ভোক্তাকণ্ঠ ডেস্ক: স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশে অর্থের টানাটানি ও বিদেশি সাহায্য-নির্ভরতার মধ্যেও ব্রিটেনভিত্তিক শেল অয়েলের কাছ থেকে পাঁচটি গ্যাসক্ষেত্র কিনে জাতীয়করণ করেন। এতে জ্বালানি নিরাপত্তা ও জাতীয় সক্ষমতা গড়ে ওঠে। এর মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধুর জ্বালানি চিন্তার বিষয়টি আন্দাজ করা যায়।
স্বাধীনতার ৫০ বছর পর এসেও ওই ক্ষেত্রগুলো আমাদের মোট গ্যাসের ২৫ শতাংশ স্বল্প মূল্যে দেশের শিল্প খাতকে এগিয়ে নিচ্ছে। এরপর থেকে আর কোনো সরকার গত ৪৫ বছরের বেশি সময় এই চেষ্টা করেনি। বরং সামরিক-বেসামরিক যে সরকারগুলো গত ৪৫ বছর শাসন করেছে এবং করছে তাদের মূল লক্ষ হলো জাতীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে দুর্বল করা এবং বিদেশি প্রতিষ্ঠান থেকে সেবার নামে শত শত কোটি টাকা বাড়তি দিয়ে কাজ করা। এই সামগ্রিক চিত্র থেকে গত কয়েক দশকে বাংলাদেশ বেরিয়ে আসতে পারেনি।
বাপেক্স প্রতি তিনটি কূপ খনন করলে একটিতে গ্যাস পায়। আন্তর্জাতিকভাবে এই অনুপাত পাঁচটিতে একটি। আর দেশের মধ্যে বিদেশি কোম্পানিগুলোর অনুপাতও একই রকম। বাপেক্সের কূপপ্রতি খননে ব্যয় ৬০ থেকে ৮০ কোটি টাকা গড়ে। ত্রিমাত্রিক জরিপে প্রতি লাইন কিলোমিটারে খরচ হয় সাড়ে আট লাখ টাকার মতো। সেখানে বাপেক্সকে বসিয়ে রেখে বাপেক্সের নামে ঋণ নিয়ে নেদারল্যান্ডসে নিবন্ধিত গাজপ্রমকে দিয়ে কূপ খনন করা হয় তিন গুণ দামে। ইতিমধ্যে ১৭টি কূপ খনন করেছে গাজপ্রম। এর মধ্যে ৫টি কূপ বালি-পানি উঠে বন্ধ হয়ে গেছে। সেসব কূপ আবার বাপেক্সকেই চালু করতে হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে গাজপ্রম নামে কথিত কোম্পানিটির সক্ষমতাও বোঝা যায়। মূলত এটি একটি কমিশন এজেন্ট কোম্পানি। তারা ন্যাশনাল ইলেকট্রিক বিডি নামে একটি প্রতিষ্ঠানকে লোকাল এজেন্ট বানিয়েছে। মহাক্ষমতাধর সেই কোম্পানি প্রতিটি কূপ খননে গাজপ্রমের জন্য বরাদ্দ নিয়েছে ২৪০ কোটি টাকা। গাজপ্রমের বাংলাদেশে কোনো অফিসও নেই, লোকবলও নেই। তারা এরিয়াল নামে একটি আজারবাইজানি কোম্পানির কাছে তাদের অনুমতি দেড় শ কোটি টাকার কমে বিক্রি করে দিয়েছে। তারা শুধু কাগজ বিক্রি করেই প্রতি কূপে ১০০ কোটি টাকার বেশি কমিশন নিয়েছে।
এ রকম পরিস্থিতিতে সরকারের পেট্রোবাংলা ৪৬টি কূপ খনন করতে চায়। এলএনজির ওপর নির্ভরশীলতা কমাতে দেশীয় গ্যাস উত্তোলনের বিকল্প নেই। দেশীয় গ্যাসের অংশ বাড়িয়ে এলএনজি আমদানি বন্ধ করা দরকার। কিন্তু দেশীয় গ্যাস কে উত্তোলন করবে? সেই গাজপ্রম বা বিদেশি কোনো প্রতিষ্ঠান? তাহলে সেই খরচ তো শেষ পর্যন্ত প্রতি কূপে গিয়ে দাঁড়াবে ২৪০ কোটি টাকা। অথচ বাপেক্সের ছয়টি রিগ আছে। তার মধ্যে দুটি মেরামতের কাজ চলছে। এই রিগ দিয়ে বছরে অন্তত ১০টি কূপ খনন করা সম্ভব। চার বছরে ৪০টি কূপ খনন করা যাবে শুধু বাপেক্সের রিগ দিয়ে। প্রয়োজনে বিদেশ থেকে রিগ ও বিশেষজ্ঞ প্রকৌশলী ভাড়া করে এনে দ্রুত এই ৪৬টি কূপ খনন করা যায়। তাতে খরচও কমে আসবে।
যদি এসব না করে স্থানীয় কমিশন এজেন্টের ব্যবসা বাড়াতে, বেআইনিভাবে তাদের অর্থ দিতে এই ৪৬টি কূপ খনন করা হয় তাহলে দুটি ঝুঁকি রয়েছে। এক. কাঙ্ক্ষিত গ্যাস নাও পেতে পারে। কারণ এ ধরনের কমিশন এজেন্টের কোম্পানিগুলো নাইকোর মতো অদক্ষ হয়। এতে যদি কোনো ক্ষতি হয় তাহলে গোটা জ্বালানি খাত ধ্বংস হয়ে যাবে, সরকারও বিপদে পড়বে। অন্যদিকে বাড়তি দামে এসব কূপ খনন করলে তা দেশের অর্থনীতির জন্য কোনোভাবেই ভালো হবে না।
সাশ্রয়ী মূল্যে গ্যাস সরবরাহ করা সরকারের সাংবিধানিক দায়িত্ব। সেই দায়িত্ব যেমন পালন করতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করতে হবে। তেমনি খেয়াল রাখতে হবে, নিজস্ব গ্যাস উৎপাদন বাড়ানোর প্রক্রিয়াটিতে যেন স্বচ্ছ ও জনবান্ধব নীতির প্রতিফলন ঘটে। তা না হলে এটিও রেন্টাল কুইক রেন্টালের মতো একটি গণ-লুটপাটের নজির হয়ে থাকবে। দৈনিক বাংলা।