দেশের একমাত্র বিশেষায়িত মানসিক রোগ নিরাময় কেন্দ্র ‘পাবনা মানসিক হাসপাতাল’। নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে কালের সাক্ষী হয়ে চিকিৎসাসেবা দিয়ে যাচ্ছে বিশেষায়িত হাসপাতালটি। প্রতিষ্ঠার পর ভিন্ন ভিন্ন পরিবর্তনের ছোঁয়া এলেও নানা সমস্যার কারণে কাঙ্ক্ষিত চিকিৎসাসেবা থেকে বঞ্চিত ভুক্তভোগীরা। এক্ষেত্রে হাসপাতাল প্রশাসন, চিকিৎসক ও কর্মকর্তা-কর্মচারী সংকটের বিষয়টি বার বার প্রাধান্য পেয়েছে।
হাসপাতালে ঘুরে দেখা যায়, ৩০০ রোগী ও তাদের স্বজনদের আনাগোনা রয়েছে হাসপাতাল ক্যাম্পাসের আউটডোরে। পুরাতন জীর্ণশীর্ণ কয়েক কক্ষবিশিষ্ট একটি ভবনে চলছে প্রাথমিক রোগী বাছাই ও জরুরি চিকিৎসাসেবা কার্যক্রম। বৃষ্টি বা ঝোড়ো হাওয়ায় আগত রোগী ও তার স্বজনদের আশ্রয়ের জন্য নির্ধারিত কোনো জায়গা নেই।
রোগীর স্বজনদের দাবি, অল্প জায়গায় লোক সমাগম বেশি হওয়ায় করোনা সংক্রমণের ঝুঁকি নিয়ে আমরা উদ্বিগ্ন। গাদাগাদি, ঠাসাঠাসিতে ভয়ঙ্কর পরিবেশ তৈরি হয়। সেইসঙ্গে রয়েছে ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধিদের দৌরাত্ম্য।
বিভিন্ন জেলা থেকে আসা রোগীর স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, রোগী দেখাতে এসে তারা এখানে নানা হয়রানির শিকার হন। শহরের পৈলানপুর থেকে কাশিপুর মোড় এবং হাসপাতালের মেইন গেটের ভেতর পর্যন্ত রয়েছে দালালদের দৌরাত্ম্য। এই দালালদের সঙ্গে সখ্যতা রয়েছে স্থানীয় অটোবাইক চালক ও আনসার সদস্যদের।
হাসপাতালের নারী ওয়ার্ডে কথা হয় নেত্রকোনার রোখসানা খাতুনের (৩৬) সঙ্গে। তিনি বলেন, নার্সরা আন্তরিক। তারা আমার বাবা-মা, ভাই-বোনের মতো। তবে তিনি সুস্থ হলেও পরিবার ফেরত নিচ্ছে না।
যশোরের সাবিনা ইয়াসমিন (৪১) গুছিয়ে সুন্দরভাবে কথা বলেন। তিনি বলেন, বিজ্ঞান বিভাগ থেকে আমি ইন্টার পাস করেছি। একটু সমস্যার জন্য ডাক্তার দেখাতে এসে তার পরিবার রেখে গেছে।
পুরুষ ওয়ার্ডে কথা হয় পাবনার মোক্তাহিদের (২২) সঙ্গে। তার কাছে নার্স, সেবা সব কিছুই ভালো লেগেছে। কিন্তু তাকে কেন আটকে রাখা হয়েছে এটাই তার প্রশ্ন। সে বাড়ি ফিরতে চায়।
পুরুষ ওয়ার্ডের নার্সিং সুপারভাইজার আব্দুল কাদের বলেন, ওয়ার্ডে পুরুষ নার্সের বেশ সংকট রয়েছে। ফলে রোগীরা কাঙ্ক্ষিত সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। পুরুষ রোগীদের সব কাজ তো নারী নার্স দিয়ে করানো সম্ভব নয়। তাছাড়া মেয়ে রোগীর চেয়ে ছেলে রোগী কিছুটা আক্রমণাত্মক। নারী নার্সরা এগিয়ে যেতে সাহস পান না।
মানসিক রোগীদের চিকিৎসার সঙ্গে জড়িত একাধিক চিকিৎসক বলেন, আউটডোরে জরুরি বিভাগে রোগী দেখার সময় খবর আসে ইনডোরে রোগীর খারাপ অবস্থা। তখন আউটডোরের রোগী দেখা বাদ দিয়ে ইনডোরে এলে অনেকটা চাপের মধ্যে পড়তে হয়। অল্প চিকিৎসক দিয়ে সন্তোষজনক চিকিৎসাসেবা দেওয়া সম্ভব নয়।
দেশের একমাত্র বিশেষায়িত মানসিক হাসপাতালটি কনসালট্যান্ট ও ক্লিনিক্যাল সাইকিয়াট্রিস্ট ছাড়াই চলছে। বর্তমানে হাসপাতালের ৩০ জন চিকিৎসকের মধ্যে ১৭ জনের পদই শূন্য। দ্বিতীয় শ্রেণির ৩১৬টি পদের মধ্যে শূন্য রয়েছে ৪১টি, তৃতীয় শ্রেণির ১১৯টির মধ্যে ৩১টি এবং চতুর্থ শ্রেণির ১৭০টি পদের মধ্যে ৯৮টি শূন্য রয়েছে।
আবাসিক মেডিকেল কর্মকর্তা, অ্যানেসথেটিস্ট, ক্লিনিক্যাল প্যাথলজিস্ট, বায়োকেমিস্ট, ডেন্টাল সার্জনের মতো গুরুত্বপূর্ণ চিকিৎসক ছাড়াই চলছে হাসপাতালের কার্যক্রম।
মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ আবাসিক সাইকিয়াট্রিস্ট মো. মাসুদ রানা সরকার জানান, পর্যাপ্ত চিকিৎসক প্রয়োজন। অথচ তিনজন সাইকিয়াট্রিস্ট দিয়ে এই হাসপাতালের চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।
আবাসিক মেডিকেল অফিসার ডা. শাহীন রেজা বলেন, ৫০০ শয্যার বিশেষায়িত হাসপাতাল হলেও অনেক সংকট রয়েছে। এই সংকটের মধ্যেই আমরা সমস্যা নিরূপণ করে প্রয়োজনীয় চিকিৎসাসেবা দেওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।
মানসিক হাসপাতালের নার্সিং সুপারিনটেনডেন্ট রেহেনা আলম জানান, নার্সিং সুপারভাইজার পাঁচজন হওয়ায় চিকিৎসাসেবা দেওয়া কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। হাসপাতালে ১৩টি পুরুষ ওয়ার্ড আছে। সেক্ষেত্রে পুরুষ নার্সিং কর্মকর্তা খুবই কম। এ অবস্থায় পুরুষ ওয়ার্ডগুলোর রোগীদের নারী নার্সিং কর্মকর্তাদের মাধ্যমে সেবা দেওয়া হয়, যা খুবই দুঃসাধ্য ও ঝুঁকিপূর্ণ। এজন্য ঝুঁকি ভাতা দেওয়া হয় না। সরকার যদি ঝুঁকি ভাতা দিত, তাহলে নার্সরা কাজে উৎসাহ পেত।
পাবনা মানসিক হাসপাতালের পরিচালক ডা. আবুল বাশার মোহা. আসাদুজ্জামান বলেন, সমৃদ্ধ হাসপাতাল গড়ার চেষ্টা করছি। মানসিক হাসপাতাল সাধারণ হাসপাতালের মতো নয়। এখানকার চিকিৎসাপদ্ধতি আলাদা। ফলে জনবল বেশি প্রয়োজন হয়। কিন্তু জনবল-সংকট এখন প্রকট। অনেক কাজই সঠিকভাবে সম্পন্ন করা সম্ভব হচ্ছে না।
হাসপাতালে দালালদের দৌরাত্ম্যের বিষয়ে তিনি বলেন, আমরা অনেক বলেছি। কাজ হয় না। আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে বিষয়টি জানানো হয়। তারা মাঝে মধ্যে অভিযান চালিয়ে দালালদের আটক করলেও রাজনৈতিক তদবির, স্থানীয় আধিপত্য আর প্রভাবশালীদের কারণে ছেড়ে দেওয়া হয়। দালাল নির্মূলে জেলা প্রশাসন ও পুলিশ প্রশাসনসহ আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কঠোর হস্তক্ষেপ চান তিনি।