ভোক্তাকণ্ঠ ডেস্ক: জিয়াউল হক পুরানা পল্টনের একটি ভবনের নিরাপত্তা কর্মী। বেতন পান ১০ হাজার টাকা। মাস শেষে পরিবারের জন্য সাত হাজার টাকা পাঠান। দুই ছেলে, মেয়ে, স্ত্রী মাদারীপুরে গ্রামের বাড়িতে থাকে। এ টাকাতে এক বছর আগে ভালোভাবে চলে যেত।
নিত্যপণ্যের দাম বাড়ায় এখন আর চলে না। খাওয়া কমিয়ে সংসার সামাল দিতে হচ্ছে। আগে যেখানে সপ্তাহে তিন থেকে চার দিন মাছ ও মাংস কেনা হতো। এখন একদিন মাছ কিনেই সপ্তাহ পার করতে হচ্ছে। চাল, ডাল, আটা কেনা ঠিক রেখে অন্য সব ধরনের খাদ্য কেনা কমাতে হয়েছে।
এ চিত্র এখন দেশের সব নির্দিষ্ট আয়ের মানুষের। আয় দিয়ে আর সংসার চলছে না। সব ধরনের পণ্য ও সেবার দাম বেড়ে গেছে। কি গ্রাম বা শহর, নিম্ন বা মধ্যবিত্ত নেই; সবার একই অবস্থা। নিত্যপণের দাম বৃদ্ধিতে সংকটে পড়েছে মানুষ। আয় বাড়ছে না, বাড়ছে সব ধরনের নিত্যপণ্যের দাম। বাজারে প্রতিদিনই কোনো না কোনো পণ্যের দাম বাড়ছে, সংসার চালাতে যুক্ত করতে হচ্ছে বাড়তি টাকা। যেটা বাড়ছে, সেটার দাম আর কমছে না। গত এক বছরের ব্যবধানে জীবন যাত্রার ব্যয় প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে।
মোটা চালের দাম ৫২ থেকে ৬০ টাকা। এক বছর আগে এ চাল বিক্রি হতো ৩৮ থেকে ৪০ টাকাতে। এক বছরের ব্যবধানে বেড়েছে ৪৫ শতাংশ। বাজারে ভোজ্য তেলের কেজি ১৮০ টাকা। এক বছর আগে ছিল ১৪০ টাকায়। বৃদ্ধির হার প্রায় ২৫ শতাংশ। বাজারে ডিমের ডজন ১৪০ টাকা, এক বছর আগে ছিল ৯৫ থেকে ১০০ টাকায়, বেড়েছে ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ।
প্যাকেট আটার কেজি দাম ৭০ টাকা, এক বছর আগে ছিল ৩৫ থেকে ৩৮ টাকায়। বৃদ্ধির হার প্রায় শতভাগ। গুঁড়া দুধ (ডানো) ৫০০ গ্রাম প্যাকেটের দাম ৩৫০ থেকে ৩৭০ টাকা। এক বছর আগে বিক্রি হয়েছে ২১০ টাকা থেকে ২৩০ টাকা। দাম বেড়েছে ৬৭ শতাংশ। মাঝারি লাক্স সাবানের দাম ৬০ টাকা; এক বছর আগে কেনা যেতো ৩৫ টাকাতে। বেড়েছে প্রায় ৭০ শতাংশ। এক বছরের ব্যবধানে সবজির দাম বেড়েছে ৬০ থেকে ৮০ ভাগ। এমনি প্রায় সব ধরনের নিত্যপণ্যের দাম বেড়েছে। গতকাল রোববার এ চিত্র ছিল রাজধানীর সেগুনবাগিচা ও মিরপুরে বিভিন্ন বাজারের। পরিবহন ভাড়া, বিদ্যুৎ বিল, গ্যাস বিল বা অন্যান্য সেবার খরচও বেড়েছে সমান তালে। সরকারি সংস্থা ট্রেডিং কর্পোরেশনের বাজার পর্যবেক্ষণে প্রায় একই চিত্র মিলছে।
খরচ বৃদ্ধির এ ঘা উৎপাদন খাতের শ্রমিকদেরও লেগেছে সমান ভাবে। এ বছরের শুরুতে যে শ্রমিক পরিবারটির ১২ হাজার টাকাতে চলে যেত, এখন তার খরচ করতে হচ্ছে ১৮ থেকে ২০ হাজার টাকা। তারপরও আগের মতো পুষ্টিমানের খাবার পাচ্ছে না।
মিরপুরের একটি গার্মেন্ট কারখানার শ্রমিক ইলিয়াস আলী বলেন, নিত্যপণ্য থেকে শুরু করে খাদ্য, বাসাভাড়া, যাতায়াত ভাড়া, ছেলের স্কুলের খরচসহ সব ধরনের খরচ বেড়েছে। দুই ছেলে মেয়েসহ চারজনের সংসারে আগে ২২ থেকে ২৩ হাজার টাকার মধ্যেই হয়ে যেতো। আগের একই খাদ্য কিনতে গেলে এখন ৩০ হাজার টাকার কমে হচ্ছে না। স্বামী-স্ত্রী দুজন চাকরি করেন। মূল বেতন, ওভারটাইমসহ মাসে তাদের আয় ছিল ৩০ থেকে ৩২ হাজার টাকা। কারখানার রপ্তানির কার্যাদেশ আগের মতো নেই, ওভারটাইমের কাজও কমে গেছে। আগের মতো ওভারটাইমের বাড়তি আয় যেমন কমেছে, তেমনি বেড়েছে ব্যয়। এখন বেতনই ভরসা। স্বামী-স্ত্রীর আয় নেমে এসেছে ২৮ হাজার টাকায়। ফলে বাধ্য হয়ে খাদ্য কেনা কমাতে হয়েছে। সন্তানের স্কুলের লেখপাড়ার খরচ কমাতে হয়েছে।
ইলিয়াস আলী বলেন, জানি না কতদিন জিনিষপত্রের এ বাড়তি দাম থাকবে। এভাবে চলতে থাকলে শরীর পড়ে যাবে। তখন কারখানায় কাজই করতে পারব না। ছেলে-মেয়েকে লেখাপড়াও করাতে পারব না। কারখানায় বা অন্য কোথায় চাকরি করতে পাঠাতে হবে।
তবে মধ্যম আয়ের শাহিদুর রহমানের উপলব্ধি অন্যদের চেয়ে ভিন্ন। তিনি বলেন, মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাওয়ার কারণে আর্থিক সংকটের পাশাপাশি মানবিক সংকট প্রকট হচ্ছে। প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে আত্মীয়-স্বজন বন্ধু-বান্ধবের কাছে ধার-দেনা করতে গেলে পাওয়া যাচ্ছে না। কেমন যেন বিশ্বাসহীনতা তৈরি হয়েছে। মনে হচ্ছে কাছের মানুষগুলোও পর হয়ে গেছে, টাকা নিয়ে দিতে পারবো না।
শাহিদুর রহমানের সব মিলে মাসে প্রায় ৫০ হাজার টাকা আয়। ঢাকায় নিজের সংসার চালিয়ে, সন্তানদের লেখাপড়ার খরচ চালিয়ে কিছু টাকা সঞ্চয় করতেন। জীবন নির্বাহের খরচ বেড়ে যাওয়ায় আয়ে চলছে না। সঞ্চয় ভেঙে খরচ চালিয়েও সামাল দিতে পারছেন না। ছেলে-মেয়ের প্রাইভেট পড়ানো সহ বেশ কিছু খরচ কমাতে হয়েছে। কমাতে হয়েছে ওষুধপত্র কেনা ও নতুন কাপড় চোপড় কেনার মতো প্রয়োজনীয় কেনাকাটাও।
এ বিষয়ে কনজুমারস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, আয়-রোজগার বাড়েনি কিন্তু জিনিষপত্রের দাম বেড়েছে। খুব কষ্টে আছে নিম্ন ও মধ্যবিত্ত মানুষ। জীবনমান অনেক নিচে নেমে গেছে। অনেকে সঞ্চয় ভেঙে খাচ্ছে, অনেকে বাসা-বাড়ি ছেড়ে দিয়ে গ্রামে চলে গেছে। মানুষের সংকটাপন্ন অবস্থা। অস্বস্তিকর পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে।
এ অবস্থা থেকে উত্তরণে তিনি পরামর্শ দিয়ে বলেন, মানুষকে সঞ্চয়ী হতে হবে এবং একটু ধৈর্য্য ধরতে হবে। পাশাপাশি সরকারকে নজর দিতে হবে যাতে মানুষের আয়-রোজগার বাড়ে। আর যেসব ব্যবসায়ী অপকর্ম করে লাভবান হওয়ার চেষ্টা করছে তাদের আইনের আওতায় এনে কঠোর শাস্তি দিতে হবে। বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম।