দীর্ঘদিন ধরে নানা অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনায় চলছে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক ও ইতালিতে পরিচালিত জনতা ব্যাংকের জনতা একচেঞ্জ হাউজ। ফলে ধারাবাহিক লোকসান গুণতে হচ্ছে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন এ ব্যাংককে। লোকসানে থাকা এ দুই দেশের একচেঞ্জ হাউজের কার্যক্রম বন্ধের সুপারিশ করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
সম্প্রতি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের বাৎসরিক সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) স্বাক্ষরকালে বিষয়টি নিয়ে বিশেষ আলোচনা হয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্র ও ইতালিতে পরিচালিত জনতা ব্যাংকের জনতা একচেঞ্জ হাউজ বছরের পর বছর লোকসান করছে। তাই এগুলোর কার্যক্রম বন্ধ করার সুপারিশ করা হয়। এমওইউর বৈঠকে খেলাপি কমানোর পাশাপাশি লোকসানি শাখাও কমিয়ে আনতে বিশেষ নির্দেশনা দেন গভর্নর ফজলে কবির। সভায় আরো উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর, চার ব্যাংকের এমডি, নির্বাহী পরিচালক, পর্যবেক্ষক ও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
জনতা ব্যাংক ও সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে জনতা এক্সচেঞ্জ কোম্পানি (জেইসিআই, ইউএসএ নামে পরিচিত) কার্যক্রম শুরুর পর থেকেই বিভিন্ন অনিয়মে জড়িয়ে পড়েছে। ২০১৫ সালের ১ সেপ্টেম্বর কার্যক্রম শুরু করে নিউইয়র্কে জনতা এক্সচেঞ্জ। প্রতিষ্ঠানটি স্থাপনের খরচ মেটাতে ৫০ হাজার ডলার এবং ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকের চাহিদা অনুযায়ী ৫ লাখ ডলার নেওয়া হয়। এছাড়া স্থাপনা, সফটওয়্যার, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন ও অন্যান্য খরচের জন্য নেওয়া হয় আরো ৩ লাখ ডলার। সব মিলিয়ে প্রতিষ্ঠানটির জন্য খরচ হয় সাড়ে ৮ লাখ ডলার বা ৭ কোটি ২২ লাখ টাকা। এদিকে প্রতিষ্ঠার পর থেকেই হাউসটির প্রবাসী আয় ব্যবস্থাপনায় বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে আসছে। বিদেশে প্রবাসী আয় সংগ্রহ করেও দেশে আসেনি প্রায় ১৮ কোটি টাকা- এমন তথ্য উঠে এসেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনে।
নিউইয়র্কে চেয়ে আরো ভয়াবহ অবস্থা ইতালির জনতা এক্সচেঞ্জের। ২০০২ সালের জানুয়ারিতে এই এক্সচেঞ্জ হাউস ইতালিতে নিবন্ধিত হয়। ওই বছরের জুন থেকে এর কার্যক্রম শুরু হয়। প্রতিষ্ঠানটির রোম ও মিলানে দুটি শাখা রয়েছে। প্রবাসী বাংলাদেশিদের কাছ থেকে রেমিট্যান্স সংগ্রহ করে দেশে পাঠানোই এ এক্সচেঞ্জ হাউসের মূল কাজ।
জনতা ব্যাংক সূত্র জানায়, ২০০২ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত লাভজনক ছিল প্রতিষ্ঠানটি। পরে আয়কর বৃদ্ধি, সীমিত নেটওয়ার্ক, নতুন অ্যান্টি মানি লন্ডারিং আইন, রেগুলেটরি ও কমপ্লায়েন্স বাবদ খরচ বাড়ানোর কারণে ২০০৯ সাল থেকে ক্রমাগত লোকসান দিয়ে আসছে। ২০০৯ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত ১২ লাখ ৭১ হাজার ২৭১ ইউরো লোকসান করেছে। টাকার অংকে লোকসানের এ পরিমাণ ১২ কোটি ৫২ লাখ ২০ হাজার ১৯৩ টাকা। পরে ২০১৫ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত মোট ১১ লাখ ৭৩ হাজার ৯১৬ ইউরো বা ১১ কোটি ৫৬ লাখ ৩০ হাজার ৭২৬ টাকা লোকসান করেছে। ৯ বছরে লোকসান ২৪ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। এখনো লোকসান দিয়ে আসছে ব্যাংকটি। লোকসানের এ ঘাটতি জনতা ব্যাংক সরাসরি নগদ অর্থ দিয়ে মেটাচ্ছে। যাকে বলা হচ্ছে পুনঃভরণ। তাই বছরের পর বছর লোকসানে থাকা এক্সচেঞ্জ হাউসগুলো কার্যক্রম বন্ধ করতে বলেছে নিয়ন্ত্রণ সংস্থা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের মধ্যে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি খেলাপি ঋণ জনতা ব্যাংকের। জুন শেষে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১৩ হাজার ৯৯৩ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ২৩ দশমিক ৫২ শতাংশ। নিরাপত্তা সঞ্চিতি সংরক্ষণ (প্রভিশন) বা শ্রেণিকৃত ঋণের বিপরীতে অর্থ সংস্থানেও ঘাটতিতে বেড়েছে ব্যাংকটির। জুন শেষে জনতা ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতি দাঁড়িয়েছে পাঁচ হাজার ৩৫১ কোটি ৩৬ লাখ টাকা।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র সিরাজুল ইসলাম বলেন, আলোচনা হলেও চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তাই এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করব না। তবে কোনো প্রতিষ্ঠান বন্ধ করতে হলে পর্যালোচনা করতে হয়। দুটি দেশে তাদের এক্সচেঞ্জ হাউজ কেন লোকসান করছে তা দেখা হচ্ছে। কোনো সিদ্ধান্ত হলে তখন জানাতে পারব।