ভোক্তাকণ্ঠ রিপোর্ট: মুসলমানদের কাছে জমজমের পানি অতি বরকতময় ও পবিত্র। পবিত্রতা ও বৈশিষ্ট্যে জমজম কূপের পানি পৃথিবীর সকল পানির চেয়ে উত্তম। পবিত্র কাবাঘর থেকে ২১ মিটার দক্ষিণ-পূর্ব কোণে অবস্থিত এই জমজম কূপ। হজ বা ওমরাহ পালন করতে গেলে এ পানি পান, ওজু ও গোসলের জন্য ব্যবহারের সুযোগ পান দূরবর্তী এলাকার মানুষ। অনেকেই বাড়ি ফেরার সময় পরিবার-পরিজনদের জন্য জমজমের পানি সঙ্গে করে নিয়ে আসেন। সৌদি আরবে ব্যবহারের সময় বা দেশে নিয়ে আসার সময় পানির জন্য কোন টাকা দিতে হয় না।
পবিত্র এ পানি এখন চড়া দামে বিক্রি হচ্ছে বাংলাদেশে। রাজধানীর জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররম মার্কেট এলাকায় প্রায় ২০০ থেকে ২৫০ জন আতর-টুপি-গোলাপজল ব্যবসায়ী জমজম কূপের এই পবিত্র পানির ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন। প্রতি লিটার জমজমের পানি বিক্রি হচ্ছে দুই থেকে তিন হাজার টাকায়। মার্কেটের প্রায় সব দোকানেই ২৫০ মি.লি. জমজমের পানি ৩০০ থেকে ৩৫০ টাকা খুচরা দরে বিক্রি করা হয়।
অভিযোগ রয়েছে, জমজমের পানির সঙ্গে সাধারণ পানি মিশিয়ে ভোক্তার সঙ্গে প্রতারণাও করছেন অনেক ব্যবসায়ী। দোকানের সামনে জমজম পানির একটা বোতল রেখে দেয়, তারপর ওই বোতল দেখিয়ে ব্যবসা করে। এটা নিয়ে কয়েকবার ঝামেলাও হয়েছে। খুচরা কিনলে তো সাধারণ মানুষ আর বোঝে না কোনটা আসল জমজমের পানি আর কোনটা ভেজাল।
জানা যায়, জমজমের পানির পাঁচ লিটারের বোতল সৌদি আরব থেকে আনা হয়। কেউ এটা একসঙ্গে বিক্রি করেন, আবার কেউ খুচরা বিক্রি করেন। তবে খুচরা ২৫০ মি.লি. বোতলেও বিক্রি হয়।
জমজমের পানি আসল না কি নকল যাচাই করতে বায়তুল মোকাররম মার্কেটে অভিযান চালায় জাতীয় ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর।
রোববার দুপুরে এই অভিযানে নেতৃত্ব দেন অধিদপ্তরের ঢাকা জেলা কার্যালয়ের অফিস প্রধান ও সহকারী পরিচালক মো. আব্দুল জব্বার মণ্ডল এবং সহকারী পরিচালক রজবী নাহার রজনী।
এ সময় কয়েকটি দোকানে অভিযান চালানো হয়। বায়তুল মোকাররম মার্কেটের আতর-টুপির দোকানে পাওয়া যায় জমজমের পানি। এ পানি কিভাবে দেশে এলো? এই পানি আসল না কি নকল? এই পানি বিক্রির বৈধতা আছে কি না? এসব বিষয়ে জানতে চান ভোক্তা অধিদপ্তরের কর্মকর্তা।
জমজম পানি ব্যবসায়ী জানান, হজ বা ওমরাহ করে দেশে ফেরার সময় হাজিরা জমজমের পানি নিয়ে আসেন। চাহিদার থেকে অতিরিক্ত পানি নিয়ে আসেন হাজিরা। পরে সেগুলো মার্কেটের অনেক ব্যবসায়ীর কাছে বিক্রি করেন।
এই পানি আসল না কি নকল এ বিষয়ে ব্যবসায়ীদের কোন ধারণা নেই। ব্যবসায়ীরা জানান, বিশ্বাসের উপর ভিত্তি করে এসব পানি বিক্রি করছেন।
জমজমের পানি বিক্রির বৈধতার বিষয়ে ব্যবসায়ীরা জানান, জমজমের পানি বৈধ ভাবে কেউ আমদানি করে না। হাজিরা সঙ্গে করে নিয়ে আসেন। হাজিদের কাছ থেকে কিনে খুচরা বিক্রি করা হয়। জমজমের পানির চাহিদা থাকায় বেশ ভালো দামে বিক্রি হয়।
বায়তুল মোকাররম মার্কেট ব্যবসায়ী মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক বলেন, ‘এই মার্কেটে জমজমের পানি বিক্রি হয়, এটা আমার জানা ছিল না। আমি নিজেও হজ করে আসার সময় জমজমের পানি সঙ্গে নিয়ে এসেছিলাম। তবে সেগুলো পরিবার-পরিজনকে দিয়েছি। হাজিরা এসব পানি বিক্রি করে, এ কথা আমার বিশ্বাস হয় না।’
তিনি বলেন, ‘যেসব ব্যবসায়ী জমজমের পানি বিক্রি করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। যাতে পরবর্তীতে এই পানি আইন অমান্য করে বিক্রি না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখা হবে এবং ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
এই পানি বিক্রি করার বিষয়ে ইসলামে কি ব্যাখ্যা আছে, জানতে ইসলামী ফাউন্ডেশনের একজন মুফতির সঙ্গে কথা বলেন ভোক্তা অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা। বৈধ ভাবে জমজমের পানি এনে বিক্রি করা যাবে বলে জানিয়েছেন মুফতি।
অভিযান শেষে ভোক্তা অধিদপ্তরের মো. আব্দুল জব্বার মণ্ডল বলেন, ‘বায়তুল মোকাররম মার্কেটে যেসব ব্যবসায়ী জমজমের পানি বিক্রি করছেন সবাইকে সোমবার ভোক্তা অধিদপ্তরের প্রধান কার্যালয়ে উপস্থিত হতে বলা হয়েছে। জমজমের পানি বিক্রির বিষয়ে ব্যবসায়ীরা যেসব তথ্য দিয়েছে সেগুলো যাচাই-বাছাই করা হবে। যেহেতু জমজমের পানির সঙ্গে ধর্মীয় বিষয় জড়িত, তাই আলোচনার মাধ্যমে এ বিষয়ে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।’
জমজমের অশেষ কল্যাণ ও বরকতের কথা অনেক হাদিসে এসেছে। হযরত আবুবকর সিদ্দিক (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘রাসুল (সা.) জমজমের পানি সম্পর্কে বলেছেন যে, জমজমের পানি হচ্ছে বরকতময় ও তৃপ্তিদায়ক।’
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, ‘রাসুল (সা.) বলেছেন- পৃথিবীর সর্বোত্তম পানি হচ্ছে জমজমের পানি।’
এ পানি শুধু তৃষ্ণাই নিবারণ করে না, এর মধ্যে ক্ষুধা নিবারণেরও যোগ্যতা রয়েছে। মানুষের শরীরের স্বস্তিও প্রবৃদ্ধি করে এবং হজমে সহায়তা করে। এছাড়া জমজমের পানির বাহ্যিক বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য রয়েছে। এ পানি সম্পূর্ণ জীবাণুমুক্ত। জমজম কূপের আরও একটি অসাধারণ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে- এ থেকে লাখ লাখ লিটার পানি উত্তোলন করলেও এর পানিতে কখনও স্বল্পতা দেখা যায় না। মূলত জমজম কূপ মহান আল্লাহতায়ালার এক কুদরতের নিদর্শন।
১৯৭৯ সালে (জামাদিউল উলা মাসের ১৭ তারিখ ১৩৯৯ হিজরী) ভালো করে পাক পবিত্র করে একজনকে নামানো হয় এ পানির ভেতর পরিস্কার করার জন্য। তিনি জমজম কুপের নিচ থেকে বিভিন্ন প্রকার আসবাব (থালা, বাটি) ধাতব পদার্থ (মুদ্রা), মাটির পাত্র পান, কিন্তু বিভিন্ন প্রকার জিনিস ফেলার পরও এ পানি কুদরতী ভাবে সম্পূর্ণ দূষণমুক্ত ছিল।
রাসুল (সা.) বলেছিলেন, ‘অসুস্থতা থেকে এটি একটি আরোগ্য/শেফা। জমজমের পানি কোন লবনযুক্ত বা তরলায়িত পানি নয়, তবে এ পানি পান করলে এটার একটি স্বতন্ত্র স্বাদ অনুভূত হয়, যা কেবল পানকারী অনুভব করতে পারে। জমজম কূপের পানি হচ্ছে এমন একটি পানি, যা কখনো জীবাণু দ্বারা আক্রান্ত হয়নি।
আরও অভিযান
ভোক্তা স্বার্থবিরোধী অপরাধে বায়তুল মোকাররম মার্কেটের গ্রামীণ সুইটস নামের একটি প্রতিষ্ঠানকে ১০ হাজার টাকা এবং আলাউদ্দিন কনফেকশনারীকে পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়।