষমতায়নে গত ৫০ বছরের অর্জন বাংলাদেশকে বিশ্বে রোল মডেল পরিচিতি এনে দিয়েছে। সরকারের বলিষ্ঠ পদক্ষেপের পাশাপাশি নারীদের সচেতনতা এ অর্জনকে ত্বরান্বিত করেছে। এবারের আন্তর্জাতিক নারী দিবসের প্রতিপাদ্য ‘টেকসই আগামীর জন্য, জেন্ডার সমতাই আজ অগ্রগণ্য’ বর্তমান প্রেক্ষাপটে অত্যন্ত সময়োপযোগী হয়েছে বলে আমি মনে করি। আন্তর্জাতিক নারী দিবস ২০২২ উপলক্ষ্যে আমি বাংলাদেশসহ বিশ্বের সব নারীকে জানাই আন্তরিক শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন।’

রাষ্ট্রপতি তার বানীতে আরও বলেন, ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ১৯(৩) অনুচ্ছেদে জাতীয় জীবনের সর্বস্তরে নারীদের অংশগ্রহণ ও সুযোগের সমতা রাষ্ট্র কর্তৃক নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে। নারীদের যথার্থ মর্যাদা প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি অর্থনৈতিক, সামাজিক, প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের লক্ষ্যে সরকার নারী শিক্ষার বিস্তার, অধিকার প্রতিষ্ঠা, ক্ষমতায়নসহ নারীর প্রতি সব ধরনের সহিংসতা প্রতিরোধে ব্যাপক কার্যক্রম বাস্তবায়ন করছে। সরকারের বিভিন্ন উদ্যোগের সফল বাস্তবায়নের ফলে নারী উন্নয়ন আজ সুস্পষ্টভাবে দৃশ্যমান। ব্যবসা-বাণিজ্য, রাজনীতি, বিচার বিভাগ, প্রশাসন, কূটনীতি, সশস্ত্রবাহিনী, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারীবাহিনী, শান্তিরক্ষা মিশনসহ সবক্ষেত্রে নারীর সফল অংশগ্রহণের মাধ্যমে দেশ ক্রমান্বয়ে উন্নয়নের পথে এগিয়ে যাচ্ছে।’

অপর এক বানীতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘নারী আন্দোলনের ইতিহাসে আজ এক গৌরবময় দিন। দীর্ঘ কর্মঘণ্টা আর মজুরি বৈষম্যের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে নারীরা আদায় করেছিলেন তাদের অধিকার। আদায় করেছিলেন বিশ্ব সমীহ। নারী তার মেধা ও শ্রম দিয়ে যুগে যুগে সভ্যতার সব অগ্রগতি এবং উন্নয়নে করেছে সমঅংশীদারত্ব। আর তাই সারাবিশ্বে বদলে গেছে নারীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি। এখন নারীর কাজে মূল্যায়ন হচ্ছে, বৃদ্ধি পাচ্ছে স্বীকৃতি। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও ৮ মার্চ ‘আন্তর্জাতিক নারী দিবস’ পালন করা হচ্ছে জেনে আমি আনন্দিত। এবারের প্রতিপাদ্য ‘টেকসই আগামীর জন্য- জেন্ডার সমতাই আজ অগ্রগণ্য’ অত্যন্ত সময়োপযোগী হয়েছে বলে আমি মনে করি। দিবসটি উপলক্ষে আমি বিশ্বের সব নারীকে আন্তরিক শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানাচ্ছি। সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত নারীদের পুনর্বাসন ও ক্ষমতায়নের লক্ষ্যে ১৯৭২ সালে নারী পুনর্বাসন বোর্ড গঠন করেন। তিনি জাতীয় জীবনের সব ক্ষেত্রে নারীর সমানাধিকারের বিষয়টি সংবিধানে নিশ্চিত করেন।’

বানীতে প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, ‘জাতির পিতার স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ গড়তে আওয়ামী লীগ সরকার প্রতিটি কাজে নারী-পুরুষের সম-অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার চেষ্টা করেছে। স্বাধীনতার ৫০ বছরে বাংলাদেশের অন্যতম অর্জন লিঙ্গবৈষম্য কমিয়ে নারীর ক্ষমতায়নের পথে এগিয়ে থাকার উল্লেখযোগ্য সাফল্য লাভ। এরই ধারাবাহিকতায় এদেশের উন্নয়নের ধারাকে টেকসই করার লক্ষ্যে আমাদের সরকার তৃণমূল পর্যায় থেকে নারীর খাদ্য নিরাপত্তা, স্বাস্থ্য ও শিক্ষাকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়েছে। নারীর দারিদ্র্য বিমোচনে সামাজিক নিরাপত্তা বলয়ের আওতায় বাস্তবায়িত হচ্ছে ভিজিডি কর্মসূচি, দরিদ্র মায়ের জন্য মাতৃত্বকালীন ভাতা প্রদান কর্মসূচি, কর্মজীবী ল্যাকটেটিং মাদার সহায়তা কর্মসূচি, নারীদের আত্ম-কর্মসংস্থানের জন্য কর্মমুখী প্রশিক্ষণ এবং ক্ষুদ্রঋণসহ বিভিন্ন ধরনের প্রকল্প ও কর্মসূচি।’

এদিকে মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় আজ নারী দিবসের অনুষ্ঠানে জাতীয় পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ পাঁচজন জয়িতাকে সম্মাননা প্রদান করবে। তাঁরা ঢাকায় ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তন থেকে অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনির কাছ থেকে সম্মাননা পদক, ক্রেস্ট ও এক লাখ টাকার চেক গ্রহণ করবেন। এছাড়াও এ বছর অর্থনৈতিকভাবে সাফল্য অর্জনকারী নারী রাজশাহী বিভাগের সিরাজগঞ্জ জেলার মোসা. সানজিদা আক্তার শিমু, শিক্ষা ও চাকরি ক্ষেত্রে সাফল্য অর্জনকারী রাজশাহী বিভাগের রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক ড. হোসনে আরা আরজু, সফল জননী হিসেবে চট্টগ্রাম বিভাগের খোশনাহার বেগম, নির্যাতনের বিভীষিকা মুছে ফেলে নতুন উদ্যমে জীবন শুরু করার ক্ষেত্রে বরিশাল বিভাগের জেসমিন আক্তার ও সমাজ উন্নয়নে অবদান রাখায় রংপুর বিভাগের মোছা. রোকেয়া বেগম শ্রেষ্ঠ জয়িতার সম্মাননা পাচ্ছেন।

দিবসটি উপলক্ষে গুরুত্বপূর্ণ সড়ক পোস্টার, ব্যানার ও ফেস্টুন দিয়ে সজ্জিত করা হবে। দেশের সব জেলা ও উপজেলায় নারী উন্নয়ন, ক্ষমতায়ন, অধিকার এবং এ বিষয়ে প্রচার ও সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষে শোভাযাত্রা, সমাবেশ ও আলোচনা অনুষ্ঠানের কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। বেসরকারি পর্যায়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সংগঠন বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করতে যাচ্ছে। পাক্ষিক অনন্যা আজ বিকেল ৪টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের অধ্যাপক মোজাফফর আহমেদ চৌধুরী মিলনায়তনে আলোচনাসভা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে। সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় ‘উইমেন অব এক্সিলেন্স বাই র্যাডিসন ব্লু ঢাকা ওয়াটার গার্ডেন’ শীর্ষক একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে ‘র্যাডিসন ব্লু ঢাকা ওয়াটার গার্ডেন’।

বাংলাদেশ নারীমুক্তি কেন্দ্রের উদ্যোগে আজ বিকেল ৪টায় জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে এ দিবস উপলক্ষে ‘ধর্ষণ-যৌন নিপীড়ন ও সহিংসতার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান, নারীর মর্যাদা ও অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে ঐক্যবদ্ধ হোন’ এই স্লোগান সামনে রেখে মিছিল ও সমাবেশের আয়োজন রয়েছে। ‘কর্মজীবী নারী’ সকাল ১০টায় মিরপুর-১৩-এর হারম্যান মেইনার স্কুলের পাশে মানববন্ধন ও শোভাযাত্রার আয়োজন করতে যাচ্ছে।

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজ-বিলস সুনীতি প্রকল্পের আওতায় সকাল ৯টা থেকে ১০টা পর্যন্ত শাহবাগ জাতীয় জাদুঘরের সামনে মানববন্ধন ও শোভাযাত্রার আয়োজন করতে যাচ্ছে। এতে বিলস সহযোগী জাতীয় ট্রেড ইউনিয়ন ফেডারেশনের নেতারা, গৃহশ্রমিক অধিকার প্রতিষ্ঠা নেটওয়ার্কের প্রতিনিধি, নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি ও অন্যান্য সহযোগী সংগঠনের প্রতিনিধিসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে গৃহশ্রমিকরা উপস্থিত থাকবেন। এ ছাড়া নারী মৈত্রীর উদ্যোগে বিভিন্ন এলাকায় ভ্যান শোভাযাত্রা, ইউসেপ বাংলাদেশ- এর উদ্যোগে মিরপুরে আলোচনাসভা, হ্যালোটাস্ক-এর উদ্যোগে গৃহশ্রমিক নিয়োগকারীদের নিয়ে আলোচনাসভা এবং রেড অরেঞ্জের উদ্যোগে সোশ্যাল মিডিয়া ক্যাম্পেইনের আয়োজন করা হয়েছে।

আন্তর্জাতিক নারী দিবস উপলক্ষে ‘আমরাই পারি জোট’ গতরাত থেকে সব ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের সমতা ও সম-অংশীদারি নিশ্চিতকরণের পাশাপাশি নারীর জন্য প্রতিটি স্থান, প্রতিটি সময়, প্রতিটি মুহূর্তকে নিরাপদ করার দাবিতে বিশেষ হ্যাশট্যাগ (#) ক্যাম্পেইন ‘আঁধার ভাঙার শপথ’ শুরু করেছে।

প্রসঙ্গত, ১৯১০ সালের ৮ মার্চ নিউ ইয়র্কের সেলাই কারখানার নারী শ্রমিকদের আন্দোলনের প্রতি সম্মান জানাতে ৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালন করা হয়ে থাকে। জাতিসংঘ ১৯৭৫ সাল থেকে ৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালন শুরু করে। বাংলাদেশে নারীসমাজের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন, নারী অধিকার রক্ষা, নারীর ক্ষমতায়ন ও সমতার উন্নয়নের জন্য দিবসটির গুরুত্ব অপরিসীম। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের (ডাব্লিউইএফ) গত বছর ৩০ মার্চ প্রকাশিত সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুসারে নারী-পুরুষের সমতার দিক থেকে বিশ্বে ১৫৬টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৬৫তম। আর দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে প্রথম অবস্থানে। নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়নে বাংলাদেশ বিশ্বে সপ্তম। বাংলাদেশের নারীরা আজ সচিব, বিচারক, সশস্ত্র বাহিনীসহ সব গুরুত্বপূর্ণ পদে অত্যন্ত সফলতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করছেন। আত্মকর্মসংস্থান ও উদ্যোক্তা হিসেবে বিশ্বে অনন্য উদাহরণ সৃষ্টি করেছেন।