ভোক্তাকন্ঠ ডেস্ক:
করোনা মহামারির প্রথম ঢেউ সামলে ওঠার আগেই সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউ লেগেছিল রফতানি খাতে। তখন রেমিট্যান্সই ঘুরিয়েছিল অর্থনীতি চাকা। করোনা মোকাবিলায় সরকারের মনোবল বাড়াতেও বড় ভূমিকা রেখেছিল প্রবাসীদের পাঠানো রেকর্ড পরিমাণ অর্থ। অথচ এই সময়টায় সবচেয়ে বেশি ভোগান্তির শিকার হয়েছিলেন প্রবাসী কর্মীরাই।
রেমিট্যান্সের কারণে এর আগে ব্যাংকের তারল্য সংকট দূর হতে দেখা যেত। এবার এর কারণে সরকারের প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়নও সহজ হয়েছে। রেমিট্যান্সের টাকায় তৈরি হয়েছে সহস্রাধিক নতুন উদ্যোক্তা। শক্তিশালী হয়েছে গ্রামীণ অর্থনীতি। রিজার্ভ ছাড়িয়েছে ৪৩ বিলিয়ন ডলার।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, গত অর্থবছরের জুলাই থেকে ডিসেম্বরে রেমিট্যান্সের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৩৭ দশমিক ৬০ শতাংশ। গত বছরের ডিসেম্বরে এসেছিল ২০৫ কোটি ডলার। তার আগের বছরের ডিসেম্বরে এসেছিল ১৫৯ কোটি ১৬ লাখ ডলার। মহামারির মধ্যেই গত অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে ২৬০ কোটি ডলারের রেমিট্যান্স এসেছিল দেশে—যা এযাবৎকালের সর্বোচ্চ।
দেশের প্রবাসী আয়ের সিংহভাগ আসে মধ্যপ্রাচ্য থেকে। চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে (জুলাই-নভেম্বর) রেমিট্যান্স আসে ৮৬০ কোটি ৮৯ লাখ ডলার। যা আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় প্রায় ২১ শতাংশ কম। এর মধ্যে মধ্যপ্রাচ্যের প্রবাসীরা পাঠান ৪৬৬ কোটি ৯৩ লাখ ডলার। যা মোট রেমিট্যান্সের ৫৪ দশমিক ২৪ শতাংশ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরে প্রবাসী আয় পাঠানোর শীর্ষে থাকা ১০টি দেশের মধ্যে রয়েছে সৌদি আরব, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কুয়েত, আরব আমিরাত, কাতার, মালয়েশিয়া, ওমান, ইতালি ও বাহরাইন।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্ট রিসার্চ ইউনিটের (রামরু) জরিপ বলছে—করোনাকালে প্রায় পাঁচ লাখ প্রবাসী কর্মী দেশে ফিরে এসেছেন। বেতন ও অন্যান্য আনুষাঙ্গিকসহ গড়ে ১ লাখ ৭৯ হাজার ৯৮৯ টাকা করে হারিয়েছেন প্রত্যেকে। এদের ৮৫ শতাংশ পুরুষ কর্মী। তারা গড়ে ১ লাখ ৯৪ হাজার টাকা ও নারী কর্মীরা গড়ে ৯৭ হাজার টাকা বেতন হারিয়েছেন।
করোনাকালে বড় ভোগান্তি ছিল ফ্লাইট বন্ধ হওয়া। যে কারণে বিদেশগমনে ইচ্ছুকদের মতো ছুটিতে আসা কর্মীরাও অনিশ্চয়তায় পড়ে যান। এই বছরের ১৪ এপ্রিল থেকে শুরু হওয়া সাত দিনের কঠোর বিধিনিষেধে বন্ধ থাকে আন্তর্জাতিক ফ্লাইট। ওই মুহূর্তে ৫০-৬০ হাজার ভিসা প্রক্রিয়াধীন ছিল। ইস্যু করা ছিল প্রায় ২৫ হাজার টিকিট। এমনকি মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশে কোয়ারেন্টিন বাবদ বুকিং দেওয়া ছিল হোটেল।
স্বাস্থ্যবিধি মেনে চালু হয় সৌদি এয়ারলাইন্সসহ কয়েকটি ফ্লাইট। তখন টিকিট সংকটে পড়েন বিদেশগামী কর্মীরা। সীমিত আসনের বিপরীতে কয়েকগুণ বেশি যাত্রীর চাপ দেখা দেয়। অনেকেই দেশে ফেরার সময় রিটার্ন টিকিট নিয়ে ফেরেন। নির্দিষ্ট সময়ে ফ্লাইট চালু না হওয়ায় রিটার্ন টিকিটের সময়সীমাও শেষ হয়ে যায়। তখন সৌদি আরবে ফেরা নিয়ে বিপাকে পড়তে হয় অনেককে। কর্মস্থলে ফিরতে পারেননি অনেক কর্মী। ততদিনে শেষ হয়ে যায় অনেকের ভিসার মেয়াদ। সৌদি প্রবাসীরা আকামার মেয়াদ বাড়াতে চাইলেও অধিকাংশ নিয়োগদাতা তখন সাড়া দেননি। ব্যাপক আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েন কর্মীরা।
করোনাকালে বাংলাদেশ থেকে অভিবাসন ব্যয়ও বেড়েছে অনেক। বেড়েছে টিকিটের দাম। তবে এর মাঝে কোয়ারেন্টিন খরচ নিয়ে বেশি বিপাকে পড়েছিলেন সৌদি আরবগামী কর্মীরা। পুরো টাকা পরিশোধ করার পরও প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী সেবা ও হোটেল পাননি তারা।
এদিকে আরব আমিরাত সরকার গত ৪ আগস্ট শর্ত দেয়—বিমানবন্দরে র্যাপিড পিসিআর টেস্ট মেশিন না থাকা দেশগুলো থেকে যাত্রী প্রবেশ করতে পারবে না। ওই তালিকায় বাংলাদেশও ছিল। ৬ সেপ্টেম্বর বিমানবন্দরে ল্যাব স্থাপনের নির্দেশ দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরপরও প্রায় মাসখানেক লেগে যায় ল্যাব স্থাপন করে কার্যক্রম শুরু করতে। ল্যাবের দাবিতে বিক্ষোভ-মানববন্ধনও করতে হয়েছে আমিরাত প্রবাসীদের।
জুন-জুলাইতে বিদেশগামী কর্মীদের অগ্রাধিকারভিত্তিতে কোভিড-১৯ টিকা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। তখন রেজিস্ট্রেশনে দেখা দেয় জটিলতা। প্রবাসী কর্মীদের টিকার জন্য সুরক্ষা প্লাটফর্মে ২ জুলাই থেকে রেজিস্ট্রেশন শুরু করে জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো (বিএমইটি)। পরে বিএমইটি চালু করে ‘আমি প্রবাসী’ অ্যাপ। কিন্তু বিএমইটি’র ডাটাবেজে নিবন্ধন ও স্মার্টকার্ড না থাকায় সেখানেও ভোগান্তির শিকার হন প্রবাসী কর্মীরা।
এসব ভোগান্তি নিয়ে জানতে চাইলে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রী ইমরান আহমদ বলেন, ‘যেখানে সম্ভব হয়েছে তড়িৎ কাজ করেছি। সৌদিতে কোয়ারেন্টিনের জন্য ২৫ হাজার টাকা করে ভর্তুকির সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আমি দুবাইতে ছিলাম। সচিবের সঙ্গে কথা বলে সিদ্ধান্ত দিলাম, এটা আমরা বহন করবো।’
ব্র্যাক মাইগ্রেশন প্রোগ্রামের প্রধান শরিফুল হাসান বলেন, ‘প্রবাসী কর্মীদের সমস্যা আগে থেকে কোনোভাবেই ম্যাপিং করতে পারি না যে, অভিবাসন খাতে কোন সমস্যা হতে পারে, সমাধান কী হবে। কর্মীরা যখন অসহায় হয়ে রাস্তায় নামে তখন আমরা সমাধানের পথ খুঁজি। অনেকের ধারণাই এমন যে, কর্মীরা টাকা খরচ করে যাবে, জায়গা-জমি বিক্রি করে যাবে। দুর্ভোগ, ভোগান্তি সব তাদের ওপর দিয়ে যাবে। এমন যদি হয় তবে আমাদের নীতি নির্ধারকদের কাজটা কী?’