হাইকোর্টের আদেশের পরই সুদের পাঁচ কারবারি আটক

দেশজুড়ে অবৈধভাবে সুদের যে ব্যবসা, তা ছড়িয়েছে অনলাইনেও। এই ধরনের বিজ্ঞাপনের ছড়াছড়ি ফেসবুকসহ সামাজিক মাধ্যমগুলোতে।

বিকেলে অনিবন্ধিত বা অনুমোদিত সুদ কারবারি ব্যক্তি এবং প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিক আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেয় উচ্চ আদালত। এরপরই পাঁচজনকে আটক করে গোয়েন্দা পুলিশ। তারা অনলাইনে বিভিন্ন অ্যাপসের মাধ্যমে সুদের কারবার করতেন।

উচ্চ আদালত থেকে নির্দেশের কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই অবৈধ সুদ কারবারিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া শুরু হয়েছে।

অ্যাপসভিত্তিক অবৈধ সুদের ব্যবসা পরিচালনাকারী ও অনলাইন প্রতারকচক্রের পাঁচজনকে আটক করেছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)।

বুধবার রাতে এ তথ্য জানিয়েছেন ডিএমপির মিডিয়া এন্ড পাবলিক রিলেশনস বিভাগের উপ কমিশনানর ফারুক হোসেন।

তবে গ্রেপ্তার ব্যক্তিদের নাম পরিচয় জানাননি তিনি। আগামীকাল দুপুর ১২টায় ডিএমপি মিডিয়া সেন্টারে সংবাদ সম্মেলনে বিস্তারিত জানাবেন ডিবির প্রধান এ কে এম হাফিজ আক্তার।

বিকেলে অনিবন্ধিত বা অনুমোদিত সুদ কারবারি ব্যক্তি এবং প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিক আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দিয়েছে উচ্চ আদালত। বিচারপতি আবু তাহের মো. সাইফুর রহমান ও বিচারপতি জাকির হোসেনের হাইকোর্ট বেঞ্চ এ বিষয়ে লিখিত আদেশ দেয়।

এতে অনিবন্ধিত বা অননুমোদিত আর্থিক প্রতিষ্ঠান, ক্ষুদ্র ঋণদানকারী প্রতিষ্ঠানের কর্মকাণ্ডের বিষয়ে তদন্ত করতে একটি বিশেষ কমিটি গঠনে জন্য বাংলাদেশ ব্যাংককে নির্দেশনা দেয়া হয়।

তদন্তকালীন সময়ে কোনো অননুমোদিত বা লাইসেন্সবিহীন প্রতিষ্ঠান পাওয়া গেলে তাৎক্ষণিক সেগুলো বন্ধ করে আইনগত ব্যবস্থা নিতেও বলা হয়।

চড়া সুদে ঋণদানকারী স্থানীয় মহাজনদের তালিকা দিতে মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটিকেও নির্দেশ দেয়া হয়।

উচ্চ আদালত এই আদেশ দিয়েছে আলোচিত আইনজীবী ব্যারিস্টার সৈয়দ সায়েদুল হক সুমনের একটি রিট আবেদনের পর। উচ্চ আদালতের আদেশের কয়েক ঘণ্টার মধ্যে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে তিনি বেশ খুশি।

নিউজবাংলাকে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় সুমন বলেন, ‘এই অর্ডারটা যদি ৫ বা ১০ বছর আগে নিয়ে আসা যেত এবং আইন শৃঙ্খলা বাহিনী যদি এমন তৎপর হতো, তাহলে যুবক, এহসান গ্রুপ, ইভ্যালির মতো প্রতিষ্ঠানের জন্ম হতো না। জন্ম হলেও এতো বড় হতো না।

তিনি বলেন, ‘আদালতের অর্ডারটা যদি ঠিকমতো বাস্তবায়ন হয়, তাহলে অনিবন্ধিত সুদকারবারিদের নিয়ন্ত্রণহীন যন্ত্রণা থেকে মানুষ মুক্তি পাবে। এ ধরনের কারবার ভবিষ্যতের জন্য থেমে যাবে।’

জনগণের কাছ থেকে কারা আমানত সংগ্রহ ও ঋণ দিতে পারবে এবং ঋণের সর্বোচ্চ সুদহার কত হবে, সেটি আইন দ্বারা নির্দিষ্ট। কিন্তু এর বাইরে বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান মানুষকে ঋণ দিয়ে উচ্চ হারে সুদ আদায় করে থাকে।

হাইকোর্টের আদেশের পরই সুদের পাঁচ কারবারি আটক
ঋণ দিতে অনলাইনে ছড়ানো বেশি কিছু বিজ্ঞাপন। তবে এভাবে ঋণ দেয়ার কোনো বৈধতা নেই

ব্যাংক খাতে ক্রেটিড কার্ড ছাড়া এখন বার্ষিক সর্বোচ্চ সুদ হার ৯ শতাংশের মধ্যে। তবে সুদ কারবারিরা মাসে ১০ শতাংশ বা তার চেয়ে বেশি হারে সুদে ঋণ দিয়ে থাকেন।

এই ঋণের বিপরীতে জমি বা বাড়িঘরের দলিল বা অন্য মূল্যবান সম্পদ বন্ধক রাখা হয়। টাকা দিতে না পারলে প্রায়ই সেগুলো দখল করে নেয়ার অভিযোগ আসে গণমাধ্যমে। সুদের টাকা দিতে না পেরে আত্মহত্যার ঘটনাও বিরল নয়।

এমন একটি ঘটনা প্রত্যক্ষ করার পর গত ৭ সেপ্টেম্বর সুদের কারবারিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হাইকোর্টে রিট করেন ব্যারিস্টার সুমন।

এরপর যারা অবৈধভাবে সুদ ব্যবসা করে, তাদের তালিকা প্রণয়ন করে তা বন্ধ করতে গত ২৭ সেপ্টেম্বর আদেশ দিয়েছিল আদালত।

তবে সুদের কারবার ছড়িয়েছে অনলাইনেও। জামানত ছাড়াই উচ্চ সুদে ঋণ দেয়ার বিজ্ঞাপন ঘুরে বেড়াচ্ছে ফেসবুকসহ বিভিন্ন অনলাইন মাধ্যমে।

ভার্চুয়াল মাধ্যমে ফেসবুক আইডি কিংবা ইনস্টাগ্রামে অ্যাকাউন্ট খুলেই ঋণ দেয়ার প্রলোভন দেখানো হচ্ছে। টাকায়ালা, ক্যাশম্যান, এসম্যানেজার, ইনস্ট্যান্ট স্যালারি ডটকম, ক্যাশক্যাশসহ আরও বেশ কয়েকটি ভার্চুয়াল প্রতিষ্ঠানের নামে ঋণ দেয়ার আগ্রহ প্রচার করা হচ্ছে।

অবৈধ সুদের কারবারিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার দাবি জানিয়ে হাইকোর্টে রিট করেছেন আলোচিত আইনজীবী ব্যারিস্টার সায়েদুল হক সুমন

এ ক্ষেত্রে মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণে ফুটিয়ে তোলা হচ্ছে নানা গ্রাফিক্যাল উপস্থাপনা। টাকার ছবি দিয়ে গ্রাফিক্স ছাড়াও অডিও-ভিজ্যুয়াল বিজ্ঞাপনও দিচ্ছেন কেউ কেউ।

চটকদার নানান কথায় মানুষের আস্থা অর্জনে সচেষ্ট এসব অ্যাপ ও আইডি। বলা হচ্ছে, কাগজবিহীন আবেদন করা যাবে। কোনো ক্রেডিট ইতিহাসের প্রয়োজন নেই। স্বল্প ও যথাসময়ে ঋণ পর্যালোচনা করার আশ্বাসও দেয়া হচ্ছে। এমনকি ১০ মিনিটেও ঋণ পৌঁছানোর প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে কেউ কেউ।

কত টাকা ঋণের প্রলোভন

২ হাজার টাকা থেকে শুরু করে কেউ দিতে চায় ২০ হাজার টাকা, কেউ ৩০ হাজার টাকা। আবার কেউ কেউ বেতনের সমান ঋণ দেয়ার আগ্রহ দেখাচ্ছে। তিন থেকে ছয় মাসের মধ্যে ঋণ পরিশোধের শর্ত জুড়ে দেয়া হচ্ছে। সুদ কোনো কোনো ক্ষেত্রে ২০ শতাংশ।

‘ক্যাশমান’ আইডি থেকে বলা হচ্ছে, ২ হাজার টাকা ঋণ নিলে তিন মাসে দিতে হবে ২ হাজার ৩৫ টাকা। ৫ হাজার টাকায় ৪ মাসে দিতে হবে ৫ হাজার ৯৫ টাকা। ৮ হাজার টাকায় ৫ মাসে ৮ হাজার ১২৫ টাকা। আর ১০ হাজারে ৬ মাসে গুনতে হবে ১০ হাজার ২৬৫ টাকা।

‘টাকায়ালা’ আইডিতে বলা হচ্ছে, ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত ঋণ দেয়া হবে। সে ক্ষেত্রে মাসিক সুদহার ২ দশমিক ৯৪ ভাগ। প্রসেসিং ফি মোট ঋণের ৫ ভাগ। সময়কাল ৯২ থেকে ১২০ দিন। ঋণ পেতে হলে বয়স হতে হবে ১৮ বছরের বেশি। বছরে সুদহার বা এপিআর হবে ২০ ভাগ।

‘ইনস্ট্যান্ট স্যালরি ডটকম’ সাইট থেকে ঋণ দেয়ার ক্ষেত্রে বলা হচ্ছে, চাকরিজীবীদের জন্য সুদহীন ও জামানতমুক্ত ঋণ সুবিধা দিচ্ছে তারা।

রেজিস্ট্রেশনের জন্য এটি ঋণগ্রহীতার কাছ থেকে নাম, ফোন নম্বর, ই-মেইল ঠিকানা চায়। ঋণের জন্য আবেদন করতে ছবি, জাতীয় পরিচয়পত্র, ই-টিন, কোম্পানি আইডি, ভিজিটিং কার্ডের ছবি, স্যালারি স্টেটমেন্ট, কোম্পানি পে-স্লিপ, সিনিয়র গ্যারান্টর বা ইন্ট্রোডিউসারের জাতীয় পরিচয়চত্র, ভিজিটিং কার্ড ও মোবাইল নম্বর চাওয়া হচ্ছে।

‘ক্যাশক্যাশ’ সাইটে বলা হচ্ছে, ৫ হাজার টাকা ঋণে দিতে হবে ৫ হাজার ৫০ টাকা, ৮ হাজার টাকায় ৮ হাজার ১০০ টাকা, ১০ হাজার টাকা নিলে শোধ করতে হবে ১০ হাজার ১৫০ টাকা।