ভোক্তাকণ্ঠ ডেস্ক: শীতের বিদায় আর গরমের আগমনের সঙ্গে সঙ্গে রাজধানীতে কিউলেক্স মশার উপদ্রব বেড়েছে। মশার যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছেন নগরবাসী। কিউলেক্স মশার কামড়ে ডেঙ্গুর ভয় না থাকলেও ফাইলেরিয়া বা গোদ রোগ নিয়ে কিছুটা ভয় রয়েছে।
মশার ঘনত্ব বেড়েছে প্রায় আটগুণ : গবেষণা
সম্প্রতি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের এক গবেষণায় দেখা গেছে, রাজধানীতে এলাকাভেদে একজন মানুষকে প্রতিঘণ্টায় গড়ে ১৫০টি মশা কামড়ায়। অন্যান্য বছরের তুলনায় রাজধানীতে আনুপাতিক হারে মশার ঘনত্ব প্রায় আটগুণ বেড়েছে বলে গবেষণায় উঠে এসেছে।
গবেষকরা বলছেন, গত বছরের জুন-জুলাইয়ের তুলনায় এই মার্চে মশার ঘনত্ব প্রায় চার-পাঁচগুণ বাড়তে পারে। আমাদের গবেষক দল বছরের অন্যান্য সময়ে (জুন-জুলাইয়ে) লার্ভার ঘনত্ব পেত প্রতি ডিপে গড়ে ১৫ থেকে ২০টি, যেটি বর্তমানে ৫০-এর বেশি। আবার ম্যান পার আওয়ার উড়ন্ত মশার ঘনত্ব ওই সময় আমরা পেতাম ২০-এর কম, যা বর্তমানে গড়ে ১৫০-এর বেশি।
জানা গেছে, ঢাকার ছয়টি স্থানকে সেন্ট্রিনাল সাইট হিসেবে নিয়ে নিয়মিত লার্ভা ও পূর্ণাঙ্গ মশার তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে পরীক্ষাগারে নিয়ে এসে পরীক্ষা করা হয়। মশার ঘনত্ব, তাপমাত্রা, আর্দ্রতা, বৃষ্টিপাত ও প্রজনন স্থানের পানির গুণাগুণ বিশ্লেষণ করা হয়েছে। এতে গত ৮ মাসের তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে তৈরি করা মডেল অনুসারে গবেষকরা বলছেন মার্চ মাসে মশার ঘনত্ব চরমে পৌঁছাবে।
বৃষ্টি না হওয়া পর্যন্ত কমবে না কিউলেক্স মশা
বিশিষ্ট কীটতত্ত্ববিদ ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার বলেন, শীতের পর হঠাৎ করে তাপমাত্রা বেড়েছে, সে কারণে আমরা প্রচুর মশা দেখতে পাচ্ছি।
তিনি বলেন, এর আগে যে মশাগুলো প্রকৃতিতে লার্ভা হিসেবে ছিল সেগুলো একসঙ্গে ফুটে প্রচুর মশা বের হয়। আর সেই মশার ঝাঁক আমরা এখন দেখতে পাচ্ছি, যা আসলে বৃষ্টি না হওয়া পর্যন্ত কমবে না।
ড. কবিরুল আরও বলেন, সাধারণত শীতের পরে পানির ঘনত্ব বেড়ে যায়। অর্থাৎ অনেকদিন বৃষ্টিপাত না হওয়ায় ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় নালা-নর্দমায় যে পানি থাকে, তা ঘন হয়ে যায়। এই পানিতে জৈব পদার্থের পরিমাণ বেড়ে যায়। এগুলো কিউলেক্স মশার খাবার হিসেবে ব্যবহৃত হয়। ফলে এই সময়ে কিউলেক্স মশার প্রজননটাও বেড়ে যায়।
ড্রেন-ডোবা পরিষ্কার করে লার্ভিসাইড প্রয়োগের দাবি
ঝুঁকি প্রসঙ্গে অধ্যাপক কবীরুল বাশার বলেন, কিউলেক্স মশা আমাদের দেশের কিছু অঞ্চলে ফাইলেরিয়া রোগ ছড়ায়। তবে ঢাকা শহরে এই রোগ ছড়ানোর কোনো ইতিহাস আমরা পাইনি। সুতরাং এই মশা দিয়ে খুব বেশি রোগ ছড়িয়ে যাবে, এমনটা বলার সুযোগ নেই। পাশাপাশি কিউলেক্স মশার কামড়ে যেহেতু ডেঙ্গু হয় না, তাই এই সময়ে ডেঙ্গু ছড়ানোর সম্ভাবনাও আপাতত নেই। তবে এটা আমাদের জন্য একটা বিরক্তির কারণ।
করণীয় প্রসঙ্গে কবিরুল বাশার বলেন, যদি মশাকে ঠিকমতে নিয়ন্ত্রণ না করা হয়, বিশেষ করে ড্রেন, ডোবা, নর্দমা এগুলো পরিষ্কার করে যদি লার্ভিসাইড প্রয়োগ না করা হয়, তাহলে মশা কমবে না। এজন্য আমি বলব প্রতিবছরের জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারিতে যেন সরকার বা সিটি করপোরেশনের উদ্যোগে নালা, নর্দমা ও ড্রেনগুলো পরিষ্কারের একটা অভিযান পরিচালনা করে লার্ভিসাইড প্রয়োগ করা হয়। তাহলে মশা কিছুটা নিয়ন্ত্রণে থাকবে।
কিউলেক্স মশার কামড়ে হয় ফাইলেরিয়া, এ রোগ কী, জটিলতা কেমন?
চিকিৎসকদের মতে ফাইলেরিয়া রোগে মানুষের হাত-পা ও অন্যান্য অঙ্গ অস্বাভাবিক ফুলে ওঠে। একে স্থানীয়ভাবে গোদ রোগ বলা হয়। এটি একটি কৃমি জাতীয় রোগ, যা ক্ষুদ্র পরজীবী জীবাণুর আক্রমণে মানুষের শরীরে সংক্রমিত হয়। এই পরজীবীর জীবাণু মানুষের শরীরে প্রবেশ করে মশার কামড়ে।
চিকিৎসা পরিভাষায় বলা হয়েছে, ফাইলেরিয়া রোগ একটি মারাত্মক রোগ। ফাইলেরিয়া কৃমিজাতীয় রোগ হলেও এই রোগের পরজীবী আমাদের অন্ত্রে বাস করে না। ফাইলেরিয়া জীবাণু রোগীর লসিকানালীতে বৃদ্ধি পেয়ে পূর্ণবয়স্ক হয় এবং লসিকানালীতে প্রদাহের সৃষ্টি করে। কালক্রমে লসিকানালী ফুলে যায় ও বন্ধ হয়ে লসিকা প্রবাহে ব্যাঘাত ঘটায়। ফলে বিভিন্ন ধরনের লক্ষণ প্রকাশ পায়। বাংলাদেশের উত্তরাংশে এই রোগের প্রকোপ সবচেয়ে বেশি।
বাংলাদেশে ফাইলেরিয়া রোগ ছড়ায় মূলত কিউলেক্স মশার দুটি প্রজাতি এবং ম্যানসোনিয়া মশার একটি প্রজাতির মাধ্যমে। এখন পর্যন্ত দেশের ৩৪টি জেলায় ফাইলেরিয়া আক্রান্ত রোগী দেখা গেছে। তবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলছে, ফাইলেরিয়া এন্ডেমিক আকারে ছড়িয়ে আছে দেশের ১৯টি জেলায়।
দু-এক কামড়ে ফাইলেরিয়া হয় না : স্বাস্থ্য অধিদপ্তর
ডা. এমএম আক্তারুজ্জামান বলেন, কিউলেক্স মশায় সাধারণত কোনো জটিলতা তৈরি হয় না। তবে আমাদের ফাইলেরিয়া এন্ডেমিক আছে ১৯টি জেলায়। ওই সব জায়গায় যদি ফাইলেরিয়া রোগী থাকে, তার মাধ্যমে গোদ রোগ ছড়াতে পারে। তবে সেটি কিন্তু দু-একটা মশার কামড়ে হয় না। গোদ রোগ ছড়ানোর জন্য অন্তত ৫০০ থেকে এক হাজার কামড় লাগে। কাজেই সেই আশঙ্কা আপাতত নেই। কারণ আমরা খুব শিগগিরই বাংলাদেশকে গোদ রোগমুক্ত ঘোষণা করতে যাচ্ছি। আমরা ২০১৬ সালের দিকে সার্ভে করে দেখেছি এটি প্রায় মুক্ত হওয়ার পথে।
তিনি আরও বলেন, মশা কামড় দিচ্ছে, তার মানে হলো আমাদের একটি সিগন্যাল দিচ্ছে যে মশা বেড়ে গেছে। এরমধ্যে কিউলেক্স মশার পাশাপাশি এডিস মশাও থাকার সম্ভাবনা আছে। তবে এডিস মশা থাকলেই হবে না, সেই মশাকে ডেঙ্গু রোগের ভাইরাস বহন করতে হবে। সর্বোপরি আমরা এই মুহূর্তে মশা নিয়ে খুব বেশি ঝুঁকি দেখছি না।
রাজধানীতে ডেঙ্গু-চিকুনগুনিয়া কম : স্বাস্থ্য অধিদপ্তর
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার সহকারী পরিচালক ডা. এমএম আক্তারুজ্জামান বলেন, ঢাকায় গত এক বছরে এখন পর্যন্ত চিকুনগুনিয়া নেই। ডেঙ্গু সংক্রমণও এখন একদম নেই বললেই চলে। আমরা যে মশাগুলো দেখছি সেগুলো কিউলেক্স মশা, এগুলো শুধু মানুষের বিরক্তি তৈরি করে; কামড়ায়, চারপাশে ঘুরঘুর করে।
তিনি বলেন, এই মশাগুলো সাধারণত ময়লা-আবর্জনায় হয়ে থাকে। কিন্তু এডিস মশা কিছুটা ভদ্র মশা, জমানো পানিতে এর উৎপত্তি হয়। এখন এডিস মশা এত বেশি নেই। তবে সামনে বর্ষাকাল, এপ্রিল থেকে হয়তো বৃষ্টিপাত শুরু হতে পারে। বৃষ্টিপাত হলেই এডিস মশা বাড়তে শুরু করবে। এজন্য এখন থেকে কর্মপরিকল্পনা হাতে নেওয়া উচিত।
ডেঙ্গু সংক্রমণ কমেছে, মৃত্যু শূন্যের ঘরে
দেশে এডিসবাহিত ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা কমে সন্তোষজনক পর্যায়ে নেমে এসেছে। ডেঙ্গুতে মৃত্যুও শূন্যের কোঠায় নেমেছে।
এ বছর জানুয়ারি মাসে সবচেয়ে বেশি ৫৬৬ জন ডেঙ্গু শনাক্ত হয়েছে, মৃত্যু হয়েছে ৬ জনের। ফেব্রুয়ারি মাসে ডেঙ্গু শনাক্ত হয়েছে ১৬৬ জন, মৃত্যু হয়েছে ৩ জনের। তবে মার্চে এখনো ডেঙ্গুতে কারো মৃত্যু হয়নি।