নিজস্ব প্রতিবেদক,ঢাকা:
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইউ) খাদ্যে ক্ষতিকারক উপাদানের (ফুড হ্যাজার্ড) উপস্থিতি নিয়ে ৩টি গবেষণার ফলাফল প্রকাশিত হয়েছে। এসব ফলাফলে খাদ্যে সীসাসহ ক্ষতিকারক উপাদান পাওয়া গেছে। গবেষকরা মন্তব্য করেছেন, এটা অনেকটা সন্তানদের খাবারের নামে বিষ খাওয়ানো হচ্ছে।
সোমবার (১৪ মার্চ) বিএসএমএমইউর শহীদ ডা. মিল্টন হলে এক অনুষ্ঠানে এসব গবেষণার ফলাফল প্রকাশ করা হয়েছে।
এতে সম্মানিত অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর স্বাস্থ্য ও সমাজ কল্যাণ বিষয়ক সাবেক উপদেষ্টা ও বিএমআরসির বর্তমান সভাপতি অধ্যাপক ডা. সৈয়দ মোদাচ্ছের আলী। প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বিএসএমএমইউর উপাচার্য অধ্যাপক ডা. মো. শারফুদ্দিন আহমেদ।
পাবলিক হেলথ অ্যান্ড ইনফরমেটিক্স বিভাগের উদ্যোগে আয়োজিত এই অনুষ্ঠানে তত্ত্বাবধায়ক গবেষক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. মো. খালেকুজ্জামান।
বিএমআরসির সভাপতি অধ্যাপক ডা. সৈয়দ মোদাচ্ছের আলী বলেন, বিএসএমএমইউর নতুন উপাচার্য অধ্যাপক ডা. মো. শারফুদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বে গবেষণার ক্ষেত্রে নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে। এ ধরণের গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে জানানোর জন্য অবশ্যই রেকর্ড রাখতে হবে।
তিনি আরও বলেন, লবণ ও চিনি যতটা সম্ভব কম খাওয়া ভালো বা পরিমিত পরিমাণে খেতে হবে। মানুষের মধ্যে ভুল ধারণা আছে যে, শুধু কাঁচা লবণ না খেলেই চলে, আসলে তা নয়, রান্নাতেও লবণের ব্যবহার পরিমিত হতে হবে। প্রকৃত বাস্তবতা হলো বিভিন্ন খাদ্য-দ্রব্যের মাধ্যমে মানুষ প্রয়োজনের তুলনায় অতিরিক্ত লবণ খাচ্ছেন।
অধ্যাপক ডা. মো. শারফুদ্দিন আহমেদ বলেন, আমরা কারোর বিরুদ্ধে নই, আমাদের গবেষণার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে মানুষকে সচেতন ও সতর্ক করা। স্বাস্থ্যসম্মত খাবারের সঙ্গে সঙ্গে নিয়মিত ব্যায়াম ও ডিসিপ্লিনের অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে।
অন্যান্য বক্তারা বলেন, আমরা আমাদের প্রিয় সন্তানদের জন্য কষ্টের মাধ্যমে অর্জিত অর্থ খরচ করে প্রতিদিন খাবারের নামে বিষয় কিনে নিচ্ছি না তো। খাবারের নামে আমরা কী খাচ্ছি তা নিয়ে ভাবার সময় এসেছে। খাদ্য সামগ্রী উৎপাদক ও ব্যবসায়ীদের জাতির প্রতি কমিটমেন্ট থাকতে হবে। প্রতারণা, ছল চাতুরি বন্ধ করতে হবে। নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করতে সবাইকে এগিয়ে আসতে সম্মিলিত পর্যায়ে কাজ করতে হবে।
এনার্জি ড্রিংকে সীসা; ক্যাফেইনের উপস্থিতি দ্বিগুণ
অনুষ্ঠানে জানানো হয়, ঢাকার বাজারে বিক্রি হওয়া ঠান্ডা-পানীয় স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকারক উপাদান। এ বিষয়ে গবেষণা করেন ডা. এএইচএম গোলাম কিবরিয়া।
দেশে মোট মৃত্যুর ৬৭ শতাংশের এর জন্য অসংক্রামক রোগ দায়ী। চিনি, ক্যাফেইন, ভারি ধাতু ইত্যাদি যুক্ত কোমল পানীয় অসংক্রামক রোগের পাশাপাশি শিশুদের স্থূলতার পরিমাণ বৃদ্ধি করতে ভূমিকা পালন করে।
রাজধানীর বাজারে পাওয়া সবচেয়ে বেশি বিক্রি হওয়া পেট-বোতলজাত ব্র্যান্ডের ১০টি কোমল পানীয় এবং পাঁচটি এনার্জি ড্রিংকের নমুনা ক্রয় করা হয়েছিল। প্রায় তিন-চতুর্থাংশ পানীয়ের পিএইচ মাত্রা ৩ এর নিচে ছিল। অ্যাসিডিক মাত্রা ৩ এর নিচে, যা দাঁতের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর হতে পারে। একটি পরিবেশনে (২৫০ মিলি) মোট চিনির পরিমাণ কোমল পানীয়ের জন্য ২০.৮-২৮.৮ গ্রাম এবং এনার্জি ড্রিংকের জন্য ২২.৬-৩৭.০ গ্রাম পাওয়া গেছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গাইডলাইন অনুযায়ী, একজন প্রাপ্তবয়স্কের জন্য একদিনে সর্বোচ্চ চিনি গ্রহণের মাত্রা ২৫ গ্রাম। অধিকাংশ পানীয়ের বেলায়ই একটি পরিবেশন দৈনিক সর্বোচ্চ মাত্রা পূরণ করে ফেলতে পারে।
কোমল পানীয়ের তুলনায় এনার্জি ড্রিংকে ক্যাফেইনের মাত্রা বেশি ছিল। ক্যাফেইনের জন্য বিএসটিআই অনুমোদিত সর্বোচ্চ গ্রহণযোগ্য মাত্রা ১৪৫ পিপিএম হলেও একটি এনার্জি ড্রিংকে এর মাত্রা পাওয়া গেছে ৩২১.৭ পিপিএম। এক পরিবেশন (২৫০ মিলি) কোমল পানীয় এবং এনার্জি ড্রিংকে সীসার মাত্রা ছিল যথাক্রমে ০.০৫৩ মিলি গ্রাম এবং ০.০৪৮ মিলি গ্রাম।
ফ্রেঞ্চ ফ্রাই ও ফ্রায়েড চিকেনে ক্ষতিকারক উপাদান
ঢাকার বাজারে পাওয়া যায় এমন ফ্রেঞ্চ ফ্রাই ও ফ্রায়েড চিকেনে স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকারক উপাদান রয়েছে। এ নিয়ে গবেষণা করেন ডা. সাজিয়া ইসলাম। বিশ্ব জুড়ে জনপ্রিয় ফাস্টফুড তালিকার শীর্ষে অবস্থান করছে ফ্রেঞ্চ ফ্রাই ও ফ্রায়েড চিকেন। যা নিম্ন খাদ্যমান ও স্থূলতার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। প্রায়ই এসব খাবারে উচ্চমাত্রার সোডিয়াম, ট্রান্স ফ্যাট, ভারি ধাতু (হেভি মেটাল) থাকার কথা শোনা যায় যেগুলো উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ, ডায়াবেটিস, বিষণ্ণতা, স্টোক, ক্যান্সারের কারণ হতে পারে।
বাংলাদেশের মানুষ, বিশেষ করে শিশু-কিশোরদের পছন্দের খাদ্য তালিকায় ফাস্ট ফুড বড় আসন দখল করে আছে যে কারণে তাদের মধ্যে স্থূলতার পরিমাণ বাড়ার পাশাপাশি পরবর্তীতে অসংক্রামক রোগ হওয়ার ঝুঁকি বাড়ছে। পাঁচটি সর্বোচ্চ বিক্রিত (দৈনিক বিক্রির পরিমাণ অনুযায়ী) ফ্রেঞ্চ ফ্রাই ও ফ্রায়েড চিকেনের নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছিল। ফ্রেঞ্চ ফ্রাইয়ের একটি পরিবেশনে (১০০ গ্রাম) গড়ে পাওয়া গেছে। সোডিয়াম-০.৪৫ গ্রাম (এক পরিবেশন ফ্রেঞ্চ ফ্রাই খেলে দৈনিক অনুমোদিত মাত্রার (২ গ্রাম) চার ভাগের এক ভাগ পরিমাণ খাওয়া হয়ে যাবে)। আর্সেনিক-০.০৯৩ মিলি গ্রাম (এক পরিবেশন ফ্রেঞ্চ ফ্রাই খেলে দৈনিক সর্বোচ্চ অনুমোদিত মাত্রার (০.২২ মি. গ্রাম) ৪২.২৭ শতাংশ পরিমাণ খাওয়া হয়ে যাবে)। ট্রান্স ফ্যাটি এসিড- ০.১১ গ্রাম। সীসা- ০.০০৩ মি. গ্রাম।
ফ্রায়েড চিকেনের একটি পরিবেশনে (১০০ গ্রাম) গড়ে পাওয়া গেছে। সোডিয়াম- ০.৪৬ গ্রাম (এক পরিবেশন ফ্রেঞ্চ ফ্রাই খেলে দৈনিক অনুমোদিত মাত্রার (২ গ্রাম) চার ভাগের এক ভাগ পরিমাণ খাওয়া হয়ে যাবে)। আর্সেনিক- ০.০৫৩ মি. গ্রাম এবং সীসা ০.০০৬ মি. গ্রাম (এক পরিবেশন ফ্রায়েড চিকেন খেলে দৈনিক সর্বোচ্চ অনুমোদিত মাত্রার ৩ শতাংশ গ্রহণ করা হয়ে যাবে, যেখানে দৈনিক অনুমোদিত মাত্রা আর্সেনিকের জন্য ০.২২ মি. গ্রাম এবং সীসার জন্য ০.২৫ মি. গ্রাম)। ট্রান্স ফ্যাটি এসিড-০.১৩ গ্রাম।
প্যাকেটজাত খাবারে নেই লবণ-চিনি-চর্বির সঠিক পরিমাণ
দেশে সর্বাধিক প্রচলিত প্রক্রিয়াকৃত প্যাকেটজাত খাবারে লবণ, চিনি ও চর্বির পরিমাণ মূল্যায়ন করা এবং খাদ্যের লেবেলে প্রদত্ত তথ্যের সাথে সামঞ্জস্যতা যাচাই করা। এই গবেষণাটি করেন প্রফেসর ড. সোহেল রেজা চৌধুরী।
সাম্প্রতিক সময়ে রেডি টু-ইট প্রক্রিয়াকৃত প্যাকেটজাত খাবার বিশ্বব্যাপী অনেক জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। উচ্চ পরিমাণে লবণ, চিনি, সাচ্যুরেটেড ফ্যাটি অ্যাসিড (এসআরএ), ট্রান্স ফ্যাটি অ্যাসিড (টিআরএ) এবং ক্যালরি থাকার কারণে এই খাবারগুলো স্থূলতা এবং খাদ্য-সম্পর্কিত অসংক্রামক রোগের প্রধান অবদানকারী হিসেবে পরিচিত। অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও প্রক্রিয়াজাত খাবারের উৎপাদন বার্ষিক গড়ে ৮ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে।
গবেষণায় বলা হয়েছে, দ্রুত নগরায়ন, ক্রমবর্ধমান আয় ও খাদ্য শিল্পের সম্প্রসারণকে প্রক্রিয়াকৃত খাবারের চাহিদা বৃদ্ধির চালিকাশক্তি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। খাদ্য নির্বাচনের সময় সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে এবং ক্যালরি সমৃদ্ধ ও পুষ্টিহীন খাবারের ব্যবহার এড়ানোর ক্ষেত্রে ভোক্তারদের সহায়তার জন্য যথাযথ পুষ্টি লেবেলিং একান্ত প্রয়োজন। বাংলাদেশের সর্বাধিক প্রচলিত প্রক্রিয়াকৃত প্যাকেটজাত খাবারে কার্বোহাইড্রেট, প্রোটিন, চর্বি, ক্যালরি, ডায়েটারি ফাইবার, সোডিয়াম, চিনি, এসএফএ ও টিএফএর পরিমাণ মূল্যায়ন করা প্রয়োজন।
আরও বলা হয়, বাংলাদেশের আটটি প্রশাসনিক বিভাগে পরিচালিত পারিবারিক জরিপ এবং বাজার সমীক্ষার মাধ্যমে মোট ৯টি সর্বাধিক প্রচলিত প্রক্রিয়াকৃত প্যাকেটজাত খাবার চিহ্নিত করা হয়েছিল। কোন ব্র্যান্ডের পণ্যই টিএলএল সিস্টেম অনুযায়ী ক্ষতিকর উপাদানগুলোতে সবুজ (কম পরিমাণে) এবং এইচএসআর স্কিম অনুযায়ী ৪ বা তার বেশি স্টার পায়নি। একমাত্র মটর ভাজা এইচএসআর সিস্টেমে সর্বোচ্চ গড়ে ২.৫ রেটিং পেয়েছিল। প্রোটিন, কার্বোহাইড্রেট, ক্যালরি, লবণ, চিনি, এসএফএ ও টিএফএর সঠিক প্রতিবেদন কোনো পণ্যতেই পাওয়া যায়নি।
১০০ গ্রাম লজেন্স/ললিপপ, ভাজা ডাল/মটর এবং দুধের চকোলেট যথাক্রমে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দৈনিক গ্রহণযোগ্য চিনি, লবণ ও এর এসএফএর মাত্রা অতিক্রম করেছিল। ৭০.৮ শতাংশ নমুনায় কার্বোহাইড্রেট পরিমাণ অতিরিক্ত এবং ৬৬.৭ শতাংশ নমুনায় লবণের পরিমাণ কম রিপোর্ট করা হয়েছিল। ৪৫.৮ শতাংশ নমুনায় এসএফএ, ৩৭.৫ শতাংশ নমুনায় টিএফএ ও ফাইবার এবং ২০.৮ শতাংশ নমুনায় লবণ ও চিনির রিপোর্ট অনুপস্থিত ছিল।
অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (গবেষণা ও উন্নয়ন) অধ্যাপক ডা. মো. জাহিদ হোসেন। জনস্বাস্থ্য বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ এ অনুষ্ঠানে অন্যান্যদের মধ্যে আরও উপস্থিত ছিলেন উপ-উপাচার্য (শিক্ষা) অধ্যাপক ডা. একেএম মোশাররফ হোসেন, উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক ডা. ছয়েফ উদ্দিন আহমদ, কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ আতিকুর রহমান, প্রক্টর অধ্যাপক ডা. মো. হাবিবুর রহমান দুলাল, ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশনের সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক খন্দকার আব্দুল আউয়াল রিজভী প্রমুখ।