ভোক্তাকণ্ঠ ডেস্ক: ‘বাংলাদেশে দিন দিন বাড়ছে তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাসের (এলপিজি) চাহিদা। বছরে প্রায় ১৪ লাখ টন এলপিজি ব্যবহার হয় দেশে। ব্যবহারকারী প্রায় দেড় কোটি পরিবার। তবে চাহিদার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে দামও। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে আন্তর্জাতিক বাজারে দরবৃদ্ধি, সঙ্গে ডলার সংকট এবং একই সময়ে পরিবহন খরচ বাড়া এর অন্যতম কারণ।’
বেক্সিমকো গ্রুপের প্রতিষ্ঠান বেক্সিমকো এলপিজির প্রধান বিপণন কর্মকর্তা মেহেদি হাসান গণমাধ্যমের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে এসব কথা বলেন।
প্রশ্ন: এলপিজির সার্বিক পরিস্থিতি কী?
মেহেদি হাসান: ধন্যবাদ, দেশে এ খাতে ৩০ হাজার কোটি টাকার বেশি বিনিয়োগ করেছে ৩০টি কোম্পানি। কারণ, গত এক দশকের মধ্যে শুরুর আট বছর এ খাতের প্রবৃদ্ধি ছিল ২৫ থেকে ৭৯ শতাংশ পর্যন্ত। মূলত বাংলাদেশে বাজার সমীক্ষায় এমন প্রবৃদ্ধি দেখেই বড় বড় কোম্পানি এ খাতে বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
দেশে কোনো খাতে কখনো এত দ্রুত প্রবৃদ্ধি হয়নি, যেটা টানা এলপিজি খাত করেছিল। কিন্তু এ খাতটি হুট করেই থমকে গেছে গত দুই বছরে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্যবৃদ্ধি, দেশে ডলার সংকট এবং পরিবহন খরচ বাড়ায় এ খাতে বড় সমস্যা হয়েছে। শেষ দুই বছর শ্লথ হয়ে গেছে। ২০২২ সালে এ খাতের প্রবৃদ্ধি নেমেছে মাত্র দশমিক ৬ শতাংশে। আর আগের বছর ছিল ১৩ শতাংশ।
প্রশ্ন: বিশ্ব বাজারে এখন এলপিজির দাম কেমন?
মেহেদি হাসান: যেখানে বিশ্ব বাজারে ২০২০ সালে এলপিজির গড় মূল্য ছিল ৪০১ ডলার প্রতি টন, সেটা পরের বছর ৬৩৬ ডলার এবং ২০২২ সালে এসে ৭৩৫ ডলার হয়েছে, যা তিন বছরের ব্যবধানে প্রায় দ্বিগুণ। এছাড়া সেটা পরিবহনে কনটেইনার ভাড়া বেড়েছে ২৮-৩০ শতাংশ। অন্যদিকে, দেশে ৮৬ টাকার ডলারের এলসি এখন ১০৬ থেকে ১১০ টাকা পর্যন্ত ব্যয় করতে হয়েছে।
প্রশ্ন: দেশে কয়েক মাসের ব্যবধানে এলপিজির দাম দ্বিগুণ হয়ে এখন সর্বোচ্চ। কতটা যৌক্তিক?
মেহেদি হাসান: বিশ্ব বাজারে গত বছর এলপিজির গড় মূল্য ছিল ৭৩৫ ডলার প্রতি টন। এর সঙ্গে কমপক্ষে ৯৫ ডলার প্রতি টনে ফ্রেড দিতে হয়েছে। ট্যাক্স-ভ্যাট মিলিয়ে আরও ৩০ ডলার খরচ আছে। তাহলে প্রতি টনের খরচ দাঁড়ায় ৮৬০ ডলার। এ দাম আমাদের ১০৮ টাকা ডলার রেটে এলসি দিতে হয়েছে, যা আগে ৮৫ টাকা ছিল। সে হিসাবে এখন প্রতি টনের খরচ ৯২ হাজার ৮৮০ টাকা। অর্থাৎ ১২ কেজির একটি সিলিন্ডারের দাম পড়ে ১ হাজার ১১৫ টাকা।
এটা শুধু প্রোডাক্টের (এলপিজি) দাম। এরপর সরকারি ভ্যাট ৭ শতাংশ। তাতে যোগ হয় আরও ৭৮ টাকা। এরপর প্রতি সিলিন্ডার বন্দর থেকে ডিলার পর্যন্ত পৌঁছাতে ৭০ টাকা খরচ হয়। পরিবেশকের নির্ধারিত মুনাফা প্রতি সিলিন্ডারে ৩৭ টাকা সরকার নির্ধারিত। খুচরা ব্যবসায়ীর মুনাফা ৩৮ টাকা। সবমিলিয়ে একটি সিলিন্ডারের খরচ দাঁড়ায় এক হাজার ৩৩৮ টাকা। এরপর একটি কোম্পানির মার্জিন রয়েছে। সেখানে শত শত লোক কাজ করছে। হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করা হয়েছে। তাহলে একটি সিলিন্ডারের দাম কত হওয়া উচিত?
প্রশ্ন: এসব বিবেচনায় নিয়ে সরকার আপনাদের সিলিন্ডারের দাম নির্ধারণ করে দিচ্ছে। তবে এরপরও নির্ধারিত দামে ভোক্তা গ্যাস পাচ্ছে না। খুচরা বিক্রেতারা বেশি দাম নিচ্ছে, এটা কেন?
মেহেদি হাসান: দেখুন, আমরা বার বার বলছি, সরকার নির্ধারিত পরিবেশকের মুনাফা এবং খুচরা ব্যবসায়ীর মুনাফা খুবই কম। তারা এটা মানতে পারে না। আমি নিজেও মনে করি যে প্রায় দেড় হাজার টাকার একটি সিলিন্ডার বিক্রি করে ৩৮ টাকা মুনাফা এটা খুব কম। এটা মাত্র আড়াই শতাংশ। এত কম মুনাফা কোনো ব্যবসায় নেই। যেখানে এ ব্যবসা করতে তুলনামূলক বেশি মূলধন লাগে। সরকারি কাগজপত্রের বেশ জটিলতা রয়েছে। এ জন্য তারা মনমতো দামে বিক্রি করছে।
প্রশ্ন: তাহলে তাদের মুনাফা আরও বাড়ানো দরকার বলে আপনি মনে করেন?
মেহেদি হাসান: অবশ্যই। তারা একটি সিলিন্ডার অযৌক্তিক ভাবে একশো-দেড়শো টাকা বেশি নিচ্ছে। তার চেয়ে ভালো একটি আলোচনার ভিত্তিতে তাদের মুনাফা বাড়িয়ে বাজারে নির্ধারিত মূল্য কার্যকর করা। এটা সরকারের উচিৎ। তাতে ভোক্তা ও ব্যবসায়ী উভয়ে উপকার পাবে। ভুল এমআরপির কারণেই কিন্তু বাজারে নির্ধারিত দামে সিলিন্ডার পাওয়া যায় না। বাধ্য হয়ে বেশি দামে বিক্রি করতে হয়। বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনকে (বিইআরসি) এসব বার বার বলা হলেও কাজ হয়নি। আমরা বলছি, দেশে ছোট-বড় মিলে প্রায় ৫০ হাজার দোকানদার সিলিন্ডার বিক্রি করেন। ফলে আমাদের হিসাবে একজন দোকানদার গড়ে পাঁচ-সাতটি সিলিন্ডার বিক্রি করেন। তাহলে সিলিন্ডারপ্রতি তারা এত অল্প কমিশনে কীভাবে চলবে?
প্রশ্ন: ভোক্তা পর্যায়ে দাম কমানোর জন্য আর কী করা যেতে পারে বলে আপনি মনে করেন?
মেহেদি হাসান: সরকারি ভ্যাট ৭ শতাংশের জন্য ভোক্তাকে ৭৮ টাকা সিলিন্ডারপ্রতি বেশি গুনতে হচ্ছে। বিশ্ব বাজারে যেহেতু এখন দাম বেশি সে জন্য এটি শিথিল রাখা যেতে পারে।
প্রশ্ন: আপনাদের ব্যবসা নিয়ে জানতে চাই। বেক্সিমকো দেশের বাজারে তৃতীয় জেনারেশনের সিলিন্ডার নিয়ে যাত্রা করেছিল। এখন কী অবস্থা?
মেহেদি হাসান: উন্নত প্রযুক্তির সিলিন্ডারে আমাদের এলপিজির গ্রহণযোগ্যতা বাড়ছে। ইউরোপিয়ান স্ট্যান্ডার্ড ডিজাইন এবং স্পেসিফিকেশন অনুসারে তৈরি বেক্সিমকো ফাইবার গ্লাস সিলিন্ডারগুলো টেকসই ও নিরাপদ। এই কম্পোজিট সিলিন্ডারগুলোতে গ্লাস ফাইবার ও রেজিনের তিনটি লেয়ার থাকে, যা সিলিন্ডারকে দেয় অভাবনীয় শক্তি ও স্থায়িত্ব। এ স্মার্ট সিলিন্ডারে গ্যাসের লেভেল বাইরে থেকে দেখা যায়। এছাড়া সাধারণ সিলিন্ডারের তুলনায় প্রায় অর্ধেক ওজন এবং মরিচা পড়ে না। একদম দুর্ঘটনার ঝুঁকিমুক্ত।
প্রশ্ন: অন্য কোম্পানি থেকে আপনাদের প্রধান পার্থক্য সিলিন্ডার। এ আধুনিক সিলিন্ডারে সুবিধা না কি অসুবিধা হচ্ছে বাজার দখলে?
মেহেদি হাসান: মূলত নিম্নমানের সিলিন্ডারের জন্য গ্যাসের দুর্ঘটনা হয়। আবার নিম্নমানের রেগুলেটর, হোসপাইপসহ অ্যাকসেসরিজ ব্যবহারের কারণেও সেটা হয়। এখন মানুষ সচেতন হচ্ছে, তারা সেরাটা নিচ্ছে। সে ক্ষেত্রে আমরা এগিয়ে। এখন গ্রাহকদের চাহিদা পূরণ করতে পারছি না।