ভোক্তাকণ্ঠ ডেস্ক: রমজান মাসে বাজারে তেল, চিনি, ছোলা, ডাল, খেজুরসহ বেশকিছু পণ্যের চাহিদা বেড়ে যায়। প্রতি বছর রমজানের আগে এসব নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম ও সরবরাহ স্বাভাবিক রাখার প্রতিশ্রুতি দেন পাইকারি ব্যবসায়ী, আড়ৎদারসহ সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলো। এবারও সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন সভায় তারা এ প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। কিন্তু ফলাফল শূন্য। উল্টো ‘স্বভাবসূলভ’ প্রতিবারের ন্যায় বাড়িয়ে যাচ্ছে পণ্যের দাম।
রমজানের ইফতারে সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করা হয় ছোলা। এই ছোলার দাম বছরের যেকোনো স্বাভাবিক সময়ে ছিল ৮০ টাকার নিচে। শেষ তিন সপ্তাহে পণ্যটির দাম এখন একশোতে ঠেকেছে। একই অবস্থা বেশ কয়েকমাস চিনি ও তেলের বাজারে। বিশ্ব বাজারে দফায় দফায় দাম কমলেও দেশে সরবরাহ স্বাভাবিক হচ্ছে না। বরং চিনির ক্ষেত্রে পণ্যটি যেন ‘কালোবাজারে’ লেনদেনের মতো হয়েছে। মানা হচ্ছে না সরকার নির্ধারিত দাম।
এমনকি কৌশলে এর মধ্যে বাজার স্থিতিশীল করার প্রতিশ্রুতিতে মিল মালিকরা গত মাসে (২৬ ফেব্রুয়ারি) রাজস্ব বোর্ড থেকে চিনি আমদানিতে বিভিন্ন শুল্ক প্রত্যাহার করিয়েছে। তবুও বাজারে কমেনি দাম।
বাজার ঘুরে দেখা গেছে, সরকার নির্ধারিত দর প্রতিকেজি খোলা চিনি ১০৭ টাকা এবং প্যাকেট চিনি ১১২ টাকায় বিক্রি হওয়ার কথা। কিন্তু খোলা চিনি বিক্রি হচ্ছে ১১৫ থেকে ১২০ টাকা। এছাড়া প্যাকেটজাত চিনি এখন মনমতো বিক্রি করছেন ব্যবসায়ীরা। কোথাও ১৩০ আবার কোথাও ১৪০ টাকা।
রামপুরার কুমিল্লা জেনারেল স্টোরের বিক্রেতা সাজ্জাদুল করিম বলেন, চিনির দাম নিয়ে কোম্পানি খুচরা বিক্রেতা ও ক্রেতার সঙ্গে দীর্ঘদিন ছিনিমিনি খেলছে। আমাদের সরবরাহ দেয় না। পাইকারি বাজারে সিন্ডিকেট করে বিক্রি হয়। সেখান থেকে আমাদের বেশি দামে কিনে বেচতে হচ্ছে। আগে কোম্পানি দোকানে চিনি দিতো। এখন তারা উধাও হয়ে গেছে।
আর পাইকারি ব্যবসায়ীদের কথা, কোম্পানি নির্ধারিত দামে চিনি দেয় না। বরং অনৈতিকভাবে বাড়তি টাকা নিচ্ছে। এ বিষয়ে পাইকারি চিনি ব্যবসায়ী ও মৌলভীবাজার ব্যবসায়ী সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক গোলাম মাওলা বলেন, ভ্যাট কমানোর ঘোষণার পর মিল থেকে চিনির দাম কমেনি। উল্টো বেড়েছে। এখন সরকার নির্ধারিত দাম অনুয়ায়ী ডিলারদের কাছে ১০২ টাকা দরে চিনি দেওয়ার কথা মিলগুলোর। তারা ডিওতে সেটাই লিখছে, কিন্তু আন্ডার ইনভয়েস ১০৫ থেকে ১১০ টাকা পর্যন্ত দাম নিচ্ছে।
তিনি বলেন, আমরা এ অভিযোগ সরকারের বিভিন্ন মহলে করেছি। কিন্তু কোনো প্রতিকার হয়নি।
গোলাম মাওলার অভিযোগের বিষয়ে সিটি গ্রুপের পরিচালক বিশ্বজিৎ সাহা বলেন, মিল থেকে সরকার নির্ধারিত দামেই পণ্য বিক্রি হচ্ছে। রশিদ ছাড়া কোনো পণ্য বিক্রি হয় না, ফলে দাম বেশি নেওয়ার প্রশ্ন আসে না।
দেশে সিটি গ্রুপ তীর ব্র্যান্ডে, মেঘনা গ্রুপ ফ্রেশ ব্র্যান্ডে, আব্দুল মোনেম গ্রুপ ইগলু ব্র্যান্ডে চিনি বাজারজাত করে। এছাড়া টিকে গ্রুপ, এস আলম গ্রুপ, দেশবন্ধু গ্রুপ বাজারে চিনির ব্যবসা করে। ইগলু ছাড়া বাকি প্রতিষ্ঠান আবার তেলের বাজারেও শীর্ষ সরবরাহকারী।
অন্যদিকে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর বিশ্ব বাজারে পণ্যের দাম বেশ বেড়েছিল। সেই উত্তাপ এখন অনেকটা কমে এসেছে। কয়েক মাসের ব্যবধানে বিশ্ব বাজারে দাম কমেছে গম, সয়াবিন তেল, চিনি, গুঁড়াদুধ, ডাল ও ছোলার মতো বেশকিছু নিত্যপণ্যের। কিন্তু বিশ্ব বাজারে দাম বৃদ্ধির সময় দেশের বাজারে যে মূল্যবৃদ্ধি হয়েছিল, এখনও সেটা কমছে না। রমজানের বাড়তি চাহিদার সুযোগে ফায়দা নেওয়ার আশায় এখন দাম সমন্বয় না করে যেন ‘নিশ্চুপ’ হয়ে আছে ব্যবসায়ীরা।
বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের এপ্রিল থেকে জুন মাসে প্রতি টন সয়াবিন তেলের দাম প্রায় ১ হাজার ৯০০ ডলার ছিল। এখন তা ১ হাজার ৩৫২ ডলারে নেমেছে। পাম অয়েলের দাম ১ হাজার ৬৩৪ ডলার থেকে নেমেছে ৯৪২ ডলারে। একই সময়ের ব্যবধানে প্রতি টন গমের দাম ৪৯২ ডলার থেকে এসেছে ৩৮০ ডলারে।
যদিও বিশ্ব বাজারে দাম কমার সুফল পাওয়া যাচ্ছে না দেশের বাজারে। বরং কিছু পণ্যে দরবৃদ্ধির প্রবণতা এখনও অব্যাহত আছে। কারণ হিসেবে ব্যবসায়ীরা এখনও আমদানি ব্যয় বৃদ্ধিকে দুষছেন। ডলারের মূল্যবৃদ্ধি ও এর কারণে পণ্যের করভার বেড়ে যাওয়ার কথাও বলছেন তারা। পাশাপাশি বলছেন, পণ্যগুলোর আমদানি সময়সাপেক্ষ। কমদামের পণ্য এখনও দেশে এসে পৌঁছায়নি। এর সুফল ভোক্তা পর্যন্ত পৌঁছাতে সময় লাগবে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে মেঘনা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের সিনিয়র সহকারী মহাব্যবস্থাপক তসলিম শাহরিয়ার বলেন, এখন যদি কোনো পণ্য বিশ্ব বাজার থেকে কেনা হয়, সেটা বাংলাদেশে আসবে রোজার পরে। ফেব্রুয়ারি থেকে যারা পণ্য কিনছে, এলসি করছে, তারা কিছুটা দাম কম পাচ্ছে। কিন্তু এ পণ্য আসবে অনেক পরে। তখন ক্রেতারা সেই সুফল পাবে। এখন যে পণ্যগুলো বাজারে বিক্রি হচ্ছে, সবকিছু চড়া দামে আমদানি করা।
তিনি বলেন, কোম্পানিগুলো চড়া মূল্যে ডলার কিনে এলসি করছে। অনেক কষ্টে সেটা করতে হচ্ছে। এরপর এলসি নিষ্পত্তি হতে চড়া মূল্যে করও দিতে হচ্ছে সেই হিসেবে। সবকিছু মিলে পণ্যের পরিস্থিতি এখনও স্বাভাবিক নয়।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, গত মে মাস পর্যন্ত দেশে ডলারের দাম ছিল ৮৬ টাকা। এখন তা ১০৬ টাকা। এলসি খোলার জন্য কখনও কখনও ১১০ টাকা পর্যন্ত খরচ করতে হয়েছে। এরপর কর আদায়ের ক্ষেত্রে ডলারের দাম প্রভাব ফেলে। দাম যত বেশি হয়, করভার তত বাড়ে। এবার অনেক ব্যবসায়ী এলসি নিষ্পত্তিতে ডলার সংকটের কারণে বন্দরে পণ্য খালাস না করতে পেরে জরিমানা গুণেছেন।
বিশ্ব বাজারে দাম কমার পরও দেশের বাজারে সেটা সমন্বয় না হওয়া ব্যবসায়ীদের একটি ‘অপকৌশল’ বলে মন্তব্য করেন কনজ্যুমারস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)-এর সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট হুমায়ুন কবির ভূঁইয়া। তিনি বলেন, বিশ্ব বাজারে দাম বাড়লেই তারা (ব্যবসায়ীরা) সঙ্গে সঙ্গে দেশের বাজারে সমন্বয় করে। রাতারাতি সেটা কার্যকর হয়ে যায়। কিন্তু দাম কমলে তখন নানা অজুহাত দেখায়। এটা ব্যবসায়ীদের পুরোনো অপকৌশল।
তিনি বলেন, বৃদ্ধিটা যদি সঙ্গে সঙ্গে সমন্বয় হয়, কমতিটাও সেভাবেই কার্যকর করতে হবে। দাম বাড়লে তারা চিৎকার শুরু করে, কিন্তু কমলে এমন ভাব করে যে কেউ সেটা জানে না, নিশ্চুপ হয়ে যায়।
তিনি আরও বলেন, ব্যবসায়ীরা কোনো ভাবে কোনো ক্ষেত্রে প্রতিশ্রুতি রক্ষা করছেন না। তারা নানা ধরনের অপকৌশলে লিপ্ত। যেটা পবিত্র একটি মাসে কারও কাম্য নয়।
সৌজন্যে, জাগো নিউজ।