মাদারীপুর জেলা প্রতিনিধি:
মাদারীপুর জেলাসহ পাশের গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়া ও শরীয়তপুরের নড়িয়া এলাকার ১৫৭ যুবক লিবিয়ার একটি জেলখানায় বন্দি জীবন যাপন করছেন। দালালের হাতে লাখ লাখ টাকা দিয়ে সর্বস্বান্ত এখন তাদের পরিবার। টাকা গেলেও ফিরে পেতে চান প্রিয়জন ও স্বজনদের। তাই দেশে ফিরিয়ে আনতে কয়েক দফা মানববন্ধন করে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করেছে তাদের পরিবার।
এদিকে অবৈধ পথে বিদেশ যাওয়ার প্রবণতা বেড়ে গেছে। এতে মাদারীপুর জেলাজুড়ে বেড়েছে দালালদের দৌরাত্ম্যও। বিদেশ নেওয়ার কথা বলে অভিনব পন্থায় ধাপে ধাপে কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে দালাল চক্র। তাদের খপ্পরে পড়ে শুধু অর্থ নয়, প্রাণও দিতে হচ্ছে বিলাসী জীবনের স্বপ্নে মরীচিকায় পা দিচ্ছেন অনেক যুবককে।
স্থানীয়ভাবে জানা যায়, প্রথমে চক্রের সদস্যরা ইতালিতে উন্নত জীবনের প্রলোভন দেখায়। নির্দিষ্ট অঙ্কের টাকা নিয়ে আগ্রহী যুবকদের লিবিয়ায় পাঠিয়ে তুলে দেয় মাফিয়াদের হাতে। এরপর পাশবিক নির্যাতনের ভিডিও পরিবারে কাছে পাঠিয়ে আদায় করে লাখ লাখ টাকা। পরিবার টাকা দিতে ব্যর্থ হলে জীবন দিতে হয় চক্রের হাতে।
যারা টাকা দেয়, দালালরা তাদের ছাড়িয়ে ঝুঁকিপূর্ণ ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিতে নৌকা বা ট্রলারে ছেড়ে দেয়। এ সময় নৌকাডুবিতে অনেকের সলিলসমাধি হচ্ছে সাগরেই। ভাগ্যক্রমে কেউ কেউ ইতালিতে পৌঁছালেও বেশির ভাগ যাত্রী হয় লিবিয়ার কোস্টগার্ডের হাতে ধরা পড়ে জেলখানায় বন্দি হচ্ছেন আবার নৌকাডুবিতে প্রাণ যাচ্ছে। তারপর জেল থেকে ছাড়ানোর আশ্বাস দিয়ে দালালরা পরিবারের কাছ থেকে আরেক দফায় লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। এভাবেই চক্রের ফাঁদে পড়ে ভিটেমাটি সোনাদানা হারিয়ে সর্বস্বান্ত হচ্ছে নিরীহ পরিবারগুলো।
ভুক্তভোগী পরিবারগুলো থেকে জানা যায়, প্রায় এক বছর আগে লিবিয়া হয়ে ইতালি যাওয়ার উদ্দেশে বাড়ি থেকে বের হন মাদারীপুরসহ গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়া ও শরীয়তপুরের নড়িয়ার দুই শতাধিক যুবক। স্থানীয় বিভিন্ন দালালের মাধ্যমে চার লাখ টাকার বিনিময়ে তারা প্রথমে লিবিয়ায় পৌঁছান। এরপর তাদের তুলে দেওয়া হয় লিবিয়ায় থাকা অন্য দালালদের হাতে।
সেখানে শুরু হয় আরেক দফা নির্যাতন। তাদের নৌকায় (গেম) করে ইতালিতে পাঠানোর কথা বলে পারিবারের কাছ থেকে হাতিয়ে নেয় আরও ৪ থেকে ৫ লাখ টাকা। তারপর দালালরা ভুক্তভোগীদের নৌকায় তুলে দেয়। কিছু দূর যাওয়ার পর লিবিয়ার মাফিয়াদের দিয়ে আটক করায়। পরে ছাড়ানোর নাম করে আবার ৪ থেকে ৫ লাখ টাকা হাতিয়ে নেয়। সন্তান বা স্বজনকে বাঁচাতে এভাবে তিন দফা দালালদের হাতে লাখ লাখ টাকা তুলে দিতে বাধ্য হন প্রতিটি পরিবার।
সর্বশেষ তিন মাস আগে নৌপথে ইতালিতে পাড়ি দেওয়ার পথে কোস্টগার্ডের কাছে ধরা পড়ে যায় তারা। পরে তাদের পাঠিয়ে দেওয়া হয় লিবিয়ার ‘আল-জাহারা খামছাখামছিল ৫৫’ নামক কারাগারে। এসব যুবক এখন জেলখানায় অমানবিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। তাদের ছাড়িয়ে আনার জন্য লিবিয়ার স্থানীয় দালালদের টাকা দিয়েও প্রতারণার শিকার হয়ে সর্বস্বান্ত এখন পরিবারগুলো। দালালদের খপ্পরে পড়ে প্রতিটি পরিবারকে গুনতে হয়েছে প্রায় ১৫ খেকে ২০ লাখ টাকা।
বারের চাপে পড়ে ঘর ছেড়ে পালিয়েছেন অভিযুক্ত ব্যক্তিরা। মুঠোফোনে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও তারা বিষয়টি অস্বীকার করেন। অভিযুক্তদের পরিবারের সঙ্গে এ ব্যাপারে জানতে চাইলে তারা কিছুই জানেন বলে দাবি করেন। এলাকাবাসীর তোপের মুখে পড়ে অনেকে ঘরে তালা দিয়ে উধাও হয়েছেন।
দালালদের প্রলোভনে আগ্রহী হয়ে লিবিয়া থেকে ভূমধ্যসাগরে নৌকাডুবিতে মারা গিয়েছেন মাদারীপুর জেলার অনেক যুবক। কেউ কেউ অবৈধভাবে বিদেশ গিয়েও মানবেতর জীবন যাপন করছেন। আবার অনেক যুবক নিখোঁজ আছেন বছরের পর বছর ধরে। পরিবারের লোকজন এখনো তাদের আশার পথ চেয়ে বসে আছেন।