মহামারি করোনা পরিস্থিতিতে দীর্ঘদিন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় টাঙ্গাইলে বাল্যবিয়ের শিকার হয়েছে প্রায় ৫ হাজার ছাত্রী।
তবে জেলা শিক্ষা অফিস সূত্র জানায়, কাগজ-কলমে জেলাটিতে বাল্যবিয়ের শিকার হয়েছে ১ হাজার ২৪২ জন।
তবে সংখ্যাটি প্রায় ৫ হাজার। এদের মধ্যে অনেকেই বিয়ের পরও নিয়মিত ক্লাস করছে। বেশি বাল্যবিয়ের সংখ্যা জেলা শিক্ষা অফিসকে জানালে স্কুলের সমস্যা হতে পারে মনে করে সংখ্যা কমিয়ে দিয়েছে স্কুল কর্তৃপক্ষ।
সূত্রটি জানায়, জেলায় ৭৯৬টি মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও মাদরাসা এবং কলেজ রয়েছে। জেলার ১২টি উপজেলায় করোনাকালে ১ হাজার ২৪২ জন শিক্ষার্থী বাল্যবিয়ের শিকার হয়েছে। এর মধ্যে টাঙ্গাইল সদরে ৮৮, সখিপুরে ১৪৩, ঘাটাইলে ৪৯, গোপালপুরে ৫৬, ভূঞাপুরে ১৪, কালিহাতীতে ২২৯, দেলদুয়ারে ২২৮, বাসাইলে ৪৪, নাগরপুরে ১১৪, মির্জাপুরে ৬, মধুপুরে ১১৮ ও ধনবাড়ী উপজেলায় ১৫৩ জন।
শিক্ষা অফিস তথ্য অনুয়ায়ী, সদর উপজেলায় ৮৮ জন দেখালেও এ উপজেলার চরাঞ্চলের হুগড়া হাবিব কাদের উচ্চ বিদ্যালয়ের ৬০ জন ছাত্রী, মগড়া উচ্চ বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে ৩০ জন, পাকুল্যা উচ্চ বিদ্যালয়ে ২২ জন, চৌধুরী মালঞ্চ উচ্চ বিদ্যালয়ে ১৫ জন, খাস কাকুয়া উচ্চ বিদ্যালয়ে ১৩ জন ছাত্রীর বাল্যবিয়ে হয়েছে। এছাড়াও টাঙ্গাইল সদর উপজেলায় আরও অর্ধশত স্কুল রয়েছে।
অন্যদিকে, ভূঞাপুর উপজেলায় বাল্যবিয়ের শিকার ১৪ জন দেখালেও চরাঞ্চল গাবসারা ইউনিয়নের রায়ের বাসালিয়ার কুলসুম জামান উচ্চ বিদ্যালয়ের ১৮ জন, চরগাবসারা দাখিল মাদরাসার ৩০ জন, টেপিবাড়ী উচ্চ বিদ্যালয়ের ২৫ জন, গোবিন্দাসী উচ্চ বিদ্যালয়ের ২ শ্রেণিতে ২৫ জন ও রুহুলী উচ্চ বিদ্যালয়ে অন্তত ৪০ জন ছাত্রী বাল্যবিয়ের শিকার হয়েছে। উপজেলার অন্যসব স্কুলের চিত্র একই রকম। জেলার অন্যসব উপজেলার প্রতিটি স্কুলের চিত্র এ দু’টি উপজেলার মতো হবে। তাতে জেলায় কয়েক হাজার ছাত্রী বাল্যবিয়ের শিকার হয়েছে।
শিক্ষকরা জানান, করোনাকালে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ থাকায় অভিভাবকরাও তাদের সন্তানদের নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তিত ছিলেন। এর মধ্যে ভালো ছেলে পেয়ে অনেকেই তাদের মেয়ের বিয়ে দিয়ে দিয়েছেন। বিষয়টি বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে অবহিত করা হয়নি। বিয়ে ভেঙে যাওয়ার ভয়ে তারা শিক্ষকদের কিছু জানায়নি। তবে বাল্যবিয়ের শিকার অনেক শিক্ষার্থীই বিদ্যালয়ে নিয়মিত অ্যাসাইনমেন্ট জমা দিয়েছে এবং পড়াশোনা করছে। বাল্যবিয়ে বন্ধে প্রশাসনের জোড়ালো পদক্ষেপ এবং এর কুফল সম্পর্কে জনসচেতনতা বাড়াতে পারলে বাল্যবিয়ের সংখ্যা কমে আসবে।
কয়েকজন অভিভাবক জানান, তারা দরিদ্র মানুষ। ভালো পাত্র পেয়েছেন, তাই তাদের মেয়েদের বাল্যবিয়ে দিয়েছেন।
হুগড়া হাবিব কাদের উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শামীম আল-মামুন জানান, গত বছর মার্চে স্কুল বন্ধ হয়ে যায়। দীর্ঘদিন শিক্ষার্থীদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ ছিল না। গত ১২ সেপ্টেম্বর স্কুল খোলার পর অষ্টম-দশম শ্রেণির অনেক শিক্ষার্থী অনুপস্থিত রয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, অনুপস্থিত ছাত্রীদের মধ্যে প্রায় ৬০ জনের বাল্যবিয়ে হয়েছে। স্কুলটি চরাঞ্চলে হওয়ায় এলাকায় বাল্যবিয়ের প্রবণতা আগে থেকেই ছিল। বিদ্যালয় খোলা থাকলে ছাত্রীদের বিয়ের উদ্যোগ বন্ধ করতেন শিক্ষকরা। অভিভাবকদের সঙ্গে যোগাযোগ করে ১৮ বছরের আগে মেয়েকে বিয়ে না দিতে উদ্বুদ্ধও করতেন। কিন্তু, করোনা পরিস্থিতিতে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন থাকায় বাল্যবিয়ে ঠেকানো যায়নি।
মানব প্রগতি সংঘের নির্বাহী পরিচালক মানবাধিকার কর্মী মাহমুদা শেলী বলেন, শিক্ষা অফিসের তথ্য অনুযায়ী জেলায় বাল্যবিয়ের শিকার হয়েছে ১ হাজারের বেশি ছাত্রী। বাল্যবিয়ের শিকার এসব ছাত্রীদের চিহ্নিত করে স্কুলে ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। এছাড়াও কম বয়সী মেয়েদের যারা বিয়ের রেজিস্ট্রি করিয়েছেন, সেসব নিকাহ রেজিস্ট্রারদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনা প্রয়োজন।
এদিকে বাল্যবিয়ের শিকার শিক্ষার্থীদের শ্রেণি কক্ষে ফিরিয়ে আনা হবে বলে জানান জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা লায়লা খানম। তবে বাল্যবিয়ের গড়মিল হিসাবের কোনো সুনির্দিষ্ট কারণ জানাতে পারেননি তিনি।
টাঙ্গাইল জেলা প্রশাসক (ডিসি) ড. আতাউল গনি জানান, করোনা রোধে সবাই ব্যস্ত ছিলাম। এ সুযোগে চরাঞ্চলের অসচেতন অভিভাবকরা তাদের স্কুলপড়ুয়া মেয়েদের বিয়ে দিয়েছেন, যা দুঃখজনক। তবে ওইসব শিক্ষার্থী যাতে আবার ক্লাসে আসতে পারে, সে ব্যবস্থা করা হবে। বাল্যবিয়ের কুফলসহ প্রতিরোধে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে জনসচেতনামূলক সভাও করা হবে।