ভোক্তাকণ্ঠ ডেস্ক: দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার্থীদের বার্ষিক মাথাপিছু ব্যয়ে বৈষম্য বাড়ছে। ৫০ বিশ্ববিদ্যালয়ে সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন খরচের মধ্যে পার্থক্য বিস্তর। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে যেখানে শিক্ষার্থীপ্রতি বার্ষিক ব্যয় মাত্র ৭৪৩ টাকা, সেখানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অ্যাভিয়েশন অ্যান্ড অ্যারোস্পেস ইউনিভার্সিটিতে একজন শিক্ষার্থীর পেছনে বছরে ব্যয় সাত লাখ ৮৮ হাজার টাকার বেশি।
আবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এই খরচ এক লাখ ৮৫ হাজার টাকা। ২০২১ সালে ২২টি বিশ্ববিদ্যালয়ের খরচ বেড়েছে, কমেছে ১৬টির। নতুন কয়েকটির আয়-ব্যয়ের হিসাব আসেনি।
বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) ৪৮তম বার্ষিক প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে। প্রতিবেদনে দেখা যায়, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার্থীপিছু সরকারের বার্ষিক ব্যয়ে যে বিস্তর ব্যবধান আগে থেকেই ছিল, তা রয়ে গেছে। ২০২১ সালে দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে সরকার শিক্ষার্থীপিছু সবচেয়ে বেশি ব্যয় করেছে তুলনামূলক নতুন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অ্যাভিয়েশন অ্যান্ড অ্যারোস্পেস ইউনিভার্সিটিতে। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে একজন শিক্ষার্থীর পেছনে ওই বছর খরচ হয়েছে সাত লাখ ৮৮ হাজারের বেশি টাকা। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ব্যয় খুলনা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ৫ লাখ ৯৩ হাজার টাকা ব্যয় করা হয়েছে। সেখানে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন কলেজগুলোর শিক্ষার্থীপ্রতি ব্যয় মাত্র ৭৪৩ টাকা।
মাথাপিছু ব্যয় বেড়েছে ২২ বিশ্ববিদ্যালয়ে
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, হাজী মুহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়, যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয়, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়, রাঙ্গামাটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়, বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মাথাপিছু ব্যয় বিগত বছরের তুলনায় বেড়েছে।
১৬ বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যয় কমেছে
২০২১ সালে শিক্ষার্থীপিছু ব্যয় কমেছে, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি ও এনিম্যাল সাইন্সেস বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালস, বঙ্গবুন্ধ শেখ মুজিবুর রহমান মেরিটাইম বিশ্ববিদ্যালয় ও শেখ হাসিনা বিশ্ববিদ্যালয়ে।
জানতে চাইলে ইউজিসির সদস্য (পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়) অধ্যাপক ড. দিল আফরোজা বেগম বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের অবকাঠামো ও শিক্ষার্থী অনুপাতে ইউজিসি বরাদ্দ দেয়। প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব আয় ও সরকারি বরাদ্দের ওপর শিক্ষার্থীর মাথাপিছু ব্যয় নির্ধারণ হয়। পুরাতন বড় বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী ও বিভাগের সংখ্যা বেশি হওয়ায় সেখানে প্রতিষ্ঠানে নিজস্ব আয় এবং সরকারি বরাদ্দ বেশি হয়। সেখানে শিক্ষার্থীর মাথাপিছু ব্যয়ের পরিমাণ বেড়ে যায়। অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে সেটি কম হয় বলে বৈষম্য তৈরি হয়।
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মশিউর রহমান বলেন, বিশেষায়িত বিশ্ববিদ্যালয় হওয়ার কারণে সেখানে ব্যয় বেশি হয়। সরকারই অধিকাংশ অর্থ বহন করে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনায় জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের খরচ অনেক কম। ইউজিসি থেকে তাদের কোনো বরাদ্দ দেওয়া হয় না। সেজন্য জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জন্য চ্যালেঞ্জ অনেক বেশি। দৃশ্যমান বৈষম্যের কারণে অনেক ক্ষেত্রে তারা পিছিয়ে পড়ে। শিক্ষা সীমিত হওয়া উচিত নয়, উচ্চশিক্ষা সীমিত করা প্রযোজন।
তিনি বলেন, উচ্চশিক্ষার জন্য বরাদ্দ কম হলে তার মান বাড়ানো কঠিন হয়ে পড়ে। উচ্চশিক্ষা সীমিত মানুষের মধ্যে হলে সেখানে একটি বিষয়ভিত্তিক গভীরতা তৈরি করে। আমাদের বরাদ্দ দিচ্ছে না অভিযোগ করলেই হবে না, আমাদের মৌলিক জায়গায় ভাবতে হবে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে শিক্ষাবিদ ও ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, শিক্ষার্থীদের মাথাপিছু ব্যয়ের বিষয়টি নির্ধারণ হয় সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্বিক পরিস্থিতির ওপর। তবে বড় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জন্য বেশি ব্যয় আর ছোটগুলোর কম হলে এক ধরনের বৈষম্য তৈরি হয়। স্বাভাবিকভাবে মেডিকেল ও কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জন্য বেশি ব্যয় হয়। তবে খাত অনুযায়ী শিক্ষার্থীদের পেছনে ব্যয়টা সমান হওয়া প্রয়োজন।
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে কমছে বিদেশি শিক্ষার্থী
দেশে ৫০টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা কার্যক্রম চললেও বিগত সময়ের চেয়ে ২০২১ সালে বিদেশি শিক্ষার্থী ভর্তি কমেছে। গত ১০ বছরের পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ২০২১ সালে বিদেশি শিক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল ৫২৫ জন, ২০১৩ সালে কমে ৩২৬, ২০১৪ সালে কিছুটা বেড়ে ৪৩২, ২০১৫ সালে তা বেড়ে ৫৯৩, ২০১৬ সালে ৩৫৫, ২০১৭ সালে ৪৬১, ২০১৮ সালে প্রায় দ্বিগুণ ৮০৪, ২০১৯ সালে কমে ৪৮২ জন, ২০২০ সালে ৭৬২ এবং ২০২১ সালে কমে ৬৭৭ জনে দাঁড়ায়।
বিদেশি শিক্ষার্থী বেড়েছে বেসরকারিতে
বিগত ১০ বছরের পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, এ সময়ের মধ্যে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে বিদেশি শিক্ষার্থী ভর্তির সংখ্যা খুব বেশি উত্থান-পতন হয়নি। ২০১২ সালে ২১৬৭ জন, ২০১৩ সালে ১৯৩৮, ২০১৪ সালে ২০৭৫, ২০১৫ সালে ২১৪০, ২০১৬ সালে ২২৮২, ২০১৭ সালে ২৪৩৮, ২০১৮ সালে ২১৯০, ২০১৯ সালে ১৯৪৯, ২০২০ সালে ২৩১৭ ও ২০২১ সালে ২২৮১ জন বিদেশি শিক্ষার্থী বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন।
বিদেশি শিক্ষার্থী কমে যাওয়ার কারণ হিসেবে শিক্ষাবিদ সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, ইংরেজি মিডিয়াম থেকে পাস করা শিক্ষার্থীরা যে ধরনের সিলেবাস ও কারিকুলাম পড়ে আসে তারা ঢাকাসহ অন্যান্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির ক্ষেত্রে সুবিধা করতে পারে না। এরা কোচিং সেন্টারে গেলেও তেমন সুবিধা করতে পারে না বলে ইংরেজি মিডিয়ামে পড়ুয়া ছেলেমেয়েরা প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে আগ্রহী হয়ে উঠছে।
তিনি বলেন, এমনিতে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা কঠিন হয়। পছন্দের বিষয় পড়ার সুযোগ পায় না। যেসব বিষয় পায় সেগুলোতে পড়তে চায় না। কর্মজীবনে এসব বিষয় পড়ে ভালো ক্যারিয়ার গড়তে পারবে না বলে তারা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে।
‘আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে বিদেশি শিক্ষার্থীদের আকর্ষণীয় করা অনেক কঠিন হবে। আবাসন সমস্যা, নিম্নমানের খাবার, বিশ্ব র্যাংকিং থেকে পিছিয়ে থাকাসহ নানা কারণে তারা আমাদের দেশে পড়তে আসতে চায় না। আগে বিদেশি শিক্ষার্থীর সংখ্যা বেশি থাকলেও দিন দিন তা কমে যাচ্ছে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করা গেলে বিশ্ব র্যাংকিংয়ে আমরা এগিয়ে যাবো। বিদেশি শিক্ষার্থীরা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে আগ্রহী হয়ে উঠবে।’ বলেন এই শিক্ষাবিদ।
সার্বিক বিষয়ে ইউজিসির সদস্য অধ্যাপক ড. বিশ্বজিৎ চন্দ বলেন, উচ্চশিক্ষার মান নিশ্চিত করতে ইউজিসির ৪৮তম বার্ষিক প্রতিবেদনে যুগপোযোগী ১৭টি সুপারিশ করা হয়েছে। বিশ্ব র্যাংকিং থেকে আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অনেক পিছিয়ে। সে কারণে দেশের মধ্যে একটি অভ্যন্তরীণ র্যাংকিং কমিটি গঠন করতে বলা হয়েছে। এ কমিটি শিক্ষাবিদ ও গুণী ব্যক্তিদের নিয়ে করা যেতে পারে। তারা দেশের মধ্যে সব বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে র্যাংকিং তৈরি করবেন। যারা এতে এগিয়ে যাবে তাদের সুনাম দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়বে। এর মাধ্যমে সবার মধ্যে ভালো করার প্রবণতা বাড়বে।
সৌজন্যে, জাগো নিউজ।