যশোরের চৌগাছা উপজেলার ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের কপোতাক্ষ নদ অবৈধ দখলদারদের কবলে পড়ে হারাতে বসেছে তার ঐতিহ্য। এক শ্রেণির অসাধু ব্যক্তি নদকে তাদের ইচ্ছামতো ব্যবহার করার ফলে এক সময়ের প্রমত্তা কপোতাক্ষ নদ সংকুচিত হয়ে পরিণত হয়েছে এখন মরাখালে। বর্ষার ভরা মৌসুমেও নদে থাকে না কোনো স্রোত। ফলে কৃষি ও কৃষকসহ সাধারণ মানুষ হচ্ছেন নানামুখী ক্ষতির শিকার।
কচুরিপানায় ভরে গেছে পুরো নদ। মরা নদের মাঝে পাটাতন ও বাঁধ দিয়ে করা হচ্ছে মাছ চাষ। আবার অনেকে নদের সম্পত্তি দখলে নিয়ে তৈরি করছে বসতবাড়ি, কেউ বানিয়েছেন পুকুর। অবৈধ দখলদারদের কবল থেকে এখনই কপোতাক্ষকে বাঁচানোর উপযুক্ত সময়। অন্যথায় নদের ওপর নির্ভরশীল মানুষের জীবন-জীবিকা ও অধিকার আরও বিপন্ন হবে। তাছাড়া অচিরেই স্মৃতির পাতা থেকে হারিয়ে যাবে কপোতাক্ষের ঐতিহ্য।
কপোতাক্ষ নদ ইতিহাস ঐতিহ্যের ধারক-বাহক হিসেবে চৌগাছার বুক চিরে মিশেছে বঙ্গোপসাগরে। নদকে ঘিরে ব্যবসা-বাণিজ্যে অসামান্য সাফল্য পেতে থাকে এ জনপদের হাজারও মানুষ। কিন্তু কালের পরিক্রমায় সেই নদ এখন মরাখালে পরিণত হয়েছে। খনন না করার ফলে নদে পলি জমে ভরাট হয়ে গেছে। এর সঙ্গে কিছু অসাধু ব্যক্তি নদকে নিজেদের মতো দখল করে নেয়ায় তার স্বাভাবিক চলা এক প্রকার বন্ধ হয়ে গেছে। বর্ষার ভরা মৌসুমেও কপোতাক্ষে পানি নেই।
যতটুকু পানি আছে তার পুরোটাই কচুরিতে ভরে গেছে। বর্তমানে কপোতাক্ষ পাড়ে গেলে বোঝার উপায় নেই এখানে এক সময় পালতোলা নৌকা চলতো, জোয়ার-ভাটা আসত নিয়মিত। দখলদারদের কবল হতে নদকে উদ্ধার করার পর খনন করা জরুরি মনে করছেন সচেতন মহল।
১১টি ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভা নিয়ে গঠিত চৌগাছা উপজেলাকে কপোতাক্ষ নদ বলা চলে দু’ভাগে বিভক্ত করেছে। সুদূর চুয়াডাঙ্গা জেলার মাথাভাঙ্গা থেকে উৎপত্তি কপোতাক্ষ নদের। প্রায় ৬৫ মাইল দূরত্ব এই নদ সাপের মতো আঁকাবাঁকা হয়ে চৌগাছার বুকচিরে মিলিত হয়েছে দক্ষিণে বঙ্গোপসাগরে। ব্রিটিশ শাসনামলে এই কপোতাক্ষ নদে চলেছে বিশাল বিশাল জাহাজ। ব্রিটিশ ব্যবসায়ীরা সে সময় জাহাজে করে বর্তমান চৌগাছা উপজেলার পাশাপোল ইউনিয়নের খলশী বাজার নামক স্থানে এসে তাদের বহন করা জাহাজ নোঙর করত।
ইংল্যান্ড থেকে নিয়ে আসা চুন, লবণ, কেরোসিন, পোশাক, শিশুদের খেলনাসহ নানা ধরনের মালামাল খালাস করা হতো এখানে। খালাসিরা (মুটে) জাহাজ থেকে এখানে মালামাল খালাস করায় এই স্থানকে সে সময়ে খালাসি বলে ডাকা হতো। খালাসি হতে পরবর্তীতে জায়গাটি খলসি নামে পরিচিতি লাভ করেছে. এই ভূখণ্ডে ব্রিটিশরা প্রয়োজনীয় কাজ সম্পন্ন করে এখান থেকে নীল, চিনি, গুড় ওই জাহাজে বোঝাই করে পুনরায় কপোতাক্ষ দিয়ে পাড়ি জমাত তাদের দেশে এমনটিই জানালেন এলাকার বয়োবৃদ্ধরা।
এলাকাবাসী জানান, দেশ স্বাধীনের পরও এই কপোতাক্ষ নদে নিয়মিত জোয়ার-ভাটা আসত। পালতোলা নৌকা নিয়ে মাঝি মনের সুখে গান গাইতে গাইতে নিজ গন্তব্যে পৌঁছাতেন। ভরা যৌবনের কপোতাক্ষের অঢেল পানি আর জীববৈচিত্র্যে এ অঞ্চলে অপরূপ সৌন্দর্য বিরাজ করত। সে সময় কপোতাক্ষ নদে দেশি প্রজাতির মাছের পাশাপাশি বিভিন্ন ধরনের মাছের ব্যাপক সমারোহ ছিল। নানা জাতের পাখির কিচিরমিচির ডাকে মুগ্ধ হতেন মানুষ। নদকে কেন্দ্র করে কপোতাক্ষের পাড়ে শতাধিক জেলেপল্লী গড়ে ওঠে। তাদের জীবন-জীবিকার একমাত্র মাধ্যম ছিল কপোতাক্ষ।
কিন্তু সময়ের ব্যবধানে সেই কপোতাক্ষ আজ মরাখালে পরিণত হয়েছে। অবৈধ দখলদারদের কারণেই কপোতাক্ষ নদের আজ এই পরিস্থিতি বলে অভিমত এলাকাবাসী ও বিশেষজ্ঞ, বিশ্লেষকদের। মাত্র কয়েক বছরের ব্যবধানে কপোতাক্ষের বিস্তীর্ণ জমি চলে গেছে দখলদারদের কবলে। অবৈধ দখলদারদের কবল থেকে ঐতিহ্যবাহী কপোতাক্ষ নদকে মুক্ত করার পাশাপাশি খনন করে তাকে বাঁচিয়ে রাখার জোর দাবি করেছে গোটা দক্ষিণাঞ্চলের মানুষ।
স্বাস্থ্যকর পরিবেশে বসবাস ও কাজ করা ভোক্তার অধিকার। জাতিসংঘ এই অধিকারকে স্বীকৃতি দিয়েছে। স্বাস্থ্যকর পরিবেশে বসবাস ও কাজ করার জন্য পরিবেশের উন্নয়ন ঘটানো বাধ্যতামূলক। নদ-নদীর মতো প্রাকৃতিক সম্পদগুলোকে বাঁচিয়ে রাখতে না পারলে মানুষ বাঁচানো যাবে না। তাই অচিরেই কপোতাক্ষ নদকে দখলদারদের হাত থেকে উদ্ধারের ওপর জোর দিচ্ছে সচেতন মহল।
খবর পাঠিয়েছেন: যশোর থেকে মহসিন মিলন