ভোক্তাকণ্ঠ ডেস্ক
ই-ভ্যালিসহ বিভিন্ন ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে প্রতারণার শিকার গ্রাহকরা তাদের পাওনা টাকা কীভাবে ফেরত পাবেন, তা জানা নেই কারও। গ্রাহকরা অদৌ কোনো অর্থ ফেরত পাবেন কি না, কিংবা পেলেও কতটুকু পাবেন— সে বিষয়েও স্পষ্ট ধারণা দিতে পারছেন না সংশ্লিষ্টরা।
জানা গেছে, প্রতিষ্ঠানগুলোকে কোম্পানি আইনে অবসায়ন (বিলুপ্ত) করে গ্রাহকের অর্থ ফেরত দেওয়া হলে সেক্ষেত্রেও তারা খুবই নগণ্য পরিমাণ অর্থ ফেরত পাবেন। সে ক্ষেত্রেও রয়েছে বেশ জটিলতা। কারণ বেশকিছু প্রতিষ্ঠান কেবল ট্রেড লাইসেন্স দিয়ে পরিচালিত হয়েছে। আবার কোনোটির ট্রেড লাইসেন্সও ছিল না।
এছাড়া সরকারের পক্ষ থেকে গ্রাহকদের ক্ষতিপূরণ দেওয়ার প্রস্তাব এলেও তাতেও সায় মিলছে না। সব মিলিয়ে ই-কমার্সে ক্ষতিগ্রস্তরা আদৌ তাদের পাওনা কোনো টাকা ফেরত পাবেন কি না, তা নিয়েই উঠেছে প্রশ্ন।
জানতে চাইলে বাণিজ্য সচিব তপন কান্তি ঘোষ বলেন, ‘গ্রাহক যাদের (প্রতিষ্ঠান) টাকা দিয়েছে, সেসব প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকেই তাদের টাকা ফেরত পেতে হবে। টাকা ফেরত পেতে তারা বিভিন্ন আইনে মামলা করতে পারেন। আইনের দ্বারস্থ হতে পারেন।’
সরকারের পক্ষ থেকে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার প্রসঙ্গ এককথায় নাকচ করে দিচ্ছেন বাণিজ্য সচিব। তিনি বলেন, ‘সরকার ক্ষতিপূরণ কেন দেবে? গ্রাহক কি সরকারকে টাকা দিয়েছে? সরকার কি এসব প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে কোনোভাবে লাভবান হয়েছে? তাই টাকা ওইসব প্রতিষ্ঠান থেকেই পেতে হবে।’
প্রতিষ্ঠানগুলোকে অবসায়নের মাধ্যমে গ্রাহকদের টাকা ফেরত দেওয়া সম্ভব কি না- এমন প্রশ্নের জবাবে সচিব বলেন, ‘অবসায়ন তো সবাইকে করা যাবে না। কোনো প্রতিষ্ঠানের মালিক টাকা নিয়ে দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেছে। কোনোটি কোম্পানি আইনে, আবার কোনোটি চলেছে কেবল ট্রেড লাইসেন্স দিয়ে। আবার কোনোটির ট্রেড লাইসেন্স ছিলই না।
তাই সবগুলোকে এক ক্যাটাগরিতে ফেলা যাবে না। কোন প্রতিষ্ঠানকে কোন ক্যাটাগরিতে ফেলা যায়, সেটি নির্ধারণ করতে আমরা একটি টেকনিক্যাল কমিটি করে দেবো। তবে ব্যক্তিগতভাবে টাকা ফেরত পেতে গ্রাহককেই উদ্যোগ নিতে হবে।’
গ্রাহকের টাকা ফেরত পাওয়ার বিষয়ে মন্তব্য জানতে চাইলে ব্যারিস্টার অনিক আর হক সরাসরিই জানিয়ে দিচ্ছেন, ইভ্যালি বা এরকম প্রতিষ্ঠানের কাছে প্রতারণার শিকার গ্রাহকদের টাকা ফেরত পাওয়ার কোনো সুযোগই নেই।
তিনি বলেন, ‘গ্রাহকের টাকা ফেরত পাওয়ার কোনো উপায় নেই। টাকা ফেরত পাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। কারণ কোম্পানিগুলোকে অবসায়ন করলেও যে দেনা আছে তা পূরণ হবে না। কারণ কোম্পানিগুলোর তেমন কোনো সম্পদ নেই।’
এক প্রশ্নের উত্তরে এই আইনজীবী বলেন, ‘ফৌজদারি মামলা হলে জেল হবে। কিন্তু গ্রাহক তো টাকা পাবে না। জরিমানা দিলে সরকারকে দেবে। তাতেও তো গ্রাহক কোনো টাকা পাবে না।’
কিছুটা হলেও টাকা ফেরত পেতে প্রতারণার শিকার গ্রাহকদেরই উদ্যোগ নেওয়ার কথা বললেন বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশনের চেয়ারপারসন মফিজুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘গ্রাহকের সঙ্গে প্রতারণা হয়ে থাকলে তার আইন আছে। ফৌজদারি মামলা হবে। গ্রাহককে সেই মামলা করতে হবে। যার সঙ্গে প্রতারণা হয়েছে তাকে আদালতে মামলা করতে হবে। কিন্তু প্রতারণার বিষয়টি আমার প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সম্পৃক্ত নয়।’
এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘করোনাকালে এক বছর আগে আমরা ই-ভ্যালির বিরুদ্ধে মামলা করেছি। অন্তবর্তীকালীন রায় দিয়েছি। তারপরও আমরা কেন সচেতন হলাম না, সেই প্রশ্ন আমারও। কিন্তু প্রতিষ্ঠান হিসেবে আমরা কারও ব্যবসা বন্ধ করতে পারি না। আবার গ্রাহককে টাকা আদায় করে দেওয়ার অধিকারও আমার প্রতিষ্ঠানের নেই।’
সম্প্রতি ই-কমার্স কেলেঙ্কারি নজরদারি ও প্রতিরোধে এবং ভুক্তভোগী গ্রাহকদের স্বার্থ রক্ষায় সরকারের ব্যর্থতা চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে রিট দায়ের করেছেন আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির।
ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান ই-অরেঞ্জের ৩৩ জন ভুক্তভোগী গ্রাহকের পক্ষে তিনি রিটটি দায়ের করেন। মন্তব্য জানতে চাইলে এই আইনজীবী বলেন, ‘পরিপূর্ণভাবে গ্রাহকের টাকা ফেরত পাওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। পেলেও সেটা আংশিক। এক্ষেত্রে সরকার ক্ষতিগ্রস্ত গ্রাহকদের ক্ষতিপূরণ দিতে পারে, সেটিও ব্যবসাকে বাঁচিয়ে রাখার স্বার্থে।’
গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিপিডি আয়োজিত ‘ই-কমার্স খাতের চ্যালেঞ্জ: সাম্প্রতিক প্রেক্ষাপট ও করণীয়’ শীর্ষক এক ভার্চুয়াল আলোচনা সভায় ওই প্রস্তাব আসে। আলোচনায় অংশ নিয়ে ব্যারিস্টার তানজিব উল আলম বলেন, ‘অনেকে বলাবলি করছে- সরকারি অর্থায়ন থেকে জনগণের পাওনা মিটিয়ে দেওয়া হোক। কিন্তু জনগণের করের টাকা সরকারের কাছে আমানত। একজনের লুটপাটের টাকা পরিশোধে আমি ট্যাক্স দিইনি। এটি সংবিধানবিরোধী।
তাই এখন কোম্পানি আইন অনুযায়ী ওই কোম্পানিকে অবসায়ন করে যে অর্থ পাওয়া যায় তা দিয়ে পাওনা পরিশোধ করা যেতে পারে। এক্ষেত্রে যে লোকের ২০ হাজার টাকা পাওনা আছে, তাকে এক হাজার টাকা দেওয়া সম্ভব হলে তাকে সেটা নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হবে। কিন্তু কোনোভাবেই করের টাকায় এই পাওনা পরিশোধ করা যাবে না।’
নাম প্রকাশ না করার শর্তে জাতীয় ভোক্তা সংরক্ষণ অধিদফতরের একজন উপপরিচালক বলেছেন, ভোক্তা অধিকার আইনের দ্বারস্থ হলেও গ্রাহক তার পুরো টাকা পাবেন না। কারণ জাতীয় ভোক্তা সংরক্ষণ অধিদফতর কোনো প্রতিষ্ঠানকে সর্বোচ্চ ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করতে পারে। কোনো গ্রাহক ৫০ হাজার টাকার বেশি পণ্য অর্ডার করে থাকলে ভোক্তা অধিকার আইনের আশ্রয় নিলে তিনি খুব একটা লাভবান হবেন না।
আবার ই-ভ্যালির মতো প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা এখন আইনের আশ্রয়ে থাকায় এই প্রতিষ্ঠানের গ্রাহক ভোক্তা অধিকারের আশ্রয় নিয়েও লাভবান হবেন না। কারণ ভোক্তা অধিকারের পক্ষ থেকে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে এখন আর যোগাযোগ করা যাচ্ছে না বা যাবে না। তবে কার্যক্রম চলমান রয়েছে- এমন কোনো প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে প্রতারিত হলে কিছুটা হলেও প্রতিকার পাওয়া সম্ভব। তবে সেই ক্ষেত্রেও পুরো অর্থ ফেরত পাওয়ার সুযোগ ক্ষীণ।
ই-কমার্স ব্যবসায়ীদের সংগঠন ই-ক্যাবও বলছে, এ বিষয়টির কিছুই তাদের হাতে নেই। ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলোকে যেন নীতিমালার মধ্যে আনা যায়, সে বিষয়টি নিয়ে কাজ করছে বলে জানিয়েছে সংগঠনটি।
ই-ক্যাবের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল ওয়াহেদ তমাল বলেন, ‘গ্রাহক কীভাবে টাকা ফেরত পাবে তা নিয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, স্বরাষ্ট মন্ত্রণালয়সহ সরকারের সংশ্লিষ্টরা কাজ করছেন। এটি নিয়ে সরকারিভাবে সিদ্ধান্ত হবে। সরকারের পক্ষ থেকে পুরো বিজনেস মডেলটি নিয়েই অনুসন্ধান করা হচ্ছে। এখানে আমাদের আর কোনো হাত নেই। তবে এই পক্রিয়াটি যেন দ্রুত হয়, আমরা সেদিকে জোর দিচ্ছি।’
এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘ই-ক্যাবের পক্ষ থেকে আমরা সেন্ট্রাল কমপ্লেইন ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম করার কথা বলেছি। গ্রাহকরা যেন একই জায়গায় অভিযোগ জানাতে পারেন, সেটি নিশ্চিত করতে পারলে জানা যাবে কার ক্ষতি কতটা হয়েছে, প্রকৃত ক্ষতির অবস্থান। আমাদের পক্ষ থেকে খাতটিকে শৃঙ্খলায় ফেরাতে বেশ কিছু প্রস্তাবনা দিয়েছি। কিন্তু গ্রাহকের টাকা ফেরত দিতে সাংগঠনিকভাবে আমাদের হাতে এখন আর কিছু করার নেই।’
মন্তব্য জানতে চাইলে বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেসের (বেসিস) সিনিয়র সহসভাপতি ফারহানা এ রহমান বলেন, ‘গ্রাহক কোনো টাকা ফেরত পাবে না। সাধারণ মানুষ বিভিন্নভাবে প্রতারিত হচ্ছে। কিন্তু ই-কমার্স বলে খাতটিকে কেবল নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করা হচ্ছে। ই-ভ্যালি বা ই-অরেঞ্জ পুরো ই-কমার্স খাতকে প্রতিনিধিত্ব করে না।
আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকেও বুঝতে সময় লেগেছে এখানে কী হচ্ছে। এসব কোম্পানি শুধু অফার দিয়েছে। ৫০ থেকে ৬০ শতাংশ ছাড় দিয়েছে। সবার চোখের সামনেই এগুলো ঘটেছে। তখনই সবার বোঝা দরকার ছিল। কারও বন্ধু বাইক বা অন্য কোনো পণ্য কম টাকায় পেয়েছে, বন্ধুর ওপর নির্ভর করে বিনিয়োগ করে ফেলেছি, এটি উচিত হয়নি।
১ লাখ টাকার পণ্যে ৫০ শতাংশ ছাড় দিলে বাকি ৫০ হাজার টাকা কোথা থেকে আসছে, তা আমাদের ভাবা দরকার ছিল। ডেসটিনি, যুবক এ দেশে প্রতারণা করেছে। তাদের গ্রাহকরা এখনো টাকা ফেরত পায়নি। বাংলাদেশে কোনো কোম্পানি প্রতারণা করলে গ্রাহক আর সাধারণত সেই টাকা ফেরত পায় না। এক্ষেত্রেও সেই শঙ্কাই রয়েছে। কিন্তু এ দায় কোনোভাবেই ই-কমার্স খাতের নয়। ই-কমার্স এখন জীবনের অংশ। বরং প্রতারিত না হতে গ্রাহকদেরই সচেতন হওয়া প্রয়োজন।’
ই-কমার্স বিষয়ে সম্প্রতি সচিবালয়ে এক সভা শেষে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশী বলেছেন, ‘তারা (ইভ্যালি) পেমেন্ট ব্যাক করবে, তাদের তো সেই অ্যাবিলিটিটাই (সামর্থ্য) নেই এখন। হয় তারা (ইভ্যালি) টাকা সরিয়ে নিয়েছে, না হলে অপ্রয়োজনীয় খাতে খরচ করেছে।’
এমন পরিস্থিতিতেও অবশ্য ক্ষতিগ্রস্ত গ্রাহকদের জন্য কিছু সম্ভাবনার কথা বলছেন কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) ভাইস প্রেসিডেন্ট এস এম নাজের হোসাইন।
তিনি বলেন, ‘ভোক্তা ক্ষতিগ্রস্ত হলে বিদ্যমান আইনেই ক্ষতিপূরণ পাওয়ার অধিকার রয়েছে। কিন্তু আদালত থেকে কোনো রায় এলে এবং কোনো কারণে ওই কোম্পানিগুলোর অ্যাকাউন্ট জব্দ করা হলে গ্রাহকের অর্থ ফেরত পেতে সমস্যা হবে। আর কোম্পানিগুলোর যদি কোনো অর্থ না থাকে, তাহলে সরকারকে তার দায়-দায়িত্ব নিতে হবে।
কোম্পানিগুলো সরকারের কাছ থেকে লাইসেন্স নিয়েছে, ই-ক্যাবের সদস্য পদ নিয়েছে। এক্ষেত্রে তাদেরও দায়িত্ব রয়েছে। যদিও ই-ক্যাব বলছে কোম্পানিগুলোকে শোকজ করা হয়েছে। এটিই যথেষ্ট নয়। এই মুহূর্তে ক্ষতিগ্রস্ত গ্রাহকদের দায়িত্ব কেউ নিচ্ছে না- এটাই সমস্যা। কিন্তু বিদ্যমান আইনেই ভোক্তাদের ক্ষতিপূরণ পাওয়ার অধিকার রয়েছে। এক্ষেত্রে সরকারকে আরও দায়িত্বশীল হতে হবে।’
সূত্র: সারাবাংলা ডট নেট