সংকট মোকাবিলা ও বাজার স্থিতিশীল রাখতে আমদানি করা হচ্ছে চাল। তারপরও আমদানিতে খরচ বাড়ায় দেশি চালের তুলনায় আমদানিকৃত চালের মূল্য কেজিতে ১-৩ টাকা বেশি হতে পারে বলে মনে করছেন নওগাঁর ব্যবসায়ী নেতারা। তাই সহসাই চালের দাম কমছে না বলে জানিয়েছেন তারা।
এদিকে সরু চালের দাম স্থিতিশীল থাকলেও সপ্তাহের ব্যবধানে মোটা চালের দাম কেজিতে বেড়েছে ২ টাকা। দফায় দফায় চালের দাম বাড়ায় বিপাকে পড়েছে নিম্ন আয়ের মানুষ।
জানা গেছে, গত ইরি-বোরো মৌসুমে দেশে প্রাকৃতিক দুর্যোগে উৎপাদন ব্যাহত হয়। ধানের দাম বৃদ্ধির সঙ্গে বাড়তে থাকে চালের দামও। সংকট মোকাবিলা ও চালের বাজার স্থিতিশীল রাখতে আমদানির সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। আমদানিকৃত চাল বাজারে আসলে প্রভাব পড়ে চালের বাজারে। এতে দেশি চালের দাম কিছুটা কমে যায়। কিন্তু এবার তার উল্টো প্রভাব লক্ষ্য করা যাচ্ছে। আন্তর্জাতিক বাজার বিশেষ করে ভারতের বাজারে চালের দাম বাড়ছে। ডলারের দাম বৃদ্ধির কারণে আমদানিতেও বাড়ছে খরচ। এতে দেশি চালের তুলনায় আমদানিকৃত চালের দাম বৃদ্ধির সম্ভবনা রয়েছে।
তবে ব্যবসায়িরা বলছেন, সংকট মোকাবিলায় আমদানির পাশাপাশি দেশীয়ভাবে উৎপাদন বৃদ্ধি করে ঘাটতি মিটিয়ে ধান-চালের বাজার স্থিতিশীল রাখা সম্ভব।
আমদানিকৃত চাল বাজারে এলে চালের দাম কমে যাবে এমন প্রতিক্ষায় দিন গুনছেন ক্রেতারা। এ কারণে খুচরা বাজারে বেচাকেনাও কম হচ্ছে।
শহরের মধ্য দূর্গাপুর মহল্লার বাসিন্দা ভ্যানচালক সুজিত কুমার বলেন, আমরা দিনমজুর মানুষ। প্রতিদিন দেড় কেজি চাল লাগে। সারাদিন ভ্যান চালিয়ে যা রোজগার হয় তা দিয়ে চাল ও অন্য বাজার করে টাকা শেষ। দিন দিন চালের দাম বাড়ছে। কিন্তু কমছে না। শুনলাম এলসি আসলে চালের দাম কমবে। কিন্তু বাজারে এখনো এলসি চাল আসেনি। চালের দাম সাধ্যের মধ্যে থাক এটাই আমাদের দাবি।
শহরের পৌর খুচরা চাল ব্যবসায়ী অখিল চন্দ্র বলেন, সপ্তাহের ব্যবধানে মোটা চালের দাম কেজিতে বেড়েছে ২ টাকা। গত সপ্তাহে স্বর্ণা-৫ চালের দাম ছিল ৪৮ টাকা কেজি। বর্তমানে ২ টাকা বেড়ে হয়েছে ৫০ টাকা। এছাড়া জিরাশাইল ৬৫ টাকা, কাটারি ৭৫ টাকা, ব্রি-২৯ ৫৮ টাকা এবং ব্রি-২৮ বিক্রি হচ্ছে ৬০ টাকা কেজি দরে। তবে এসব চালের বাজার স্থিতিশীল রয়েছে।
মেসার্স সমতা রাইচ এজেন্সির প্রোপ্রাইটর সুকুমার বলেন, গত ১৫ দিনের ব্যবধানে দেশীয় চালের বাজারের কোনো দরপতন হয়নি। ঈদ-উল-আজহার আগ থেকে আমদানি করা চাল আসার কথা শুনে ক্রেতাদের চাল কেনার আগ্রহ কিছুটা কমেছে। আমাদের কাছ থেকে যারা চাল কিনতো তাদের একটা ধারণা ছিল আমদানি করা চাল বাজারে আসলে দাম কমবে। কিন্তু তার উল্টো হয়েছে। আমদানি করা চালের দাম বেশি আর দেশি চালের দাম কম। এতে করে আমদানি এবং দেশি দু’প্রকার চাল বেচা-কেনা কম হচ্ছে।
তিনি বলেন, মিনিকেট বা জিরাশাইল প্রতিকেজি চালের পাইকারি মূল্য ৬৩-৬৪ টাকা, নাজিরশাইল ৭০-৭১ টাকা, স্বর্ণা-৫ ৪৭-৪৮ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে।
নওগাঁ শহরের পৌর খুচরা চাল ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক উত্তম কুমার সরকার বলেন, বর্তমানে চালের বাজার স্থিতিশীল রয়েছে। তবে মোটা চাল স্বর্ণা-৫ প্রতি বস্তায় ১৫০-২০০ টাকা দাম বেড়েছে। মোটা চাল বাজারে সংকট, অপরদিকে হাইব্রিড চালও নেই। এছাড়া আমদানিকৃত চাল এখনো বাজারে আসেনি। বাজার ক্রেতাশূন্য। ক্রেতারা হয়ত ভাবছে আমদানিকৃত চাল বাজারে আসলে দাম কমবে।
নওগাঁ জেলা চাউলকল মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক ফরহাদ হোসেন চকদার বলেন, বোরো মৌসুমে দেশে প্রাকৃতিক দুর্যোগে শষ্য নষ্ট হওয়ায় উৎপাদন ব্যাহত হয়েছে। এদিকে অনাবৃষ্টিতে এখনো রোপা-আমন লাগানো সম্ভব হয়নি। চাষিরা হাট-বাজারে ধান নিয়ে না আসায় ব্যবসায়ীরা কিনতে পারছেন না। বাড়তি দাম দিয়ে কিনতে হচ্ছে। এতে বাজারে ধানের দাম যেমন বাড়ছে তেমনি চালের দামও।
তিনি বলেন, সংকট মোকাবিলায় যে পরিমাণ ঘাটতি আছে আমদানি করে তা পূরণ করতে হবে। পাশাপাশি অভ্যন্তরীণভাবে ফসল উৎপাদন বৃদ্ধি করে ঘাটতি মিটিয়ে ধান-চালের বাজার স্থিতিশীল রাখা সম্ভব। যদি ফসল উৎপাদনে ব্যর্থ হয় তাহলে আগামীতে ধান-চালের বাজার কমার কোনো সম্ভ্যবনা নেই বলে মনে করেন তিনি।
নওগাঁ ধান-চাউল আড়ৎদার ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি নিরোদ বরণ সাহা চন্দন বলেন, আমদানি খুলে দেওয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে ভারত থেকে আমদানিকৃত চাল প্রবেশ করা শুরু করেছে। কিন্তু চালের বাজারে এর কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে না। ইতোপূর্বে আমরা দেখেছি আমদানিকৃত চাল বাজারে এলে দাম কমে। কিন্তু এবার তার উল্টো।
এর মূল কারণ হচ্ছে, আন্তর্জাতিক বাজার বিশেষ করে ভারতের বাজারে চালের দাম বেড়েছে। শুল্ক দিতে হচ্ছে সাড়ে ২৭ শতাংশ। এতে করে চালের দাম স্বাভাবিকভাবেই বেড়ে যাচ্ছে। দেশীয় চালের তুলনায় আমদানি করা চালের মূল্য ১-৩ টাকা বৃদ্ধি পাচ্ছে। বড় ধরনের লোকসানের আশঙ্কায় আমদানিকারকরা বাজারে চাল বিক্রি করতে পারছেন না। এ কারণে আমদানি করা চাল বাজারে কোনো প্রভাব ফেলতে পারছে না।
ভোক্তা পর্যায়ে কম দামে চাল পাওয়ার সম্ভবনা আছে কিনা জানতে চায়লে তিনি বলেন, ভোক্তাদের সুবিধা পাওয়ার কোনো প্রশ্নই আসে না। আমাদের দুইটি বিষয় দেখতে হবে। প্রথমটা হচ্ছে, দেশীয় পণ্য যখন ব্যবহার করি তখন আমরা উৎপাদন ব্যয়ের ওপর নির্ভর করি। দ্বিতীয়ত যখন আমদানিকৃত পণ্য ব্যবহার হয় তখন আমদানির ব্যয়ের ওপর নির্ভর করে। যেহেতু আমদানি ব্যয়ের ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে সেহেতু কম দামে পাওয়ার কোনো সুযোগ নাই। ফলে চালের দাম আপাতত কমার কোনো সম্ভাবনা নেই।