ভোক্তাকণ্ঠ ডেস্ক: বাংলাদেশে হঠাৎ রেকর্ড হারে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার পর প্রায় সবকিছুর বাজারদর ঊর্ধ্বমুখী। এভাবে দাম বাড়ানোয় কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) ভোক্তার অধিকার ‘তছনছ’ হওয়ার অভিযোগ করেছে। সাধারণ মানুষও বাজারের পরিস্থিতি নিয়ে ভোগান্তির কথা জানাচ্ছেন।
এমন পরিস্থিতিতে ভয়েস অফ আমেরিকার সঙ্গে আলাপকালে জাতীয় ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এ এইচ এম সফিকুজ্জামান ক্যাবের অভিযোগের জবাব যেমন দিয়েছেন, তেমনি বাংলাদেশের ব্যবসায়ীদের একটা অংশের নীতি-নৈতিকতা নিয়ে তুলেছেন প্রশ্ন। ভয়েস অফ আমেরিকার পক্ষে সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন অমৃত মলঙ্গী।
ভয়েস অফ আমেরিকা: তেলের দাম হঠাৎ যেভাবে বাড়ানো হলো, তাতে ভোক্তার অধিকার কি ক্ষুণ্ণ হয়েছে?
এ এইচ এম সফিকুজ্জামান: জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির প্রেক্ষাপট আসলে আমার বিষয় না। এখানে সরকার বিশ্ব বাজারের সঙ্গে সমন্বয়ের পর দাম নির্ধারণ করে দিয়েছে। ভোক্তার অধিকার তখনই ক্ষুণ্ণ হচ্ছে, যখন নির্ধারিত দামের চেয়ে বেশি রাখা হচ্ছে বা পরিমাণে কম দেওয়া হচ্ছে। কয়েক দিন আগে ইশতিয়াক নামের এক তরুণ এই ধরনের অভিযোগ করেন। সেদিন বিকেল পাঁচটার পর বিষয়টি আমার নজরে আসে। তখন যোগাযোগ করেছি। আমাদের আশ্বাসের প্রেক্ষিতে তিনি অবস্থান কর্মসূচি উঠিয়ে নেন। পরে শুনানিতে তার অভিযোগের প্রমাণ পাওয়ায় অভিযুক্ত পাম্পকে এক লাখ টাকা জরিমানা করেছি। আমাদের এই ধরনের পদক্ষেপ এবং অভিযান সারা দেশেই চলছে।
আপনি ভোক্তার যে অধিকারের কথা বললেন, সেটা এখানেই। যদি তিনি কম পান, প্রতারিত হন অথবা মানের ক্ষেত্রে যদি কম্প্রোমাইজ করা হয়। এসব ক্ষেত্রে ভোক্তা যদি অভিযোগ করেন অথবা গণমাধ্যমের কল্যাণে যদি আমাদের নজরে আসে, তাহলে ব্যবস্থা নেই।
ভয়েস অফ আমেরিকা: আপনি বলছেন সরকার দাম নির্ধারণ করে দিয়েছে। এটা করা হয়েছে এক রাতের ব্যবধানে। বাংলাদেশের মানুষের আয় অনুযায়ী এভাবে রেকর্ড হারে দাম বাড়ানোয় কি ভোক্তার অধিকার ক্ষুণ্ণ হয় না? বাংলাদেশের আইন এক্ষেত্রে কী বলে?
এ এইচ এম সফিকুজ্জামান: এ বিষয়ে আসলে আমার মন্তব্য করার কিছু নেই। এটা দেখবে জ্বালানি মন্ত্রণালয় এবং বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি)। এটা পাবলিক প্রকিউরমেন্টে হয়। সরকারকে তো সমন্বয় করতেই হয়।
বাংলাদেশে ভোক্তা-অধিকার আইনে যে কাভারেজ আছে, সেখানে বিষয়টি আসে না। এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন এটা ভালো বলতে পারবে। আমার অংশ হলো, দাম বাড়ানোর ফলে নেতিবাচক প্রভাব যেখানে পড়েছে, সেখানে।
ভয়েস অফ আমেরিকা: এখানে নেতিবাচক প্রভাব বলতে ঠিক কী বোঝাচ্ছেন?
এ এইচ এম সফিকুজ্জামান: যেমন সবজির কথা বলি। একটি ট্রাকে কমপক্ষে পাঁচ হাজার কেজি সবজি পরিবহন করা হয়। এখানে তেলের দাম বাড়ার পর ভাড়া কেজিপ্রতি এক টাকা বেশি লাগতে পারে। ৪০ টাকার সবজি সেখানে ৬০ টাকা হওয়ার কথা না। এখানেই আমাদের কাজ।
চাল পরিবহনে আরও কম খরচ পড়ে। এক ট্রাকে দশ থেকে ১৫ টন করে চাল পরিবহন করা হয়। এখানে পাঁচ হাজার টাকা অতিরিক্ত ভাড়া লাগলে প্রতিকেজিতে ৩৩ পয়সা বাড়তি খরচ হয়। দশ টনে ৫০ পয়সা বেশি খরচ হওয়ার কথা। এখন চালের দাম যদি অস্বাভাবিক বেশি হয়, তাহলে আমাদের হস্তক্ষেপের সুযোগ আছে।
ভয়েস অফ আমেরিকা: কিন্তু এভাবে হঠাৎ তেলের দাম বাড়ায় কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) বলছে, ভোক্তা-অধিকার ‘তছনছ’ হয়ে গেছে। এ বিষয়ে কী বলবেন?
এ এইচ এম সফিকুজ্জামান: ক্যাব তাদের পক্ষ থেকে একথা বলতেই পারে। সেটা তাদের বিষয়। আমি নিজেও ভোক্তা, আপনিও ভোক্তা। দেখুন, প্রচারটা এভাবে আসে: গতকাল একটা অনলাইনে অনুষ্ঠানে ছিলাম। সেখানে বলা হচ্ছে, দাম প্রতিদিনই নাকি ১০ টাকা, ১০ টাকা করে লাফিয়ে বাড়ছে। তাহলে কী দাঁড়ালো…সবজি একদিন ৪০ টাকা, পরের দিন ৫০ টাকা, পরের দিন ৬০! বিষয়টি তো এমন না।
অসাধু ব্যবসায়ীরা সবসময়ই অজুহাত খোঁজে। তেলের দাম বাড়ার বিষয়ে সরকার ব্যাখ্যা দিয়েছে। পণ্যের দাম কতটুকু বাড়তে পারে, তার হিসাব একটু আগে দিলাম। আটআনা বা একটাকা বাড়তে পারে। ১০ টাকা বা ২০ টাকা বাড়ার তো কোনো কারণ নেই।
এ ক্ষেত্রে আমি দুটো বিষয় উল্লেখ করতে চাই: কিছু ব্যবসায়ীর নীতি-নৈতিকতা তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে। অন্যদিকে ভোক্তাদের সচেতনতার একটা বিষয় আছে। এখন যদি বলেন, ভোক্তার ওপর দায় চাপালে হবে না। তাহলে একটা উদাহরণ দেই।
ঈদের আগে পোশাকের দাম যেভাবে বেড়েছিল, তখন মানুষ হুমড়ি খেয়ে পড়েছে। ভোক্তা যদি তার অধিকারের বিষয়ে সচেতন না হয়, তাহলে ব্যবসায়ীরা সুযোগ নেয়। আমাদের পক্ষে আর কতটুকু করা সম্ভব। সর্বোচ্চ চেষ্টাই করছি। আমাদের ছুটি নেই। ঈদের দিনও আমরা কাজ করেছি। তাই বলছি, ভোক্তারা সচেতন না হলে তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠিত করা সম্ভব হবে না।
ক্যাবের বিষয়ে বলতে গেলে, তারা যেহেতু ভোক্তাদের সঙ্গে কাজ করেন, এভাবে বক্তব্য দিতেই পারেন। তবে বাস্তবতা বুঝতে হবে। সারা পৃথিবীতে একই অবস্থা। শুধু উন্নয়নশীল দেশ না, উন্নত দেশও হিমশিম খাচ্ছে। বাংলাদেশে বসে কথা বললে হবে না, বিশ্ব ব্যবস্থাপনা বিবেচনায় আনতে হবে।
ভয়েস অফ আমেরিকা: আপনি উন্নত দেশের কথা বললেন। সেখানে তেলের দাম কমলে, অন্য সবকিছুর দামও কমে যায়। কিন্তু বাংলাদেশে কমে না। আপনি নিশ্চয়ই বিদেশে ভ্রমণ করে এসব দেখেছেন। বাংলাদেশ আর ওই দেশগুলোর মানুষের অধিকারের তুলনা শুনতে চাই আপনার থেকে।
এ এইচ এম সফিকুজ্জামান: বাংলাদেশের সঙ্গে অন্য দেশের তুলনা করলে হবে না। ছোট একটা দেশ। এত মানুষ। অনেক সমস্যা। ২৮ বছরের চাকরি আমার। ভোক্তা অধিদপ্তরের ডিজি হিসেবে হয়তো বিদেশে যাইনি। তবে বিদেশে যাওয়ার প্রচুর অভিজ্ঞতা আছে। অনেকে উন্নত দেশের সঙ্গে আমাদের তুলনা করেন। আমি সেটা করতে চাই না।
কিছু ব্যবসায়ীর নীতি-নৈতিকতা তলানির পর্যায়ে চলে গেছে। আমি কমার্স মিনিস্ট্রিতে নয় বছর কাজ করেছি। দেখেছি, বিশ্ব বাজারের সঙ্গে সমন্বয় করে ভোজ্যতেলের দাম বাড়ালে এক-দুই দিনের ভেতর নতুন তেল বাজারে চলে আসে। কিন্তু ১৪ টাকা যখন কমালাম, বাজারে আসতে আটদিন-দশদিন লেগে গেছে! তখন পুরনো তেল আর শেষ হয় না। ভোক্তা অধিদপ্তরের সীমিত জনবলে বিষয়গুলো আমরা আর কতটুকু নিশ্চিত করতে পারবো।
এলাকাভিত্তিক যেদিন লোডশেডিং ঘোষণা করা হলো, সেদিন দুই ঘণ্টার ভেতর চার্জার ফ্যানের দাম বেড়ে গেল। এখানে আপনি কী বলবেন, সমস্যা তো আমাদেরই (ব্যবসায়ীদের একাংশ)।
ভয়েস অফ আমেরিকা: মানুষের প্রতিক্রিয়ার কথা সরকারকে বা নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে জানাচ্ছেন কি না?
এ এইচ এম সফিকুজ্জামান: আমার দায়িত্ব অনুযায়ী প্রতিবেদন পাঠাচ্ছি। কিছুদিন আগে পেঁয়াজের বাজার অস্থির ছিল। তখন আমি একটা রিপোর্ট দিয়েছিলাম। তার প্রেক্ষিতে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল। এখন চার্জার ফ্যান থেকে শুরু করে এসব বিষয়ে যা হচ্ছে, সরকার এবং বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে জানিয়েছি।
ভয়েস অফ আমেরিকা: পেট্রল পাম্প নিয়ে অনেকের অভিযোগ আছে। আপনারা অভিযানও চালিয়েছেন, চালাচ্ছেন। কী পেলেন?
এ এইচ এম সফিকুজ্জামান: অভিযানে আমরা তিনটি সমস্যা শনাক্ত করেছি: তেল কম দিচ্ছে, ভেজাল তেল দিচ্ছে; আরেকটা হলো অনেক পাম্পের লাইসেন্স আপডেটেড নেই। এখানে আমি লাইসেন্সও দেই না, তেলের ভেজালও দেখি না। বিএসটিআই কিংবা বিস্ফোরক অধিদপ্তর যাদেরই জানানোর দরকার অফিসিয়ালি জানাই।
ভয়েস অফ আমেরিকা: তেলের বিষয়ে বিএসটিআই-এর কাছে আপনি একটি চিঠিও দিয়েছিলেন। তার সর্বশেষ অবস্থা কী?
এ এইচ এম সফিকুজ্জামান: বিএসটিআই মাঠে নেমেছে। সারাদেশে অভিযান করছে।
ভয়েস অফ আমেরিকা: আপনি জনবলের সীমাবদ্ধতার কথা বললেন, ব্যবসায়ীদের একাংশের নীতি-নৈতিকতার কথা বললেন। ওদিকে দেশে অর্থনৈতিক সংকটও চলছে। এমন পরিস্থিতিতে কতটা স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারছেন?
এ এইচ এম সফিকুজ্জামান: যথেষ্ট স্বাধীন ভাবে কাজ করতে পারছি। দু-একটা উদাহরণ দেই। কয়েক দিন আগে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সারা দেশের ডায়াগনস্টিক সেন্টার নিয়ে কাজ করেছে। আমি পরের দিন সকালেই অনলাইনে সারা দেশের কর্মকর্তাদের নিয়ে মিটিং করি। তারপর অভিযানে নামি। ডিজি হেলথ কিন্তু এক-দুদিন পরে নেমেছে। যখন চালের দাম বেড়ে গেল, তখন ভোক্তা অধিদপ্তর থেকেই প্রথমে আমরা পদক্ষেপ নিয়েছি। কোরবানির ঈদের সময় চামড়া ম্যানেজমেন্টে আমরা কাজ করেছি। কোরবানির দিনও মাঠে ছিলাম। ভোজ্যতেলের ক্ষেত্রে বড়বড় করপোরেট প্রতিষ্ঠানের স্টেশনারিতে অভিযান চালিয়েছি। সেসব লাইভ টেলিকাস্ট হয়েছে। কেউ কোনো বাধা দেয়নি। ভোক্তা বা সাধারণ মানুষ এগুলো খুব ইতিবাচকভাবে নিয়েছে।
আপনারা সাংবাদিকরা আমাদের দারুণ সাপোর্ট দিয়েছেন। আপনাদের ইতিবাচক প্রচারের কারণে ভোক্তারা সচেতন হচ্ছেন। তাদের অধিকারের বিষয়ে জানছেন। পাশাপাশি বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা খুব সাহায্য করছে। তাদের সঙ্গে চমৎকার একটা বোঝাপড়া আছে। এছাড়া অভিযানের সময় এপিবিএন, পুলিশ, র্যাব যাকেই যখন চাই, তখনই পাই।