ভোক্তাকন্ঠ ডেস্ক: প্রযুক্তির উৎকর্ষের ছোঁয়া প্রায় সবকিছুতেই লাগলেও বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি) চলছে অ্যানালগ পদ্ধতিতেই। এই ডিজিটাল যুগেও তাদের ট্যাঙ্কারের তেল পরিমাপ করা হয় ফিতা আর কাঠি দিয়ে। প্রতিষ্ঠানটির হিসাব-নিকাশেও রয়েছে স্বচ্ছতার অভাব। পরিবহন ও মজুদের সময় সিস্টেম লসের নামে অবাধে তেল চুরি হচ্ছে সিন্ডিকেটের ছত্রছায়ায়। হিসাবের খাতায় নয়ছয় করে হচ্ছে তেল পাচারও। এ যেন আক্ষরিক অর্থেই এক শুভঙ্করের ফাঁকি। খাতসংশ্নিষ্টরা বলছেন, কেবল এসব অব্যবস্থাপনা দূর করতে পারলেই বিপিসি অনেক ভালো অবস্থায় থাকত। লোকসান পোষানোর অজুহাতে ডিজেলের দাম বাড়ানোর প্রয়োজন হতো না। জনগণও স্বস্তিতে থাকত।
কাঠি-সুতায় পরিমাপ: তেল আমদানি করা হয় বড় ট্যাঙ্কারে (মাদার ভেসেল) করে। বহির্নোঙরে থাকা এসব ট্যাঙ্কার থেকে তেল খালাস করে লাইটারেজে করে চট্টগ্রামের পতেঙ্গায় বিভিন্ন ট্যাঙ্কে মজুদের জন্য পাঠানো হয়। এরপর সড়ক, নৌ ও রেলপথে তা পাঠানো হয় দেশের বিভিন্ন ডিপোতে। তবে নৌপথেই বেশি তেল পরিবহন করা হয়। বিভিন্ন ডিপো থেকে পেট্রোল পাম্পে তেল নেওয়া হয় ট্যাঙ্কলরির মাধ্যমে। লাইটারেজ, ডিপোর ট্যাঙ্ক, রেলগাড়ি, ট্যাঙ্কলরিতে তেল নেওয়া বা খালাসের সময় অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এখনও সনাতন পদ্ধতিতে তেল পরিমাপ করা হয়। ট্যাঙ্ক, লাইটারেজ ও লরির রিজার্ভারে সুতা ফেলে বা কাঠের স্কেল দিয়ে তেলের মজুদ পরীক্ষা করা হয়। হাতেগোনা কয়েকটি ট্যাঙ্কে স্বয়ংক্রিয় পরিমাপক পদ্ধতি রয়েছে। বিপিসির সাবেক ও বর্তমান একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।
আড়ালে তেল চুরি: বিপিসির সাবেক একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ জানিয়ে বলেন, তেল উদ্বায়ী পদার্থ। ফলে যত সময় যায় পরিমাণে তা কমতে থাকে। এজন্য একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ সিস্টেম লস নির্ধারণ করা আছে। তেল পরিবহন ও মজুদে প্রকৃতপক্ষে যতটুকু সিস্টেম লস হয় তা বিপিসির নির্ধারিত মাত্রার চেয়ে কমই। আন্তর্জাতিক নিয়মনীতি মেনে সিস্টেম লসের একটি স্ট্যান্ডার্ড নির্ধারণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। তবে একটি সিন্ডিকেটের কারণে তা বাস্তবায়ন করা যায়নি।
সূত্র জানায়, চট্টগ্রাম থেকে সিরাজগঞ্জের বাঘাবাড়ি ডিপোতে নৌপথে তেল পরিবহনের সময় হরিরামপুরের ধুলসুড়া, পাবনার বেড়া এবং রাজাবাড়ীর দৌলতদিয়াঘাট এলাকায় তেল চুরি হয়। নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জে গোদনাইল ডিপো ঘিরে গড়ে উঠেছে চোরাই তেলের চক্র। জেট-ওয়ান, অকটেন, পেট্রোল, ডিজেল, কেরোসিন, ফার্নেস ও জিওবি তেল চুরি করে তা আশপাশেই বিক্রি হচ্ছে। প্রতি মাসে কোটি, কোটি টাকার চোরাই জ্বালানি তেল খোলাবাজারে বিক্রি হয়। ডিপোর গেট থেকে শুরু করে এক কিলোমিটার সড়কের দুই পাশে ছোটো ছোটো দোকান ঘর রয়েছে। ডিপো থেকে বোঝাই করে গন্তব্যে যাওয়ার পথে এসব ঘরের সামনে লরি থামিয়ে তেল চুরি করা হয়। লরিপ্রতি কমপক্ষে চার টিন (প্রায় ৮০ লিটার) তেল চুরি করা হয়। এই ডিপো থেকে দিনে প্রায় ১৩০টি ট্যাঙ্ক লরি তেল বোঝাই করে দেশের বিভিন্ন গন্তব্যে রওনা দেয়। একাধিক ট্যাঙ্ক লরিচালকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ডিপো কর্মকর্তাদের ও তেল পরিমাপকারীকে টাকা দিয়ে তেলের পরিমাণ খাতা-কলমে সঠিক দেখানো হয়। এভাবেই দিনের পর দিন চুরির উৎসব চালু রয়েছে।
বিপিসি চেয়ারম্যান এবিএম আজাদ সম্প্রতি বলেন, পরিবহনসহ বিভিন্ন সময় কিছু সিস্টেম লস হয়। মান ও মাপের ক্ষেত্রে কোনো সময় এদিক-সেদিক হয়। সে ব্যাপারে ব্যবস্থা নেয় বিপিসি। পরিবহনের সময় মাপে কম হলে সংশ্নিষ্ট ট্যাঙ্কার ও লরি মালিকদের ক্ষতিপূরণ দিতে হয়, তাই এতে বিপিসির তেমন ক্ষতি হয় না।
স্বচ্ছতা নেই হিসাবপত্রে: কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক শামসুল আলম বলেন, বিপিসির হিসাব ও অডিট নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে আপত্তি জানিয়ে আসছে অর্থ মন্ত্রণালয়, কম্পট্রলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেলের (সিএজি) কার্যালয় ও আন্তর্জাতিক আর্থিক সংস্থাগুলো। বিদেশি প্রতিষ্ঠান দিয়ে বিপিসির অডিট করানোর জন্য আইএমএফ সরকারকে চাপ দিলেও তা কাজে আসেনি। অর্থ বিভাগ ও জ্বালানি বিভাগ বিপিসিতে সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য বারবার তাগিদ দিলেও লাভ হয়নি। সংস্থাটি তাদের খেয়ালখুশি মতো চলছে। তিনি আরও বলেন, বছরে হাজার হাজার কোটি টাকার লেনদেন হলেও এতে স্বচ্ছতা নেই। লাভ-লোকসানের অস্বচ্ছ হিসাব দেখিয়ে হুট করে ডিজেলের দাম বাড়িয়ে নিল বিপিসি। আইন অনুসারে জ্বালানি তেলের দাম নির্ধারণ করার কথা এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের। কিন্তু বিপিসি কখনোই কমিশনের আওতায় আসেনি। ক্যাবের পক্ষ থেকে বারবার চিঠি দেওয়া হলেও এ বিষয়ে জ্বালানি বিভাগ কোনো উদ্যোগ নেয়নি। হিসাবে স্বচ্ছতা নেই বলেই প্রতিষ্ঠানটি জনগণের সামনে শুনানিতে অংশ নিতে ভয় পায়।