নিজস্ব প্রতিবেদক:
জ্বালানী তেলের দাম বৃদ্ধির যে সিদ্ধান্ত সরকার নিয়েছে তা আমলাতান্ত্রিক সিদ্ধান্ত। এই সিদ্ধান্ত রাজনৈতিক নয় বলে মনে করেন কনজুমারস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)-এর সভাপতি গোলাম রহমান।
তিনি বলেন, জ্বালানী তেলের দাম বাড়ানো হয়েছে। এটা জনজীবনে দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতিতে যে দুর্ভোগ নেমে এসেছে তাকে আরও ঘুনিভুত করবে। এরই মধ্যে তার আলামত শুরু হয়ে গেছে। ‘জ্বালানী তেলের দাম বৃদ্ধি’ আমাদের দৃষ্টিতে ব্যবসায়ীক বিবেচনায় একটি আমলাতান্ত্রিক সিদ্ধান্ত। কিন্তু এখানে প্রয়োজন ছিল রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের।
সোমবার (৮ নভেম্বর) সকাল সাড়ে ১১টায় অনলাইন প্লাটফর্মে জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধি বাতিল এবং মূল্য বৃদ্ধির প্রস্তাব বিইআরসি-তে দাখিলের দাবিতে সংবাদ সম্মেলনে এই মত প্রকাশ করেন তিনি।
কনজুমারস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)-এর উদ্যোগে এই সংবাদ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়।
সামগ্রিক বিষয়ের উপরে টেকনিক্যাল ব্যাখ্যা উপস্থাপন করেন ক্যাব এর জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. এম শামসুল আলম। তিনি তার বক্তব্যে ক্যাবের পক্ষ থেকে বিইআরসি, জ্বালানি সম্পদ বিভাগ, এবং বিপিসির নিকট তিনটি প্রস্তাব তুলে ধরেন।
প্রস্তাবগুলো হলো-
১.সূত্রোক্ত প্রজ্ঞাপনটি বাতিল/প্রত্যাহার/স্থগিত করে মূল্যহার বৃদ্ধিব প্রস্তাবটি বিইআরসি আইনের ৩৪ ধারা মতে বিইআরসি কর্তৃক নিষ্পত্তির লক্ষ্যে বিইআরসিতে পাঠানোর অনুরোধ জানানো হয়েছে।
২.অন্যথায় উক্ত প্রজ্ঞাপন মতে ডিজেল ও কেরোসিনের বৃদ্ধিপ্রাপ্ত মূল্য পুনর্বিবেচনার জন্য বিইআরসিকে অনুরোধ করা হয়েছে। উল্লেখ্য যে, আইনী বিধান মতে মূল্যবৃদ্ধিতে কোন পক্ষ সংক্ষুব্ধ হলে মূল্যবৃদ্ধির আদেশ পুনর্বিবেচনা করার বিধান রয়েছে। উক্ত মূল্যবৃদ্ধি এবং তা পূণর্বিবেচনার এখতিয়ার বিইআরসি।
৩.বিপিসি রাজস্ব চাহিদার অতিরিক্ত ৪৩,৭৩৪.৭৮ কোটি টাকা ভোক্তাদের নিকট থেকে অবৈধভাবে আদায় করেছে। জ্বালানীর মূল্য অস্বাভাবিক বৃদ্ধিতে ভর্তুকি প্রদানের লক্ষ্যে এ-অর্থ দিয়ে এনার্জি প্রাইচ স্ট্যাবিলাইজড ফান্ড গঠনের প্রস্তাব করা হয়েছে। যেমনটি ভোক্তাদের টাকায় গ্যাস উন্নয়ন তহবিল, জ্বালানি নিরাপত্ত তহবিল এবং বিদ্যুৎ উন্নয়ন তহবিল গঠিত হয়েছে।
জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি বাতিল এবং মূল্যবৃদ্ধির প্রস্তাব বিইআরসিতে পাঠানোর দাবিতে ক্যাব’র বক্তব্য
গোলাম রহমান বলেন, ‘জ্বালানী তেলের দাম বৃদ্ধির যে সিদ্ধান্তটি নেয়া হয়েছে তা সুবিবেচিত নয়। ক্যাব’র পক্ষ থেকে আমরা দীর্ঘদিন বলে আসছিলাম, যখন জ্বালানী তেলের দাম কম ছিল, সেসময় যে উদবৃত্ত অর্থ ভোক্তাদের নিকট থেকে গ্রহণ করা হয়েছে, সে অর্থ দিয়ে একটি তহবিল গঠন করা যেত। কিন্তু তখন তা করা হয়নি। বিগত কয়েক বছরে উদবৃত্ত অর্থের পরিমাণ ৪৩ হাজার কোটি টাকারও বেশি। এই অর্থের কিছু অংশ ইতোপূর্বে সরকার ভুর্তকি বা লোন হিসেবে দিয়েছে তা নিয়ে নেয়া হয়েছে। তার পরেও বিপুল অংকের অর্থ সরকারের কোষাগারে জমা হয়েছে।’
তিনি বলেন, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের একটি বিজ্ঞাপন আমি ব্যাখ্যা করে দেখেছি, তাতে বলা হয়েছে বিগত সাড়ে ৫ বছরে সরকারের তহবিলে বিপিসি ১০ হাজারেরও বেশি অর্থ লাভ হিসেবে প্রদান করেছে। অধিকন্ত ৩৩ হাজার কোটি টাকার বিভিন্ন প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। এর সবই ভোক্তাদের থেকে নেয়া অতিরিক্ত অর্থের দ্বারা সম্ভব হয়েছে। গত কয়েক মাসে বিপিসি’র লোকশান হয়েছে এক হাজার একশো’ কোটি টাকার কিছু বেশি। এই প্রেক্ষাপটে সরকারের সাথে একটি বিষয়ে একমত। তা হলো- পৃথিবীর অনেক দেশ বা উন্নত দেশগুলোর মত ও আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের মূল্য ওঠা নামার সাথে সাথে দেশে মূল্য বৃদ্ধি বাড়ার বিষয়টি বাস্তব সম্মত নয়। বিশেষ করে আমার দেশের প্রেক্ষাপটে। তার মূল্য যাতে দীর্ঘ মেয়াদী স্থিতিশীল থাকে এবং অর্থনীতি যাতে গতিশীল থাকে সেজন্য মূল্য নির্ধারণ করার পরে ঘন ঘন পরিবর্তন করা কাম্য নয়। সেজন্য জ্বালানী নিরাপত্তা তহবিল গঠনের প্রয়োজন জরুরী। কারণ জ্বালানী নিরাপত্তা তহবিল গঠন করা হলে ঐ তহবিলের জমানো অর্থ, যার পরিমাণ নূন্যতম ১০ হাজার কোটি টাকা, যা সরকারের কোষাগারে দেয়া হয়েছে। আর বিপিসি যেসব প্রকল্প গ্রহণ করেছে সেগুলোর কথা নাই বা বললাম। তাহলে আজকে এই জ্বালানী পণ্যের দাম বৃদ্ধির প্রয়োজন হতো না।
ক্যাব এর সভাপতি বলেন, আমরা দাবি করছি, তহবিলে যে অর্থ সরকারী কোষাগারে দেয়া হয়েছে সে অর্থ ভোক্তাদের জ্বালানী নিরাপত্তা তহবিলে প্রদান করে মূল্য পূর্বের মত স্থিতিশীল রাখা। যদি রাখা না হয়, তাহলে এর প্রতিফলন ভোক্তাদের জীবনে নানা ক্ষেত্রে পড়বে। এই মহুর্তে বাসের ভাড়া ২৭ শতাংশ বৃদ্ধি করা হয়েছে, লঞ্চের ভাড়া ৩৫ শতাংশ বৃদ্ধি করা হয়েছে। এর প্রতিফলন পড়বে উৎপাদন ব্যয়ে, পরিবহণ ব্যয়ে। আর তার প্রতিফলন পড়বে প্রতিটি নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের বাজারে।
তিনি আরও বলেন, করোনার কারণে মানুষের আয় রোজগার কমেছে, বিশেষ করে নিম্নবিত্ত ও নিম্নমত্ত মানুষের। আর বাজারে শীতের সময় শাক-সবজির যে সহজ লভ্যতা তার থেকেও ভোক্তরা বঞ্চিত হবে বলে আমাদের ধারণা। সার্বিক পরিস্থিতিতে একটি সিজনালী ক্রাইসেস সৃষ্টি হবে যা জীবন যাপন বিপর্যস্ত করে তুলবে।
‘আমি প্রথমেই বলেছি, এটা ব্যবসায়ীক বিবেচনায় নেয়া একটি সিদ্ধান্ত। সরকারের কাজ তো ব্যবসা করা নয়, সরকারের কাজ হলো জনগণের মঙ্গলের জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করা। এক্ষেত্রে সেসব বিষয়ে চিন্তা না করে কেবলমাত্র লোকশান হয়েছে তাই দাম বাড়িয়ে দিলাম। এবং সেই দামের যে প্রতিক্রিয়া হবে তা কিন্তু একেবারেই বিবেচনায় নেয়া হয়নি। এখানে প্রয়োজন ছিল, একটি সুবিবেচিত রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত।’
‘আমরা আশা করবো সরকার সব দিক বিবেচনা করে, সাধারণ মানুষের কল্যাণে, জনস্বার্থে মূল্য বৃদ্ধির আদেশ প্রত্যাহার করবে এবং এই সিদ্ধান্তের পরবর্তীতে বাস ভাড়া বা নৌযান ভাড়া বৃদ্ধির যেসব সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে সেসবও বাতিল করতে হবে। এবং একটি স্থিতিশীল অবস্থায় আমরা সবাই যাতে ফিরে যেতে পারি, ভোক্তারা যাতে সহনীয় মূল্যে তাদের জীবন যাপন করতে পারে, তাদের জীবন মানের যাতে অবক্ষয় না হয় সে ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।’
সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন, ক্যাব-এর সাধারণ সম্পাদক এডভোকেট হুমায়ূন কবীর ভূঁইয়া, ক্যাব-এর ভোক্তা অভিযোগ নিস্পত্তি জাতীয় কমিটির আহবায়ক স্থপতি মোবাশ্বের হোসেন।
আরইউ