অনলাইন ডেস্ক: কোভিড-১৯ বিষয়ক একটি নতুন গবেষণায় উঠে এসেছে চমকপদ তথ্য। গবেষণাটি ৫১ থেকে ৮১ বছর বয়সী ব্যক্তিদের ওপর করা হয়েছিল। প্রাথমিকভাবে গবেষণার পর ওই ব্যক্তিদের শরীরে ঘ্রাণ অনুভূতি সম্পর্কিত মস্তিষ্কের অঞ্চলে সংকোচন এবং টিস্যুর ক্ষতি লক্ষ্য করা গেছে। অর্থাৎ কোভিড-১৯ মস্তিষ্কের ধূসর পদার্থ এবং টিস্যুর ক্ষতির কারণ হতে পারে বিশেষ করে সেইসব লোকেদের যারা ভাইরাসে সেভাবে আক্রান্ত হননি, একটি নতুন গবেষণায় উঠে এসেছে এই তথ্য। কোভিড সংক্রমিত হওয়ার আগে এবং কয়েক মাস পরে আক্রান্ত ব্যক্তিদের মস্তিষ্কের স্ক্যান করার পর সমীক্ষাটি নেচার জার্নালে প্রকাশিত হয়। স্নায়বিক বিশেষজ্ঞরা এই গবেষণায় সরাসরি জড়িত না থাকলেও তারা সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন যে এই ভাইরাস মানুষের শরীরে দীর্ঘস্থায়ী ক্ষতির কারণ হতে পারে যেমন মানুষের চিন্তাভাবনা, স্মৃতিশক্তিকে প্রভাবিত করা।
গবেষণাটি ৫১ থেকে ৮১ বছর বয়সী ব্যক্তিদের ওপর করা হয়েছিল। প্রাথমিকভাবে গবেষণার পর ওই ব্যক্তিদের শরীরে ঘ্রাণ অনুভূতি সম্পর্কিত মস্তিষ্কের অঞ্চলে সংকোচন এবং টিস্যুর ক্ষতি লক্ষ্য করা গেছে।
ইয়েল স্কুল অফ মেডিসিনের স্নায়বিক সংক্রমণ এবং গ্লোবাল নিউরোলজির প্রধান ডাঃ সেরেনা স্পুডিক জানাচ্ছেন, ”আমার কাছে বেশ বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ আছে যে কোভিড আক্রান্ত কিছু রোগীর মস্তিষ্কে পরিবর্তন হয়। শুধু তাই নয় রোগীদের শরীরে কিছু দীর্ঘমেয়াদী ক্লিনিকাল প্রভাবও পরিলক্ষিত হয়েছে। তবে এসব বলে আমরা জনসাধারণকে ভয় দেখাতে চাই না এবং তাদের ভাবাতে চাই না যে প্রত্যেকের মস্তিষ্কের ক্ষতি হবে এবং ভবিষ্যতে তারা কাজ করতে সক্ষম হবে না।’ গবেষণায় যুক্তরাজ্যের বায়োব্যাঙ্কে ৭৮৫ জন অংশগ্রহণকারী ছিলেন।
এদের মধ্যে ৪০১ জনের শরীরে করোনা ভাইরাসের উপস্থিতি দেখা গেছে। তারা সবাই মার্চ ২০২০ থেকে এপ্রিল ২০২১ এর মধ্যে সংক্রামিত হয়েছিলেন। ৩৮৪ জন অন্য অংশগ্রহণকারীদের নিয়ে একটি আলাদা গোষ্ঠী গঠন করা হয়েচিল কারণ তারা করোনা ভাইরাস দ্বারা সংক্রামিত হয়নি।
গবেষকরা বলছেন, বয়স বাড়ার সাথে সাথে মানুষ প্রতি বছর ধূসর পদার্থের একটি ক্ষুদ্র ভগ্নাংশ হারায়। উদাহরণস্বরূপ, স্মৃতির সাথে সম্পর্কিত অঞ্চলে, সাধারণ বার্ষিক ক্ষতি ০.২ শতাংশ এবং ০.৩ শতাংশের মধ্যে। গবেষণায় দেখা গেছে কোভিড রোগীরা- যারা সংক্রমণের পর গড়ে সাড়ে চার মাস তাদের মস্তিষ্কের স্ক্যান করেছেন- তারা অসংক্রমিত অংশগ্রহণকারীদের চেয়ে মস্তিষ্কের ধূসর পদার্থ বেশি হারিয়েছেন, তিন বছরে তাদের বিভিন্ন মস্তিষ্ক অঞ্চলে ০.২ শতাংশ থেকে ২ শতাংশ পর্যন্ত ধূসর পদার্থ ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে।তারা সামগ্রিক মস্তিষ্কের ভলিউম হারিয়েছে এবং বেশ কিছু এলাকায় টিস্যুর ক্ষতি দেখিয়েছে। গবেষকরাও এতটা পরিবর্তন আশা করেননি। এই গবেষণাটি আরো বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য এই কারণে যে, মস্তিষ্কের এই প্রভাবগুলি যাদের মধ্যে দেখা গেছে তারা গুরুতর কোভিড রোগী ছিলেন না। প্রাথমিক উপসর্গ থাকায় হাসপাতালে ভর্তির প্রয়োজনও পড়েনি তাঁদের। গবেষণার প্রধান লেখক, অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লিনিকাল নিউরোসায়েন্স বিভাগের অধ্যাপক গোয়েনায়েল ডাউড বলেছেন যে যদিও গবেষণায় হাসপাতালে ভর্তি রোগীর সংখ্যা ছিল ১৫, চূড়ান্ত তথ্য প্রদানের জন্য খুবই কম। তবে পরীক্ষার ফলাফলগুলি থেকে জানা যায় যে তাদের মস্তিষ্কের অ্যাট্রোফি মৃদু পীড়িত রোগীদের চেয়ে খারাপ ছিল। কোভিড আক্রান্ত ব্যক্তিরাও একটি জটিল কাজ সম্পাদনে মনোযোগ এবং দক্ষতা সম্পর্কিত জ্ঞানীয় পরীক্ষায় অসংক্রমিত ব্যক্তিদের তুলনায় বেশি পতন দেখিয়েছেন।
তবে অন্য এক গবেষক ডাঃ ডৌউড যিনি এই গবেষণার সঙ্গে জড়িত ছিলেন না তিনি উল্লেখ করেছেন যে জ্ঞানীয় পরীক্ষাটি প্রাথমিক ছিল, তাই কোভিড রোগীদের ধূসর পদার্থের ক্ষতি এবং টিস্যুর ক্ষতি তাদের জ্ঞানীয় দক্ষতাকে প্রভাবিত করেছে কিনা সে সম্পর্কে গবেষণাটি খুব সীমিত। কোভিডের নিউরোসাইকিয়াট্রিক প্রভাব নিয়ে গবেষণারত লিভারপুল বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নায়বিক সংক্রমণের সহযোগী অধ্যাপক ডাঃ বেনেডিক্ট মাইকেল-এর দাবি, অংশগ্রহণকারীদের কেউই মস্তিষ্কের বেশ কিছু অঞ্চলে উল্লেখযোগ্য ঘাটতি আছে কিনা তা জানার জন্য যথেষ্ট জ্ঞানীয় পরীক্ষার সুযোগ পায়নি। তাই এখনই বলা ঠিক হবে না যে তাদের মস্তিষ্কের ধূসর পদার্থের বড় ক্ষতি হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, ধূসর পদার্থের সবচেয়ে বড় ক্ষতির কিছু অংশ গন্ধের সাথে সম্পর্কিত, অরবিফ্রন্টাল কর্টেক্স এবং প্যারাহিপ্পোক্যাম্পাল গাইরাস সহ, সেই অঞ্চলগুলি স্মৃতি এবং অন্যান্য ফাংশনের সাথে জড়িত। কিন্তু কোভিড রোগীরা মেমরি পরীক্ষায় অসংক্রমিত অংশগ্রহণকারীদের চেয়ে খারাপ পারফরম্যান্স করেনি, বলছেন ডাঃ ডৌউড। যদিও তিনি যোগ করেছেন যে তারা যে মেমরি পরীক্ষাগুলি নিয়েছিলেন তা সংক্ষিপ্ত এবং মৌলিক ছিল। পরীক্ষার সময়ে যেখানে কোভিড রোগীদের ঘাটতি দেখা গেছে তা হল ট্রেল-মেকিং টেস্ট, কোভিড রোগীরা পরীক্ষাটি সম্পূর্ণ করতে বেশি সময় নিয়েছে। ডক্টর ডৌউড বলেছেন যে কাজের গতি হ্রাস পাওয়ার ক্ষমতা মস্তিষ্কের সেরিবেলামের একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলে ধূসর পদার্থের ক্ষতির সাথে সম্পর্কিত।
অধ্যয়নের একটি উল্লেখযোগ্য সীমাবদ্ধতা প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে ডঃ ডৌউড বলেন, গবেষকদের কাছে মানুষের উপসর্গ সম্পর্কে পুরো তথ্য ছিল না, যার মধ্যে একটি হল তাঁরা ঘ্রাণশক্তি হারিয়েছেন কিনা। গবেষকরা কোন রোগীর দীর্ঘমেয়াদী কোভিড ছিল কিনা তাও সনাক্ত করতে পারেনি, তাই ফলাফলগুলি সেই দীর্ঘমেয়াদী অবস্থার সাথে সম্পর্কিত কিনা তা স্পষ্ট নয়। সংক্রমিত এবং অসংক্রমিত ব্যক্তিদের মধ্যে পার্থক্য বয়সের সাথে বৃদ্ধি পায়। উদাহরণস্বরূপ, ট্রেল-মেকিং টেস্টে ৫০ এবং৬০-বছর বয়সী লোকেদের উভয় গ্রুপেই পারফরম্যান্স একই ছিল, কিন্তু তার পরে ব্যবধান উল্লেখযোগ্যভাবে প্রসারিত হয়েছিল। অল্পবয়সী লোকেরা তাড়াতাড়ি সেরে ওঠেন বলে হয়তো তাদের মস্তিষ্কে সেভাবে কোভিডের প্রভাব পড়েনি।
বাইরের বিশেষজ্ঞরা এবং অধ্যয়নের লেখকরা বলেছেন যে মস্তিষ্কের অঞ্চলগুলির পরিসর যেখানে কোভিড রোগীরা বেশি ধূসর পদার্থের ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে তা বেশকিছু কৌতূহলী প্রশ্ন উত্থাপন করে। যেমন ডঃ ডৌউড বলছেন, সংক্রমিত অংশগ্রহণকারীদের মস্তিষ্কের এমন কিছু অংশ রয়েছে যেখানে ধূসর পদার্থের ক্ষতি হয়েছে অথচ সেগুলির সঙ্গে গন্ধের কোনও সম্পর্ক নেই এবং যেগুলি গন্ধের সাথে সম্পর্কিত সেগুলি মস্তিষ্কের অন্যান্য কাজের সাথে জড়িত।” মস্তিষ্কের পরিবর্তনের কারণ এখনো অস্পষ্ট গবেষকদের কাছে।
ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ নিউরোলজিক্যাল ডিসঅর্ডারস অ্যান্ড স্ট্রোকের স্নায়ুতন্ত্রের সংক্রমণের বিভাগের প্রধান ডাঃ অবীন্দ্র নাথ, যিনি এই গবেষণায় জড়িত ছিলেন না, তিনি একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন তুলেছেন। সেটি হল, মস্তিষ্কের পরিবর্তনগুলি কোভিড রোগীদের ক্ষেত্রে কি ডিমেনশিয়ার জন্ম দিতে পারে? পাশাপাশি আরো একটি বিষয় হল গবেষকরা নন-কোভিড নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত রোগীদের মস্তিষ্কের একই পরিবর্তন খুঁজে পাননি। আর তাই ডাঃ নাথ অন্যান্য করোনা ভাইরাস বা ফ্লুতে আক্রান্ত রোগীদের অধ্যয়ন করার পরামর্শ দিয়েছেন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কোভিড আক্রান্ত ব্যক্তিদের মানসিক লক্ষণ, আচরণগত উপাদান এবং স্নায়বিক বিষয়গুলি নিয়ে আরো পরীক্ষা নিরীক্ষার প্রয়োজন আ