ভোক্তাকণ্ঠ ডেস্ক: রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় সোমবার রাতে ছড়িয়ে পড়েছিল গ্যাসের গন্ধ। তিতাস কর্তৃপক্ষ বলছে, সঞ্চালন ও বিতরণ লাইনে গ্যাসের চাপ বেড়ে যাওয়ায় বাসাবাড়ির সরবরাহ লাইনের ছিদ্র দিয়ে এই গন্ধ ছড়িয়ে পড়ে। পরে গ্যাসের চাপ কমিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার দাবি করা হলেও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরবরাহ লাইনের এসব ছিদ্র বড় ঝুঁকি তৈরি করেছে।
রাজধানীর বাসাবাড়িতে তিতাসের গ্যাস সরবরাহের লাইনগুলো ৪০ বছরের পুরোনো। এক দশক আগে মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়া এসব লাইন ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। প্রায়ই গ্যাসের সরবরাহ লাইনে ছিদ্র (লিকেজ) পাওয়া যাচ্ছে। অবৈধ সংযোগের কারণেও পাইপলাইনে ছিদ্র তৈরি হয়েছে।
গত অর্থবছরে ঢাকার এক হাজার ৬৮২ কিলোমিটার পাইপলাইনের মান কোন পর্যায়ে আছে, তা নিয়ে একটি জরিপ করে তিতাস। এতে পাইপলাইনের ওপর ৯ হাজার ৯২৬ স্থানে গ্যাসের উৎস (মিথেন) শনাক্ত হয়। যার মধ্যে ৪৫৯টি ছিদ্র ধরা পড়ে। সোমবার রাত ১১টার পর রাজধানীর মগবাজার, ইস্কাটন, রামপুরা, মহাখালী, পূর্ব রাজাবাজার, ক্রিসেন্ট রোড, বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা, বাড্ডা ও হাজারীবাগে গ্যাসের গন্ধ ছড়িয়ে পড়ার খবর আসে। বিভিন্ন এলাকার মসজিদের মাইক থেকে গ্যাসের চুলা ও দেশলাই না জ্বালানোর পরামর্শ দেওয়া হয়।
সম্প্রতি রাজধানীতে বেশ কয়েকটি অগ্নিকাণ্ড ও ভবনে বিস্ফোরণের ঘটেছে। এর মধ্যে সোমবার রাতে গ্যাসের গন্ধ ছড়িয়ে পড়ায় বাসিন্দাদের মধ্যে আতঙ্ক দেখা দেয়। অনেকে ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে বিষয়টি জানান। অনেকে আবার জাতীয় জরুরি সেবার নম্বর ৯৯৯-এ ফোন দিয়ে সহায়তা চান।
পরে রাত ১২টার পর বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে সমস্যার সমাধানে কাজ চলার কথা জানিয়ে নগরবাসীকে আতঙ্কিত না হওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়।
মঙ্গলবার তিতাসের কর্মকর্তারা দাবি করেছেন, কোম্পানিটির জরুরি ও কারিগরি দল রাতেই সমস্যার সমাধান করেছে। এখন আর কোথাও গ্যাসের গন্ধ নেই।
এ বিষয়ে তিতাসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. হারুনুর রশিদ মোল্লাহ বলেন, চাহিদার তুলনায় চাপ বেশি থাকায় লাইনের ছোটখাটো ছিদ্র দিয়ে গ্যাসের গন্ধ ছড়িয়ে পড়েছিল। খবর পাওয়া মাত্র তিতাসের ১৪টি দল ঘটনাস্থলে যায়। গ্যাসের চাপ নিয়ন্ত্রণে এনে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করা হয়েছে। বড় কোনো ছিদ্র পাওয়া যায়নি। সবাই স্বাচ্ছন্দ্যে ও নির্ভয়ে রান্নাবান্না করতে পারেন।
ঢাকাসহ আশপাশের এলাকায় গ্রাহকদের গ্যাস সরবরাহ করে তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড। এটাই দেশের সবচেয়ে বড় গ্যাস বিতরণ সংস্থা। ঢাকায় তিতাসের সাত হাজার কিলোমিটার পাইপলাইন রয়েছে। তিতাসের আওতাধীন এলাকায় মোট সংযোগ ২৮ লাখ ৭৭ হাজার ৬০৪টি। এর মধ্যে আবাসিক সংযোগ আছে ২৮ লাখ ৫৭ হাজার ৯৩৬টি।
১৯৬৭ সালে ঢাকায় পাইপলাইন নির্মাণের কাজ শুরু করে তিতাস। নগরীতে এই পাইপলাইন বিস্তৃত হয় ১৯৮০ সালের পর। সেসব পাইপলাইনের মেয়াদ ছিল ৩০ বছর। কিন্তু মেয়াদ শেষ হওয়ার ১০ বছর পরও ওই পাইপলাইন দিয়ে গ্যাস সরবরাহ করা হচ্ছে। ফলে স্বাভাবিক কারণেই গ্যাস সরবরাহের লাইনগুলো ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে।
পাইপলাইনে ছিদ্র রয়েছে কি না, তা এক ধরনের যন্ত্রের মাধ্যমে পরীক্ষা করা হয়। এ জন্য পাইপলাইনের ওপর দিয়ে যন্ত্রটি চালিয়ে নেওয়া হয়। উন্নত দেশগুলোতে গ্যাস পাইপলাইনে স্বয়ংক্রিয় নিয়ন্ত্রণ থাকে। এটিকে বলা হয়, সুপারভাইজরি কন্ট্রোল অ্যান্ড ডেটা অ্যাকুইজিশন সিস্টেম, যা স্ক্যাডা সিস্টেম নামেও পরিচিত। এতে গ্যাস লাইনের কোথাও ছিদ্র হলে তা স্বয়ংক্রিয় ভাবে শনাক্ত করা যায়। অনেক দিন ধরে দেশে এই প্রযুক্তি আনার কথা বলা হলেও এখন পর্যন্ত তা শুরু হয়নি।
গত অর্থবছরে ঢাকার এক হাজার ৬৮২ কিলোমিটার পাইপলাইনের মান কোন পর্যায়ে আছে, তা নিয়ে একটি জরিপ করে তিতাস। এতে পাইপলাইনের ওপর নয় হাজার ৯২৬ স্থানে গ্যাসের উৎস (মিথেন) শনাক্ত হয়। যার মধ্যে ৪৫৯টি ছিদ্র ধরা পড়ে। পরে সেগুলো সংস্কার করা হয়। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, পুরো পাইপলাইন নিয়ে জরিপ করা হলে আরও অনেক ছিদ্র পাওয়া যাবে।
গত ২ বছরে ৩৪০ কিলোমিটার অবৈধ গ্যাসলাইন উচ্ছেদ করেছে তিতাস। এরপরও থেমে নেই অবৈধ সংযোগ দেওয়া।
গ্যাস লাইনে ছিদ্রের কারণে দেড় বছর আগে নারায়ণগঞ্জে মসজিদে বিস্ফোরণে মারা যান ৩৪ জন। ২০২১ সালের জুনে মগবাজারে একটি ভবনে বিস্ফোরণের পর পুলিশের তদন্তে দেখা গেছে, তিতাসের বিচ্ছিন্ন করা পাইপলাইন সংযোগ থেকে গ্যাস জমে ওই দুর্ঘটনা ঘটেছিল। সম্প্রতি সায়েন্স ল্যাবরেটরি মোড় ও সিদ্দিকবাজারে ভবনের বিস্ফোরণের ঘটনার পরও একই সন্দেহ করছে পুলিশ। মগবাজার, সায়েন্স ল্যাব ও সিদ্দিকবাজারে বিস্ফোরণে মারা গেছেন ৩৯ জন।
ভোক্তা অধিকার নিয়ে কাজ করা সংগঠন কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্যৈষ্ঠ সহ-সভাপতি অধ্যাপক ড. এম শামসুল আলম বলেন, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের অর্থ এই নয় যে আশঙ্কামুক্ত। এই ঘটনার মধ্য দিয়ে প্রমাণিত যে শহরবাসী প্রতিনিয়ত গ্যাসের ঝুঁকির মধ্যেই আছে। বিতরণ লাইনগুলো নিয়ম মেনে সময়ে–সময়ে তদারকি করার কথা থাকলেও তিতাস তা করছে না। ভোক্তাদের জীবন তিতাসের হাতে জিম্মি হয়ে পড়েছে।
তিতাস কর্তৃপক্ষ বলছে, অবৈধ গ্যাস সংযোগের কারণে সরবরাহ লাইনে ছিদ্র বেশি হচ্ছে। অবৈধ সংযোগ প্রদানকারীরা লাইনের যত্রতত্র ছিদ্র করে। অবৈধ সংযোগের বিরুদ্ধে তিতাস নিয়মিত অভিযান চালাচ্ছে।
গ্যাস সংকট বাড়তে থাকায় ২০১০ সালে আবাসিক সংযোগ দেওয়া বন্ধ করা হয়। মাঝে তা কিছুটা শিথিল করা হলেও ২০১৫ সাল থেকে আবাসিক সংযোগ দেওয়া পুরোপুরি বন্ধ আছে। এ সুযোগে একটি চক্র বিভিন্ন এলাকায় অবৈধ সংযোগ দিচ্ছে। গত দুই বছরে ৩৪০ কিলোমিটার অবৈধ গ্যাস লাইন উচ্ছেদ করেছে তিতাস। এরপরও থেমে নেই অবৈধ সংযোগ দেওয়া।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) কেমিকৌশল বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মো. ইয়াসির আরাফাত খান বলেন, তিতাসের সঞ্চালন লাইনে যে ত্রুটি আছে, এ ঘটনায় তা আবার নতুন করে প্রমাণিত হলো। আবাসিক এলাকাগুলো ভয়ানক ঝুঁকিতে আছে। গতকাল বিভিন্ন জায়গায় গ্যাস বের হয়ে গেছে। এই গ্যাস কোথাও জমা থাকলে আবারও সমস্যা হতে পারে। তাই এটা বলা যাবে না যে ঝুঁকি শেষ হয়েছে। তিতাসের সঞ্চালন লাইনগুলো মেরামত শুধু নয়, নতুন লাইন বসাতে হবে।
গ্যাসের পাইপলাইনে ছিদ্র বা গ্যাসের গন্ধ ছড়িয়ে পড়ার মতো ঘটনায় নগরবাসীর করণীয় বিষয়ে জানতে চাইলে ইয়াসির আরাফাত বলেন, বাসাবাড়িতে গ্যাস জমা না থাকলে বড় ধরনের ঝুঁকির আশঙ্কা কম। দরজা-জানালা খোলা রেখে তারপর চুলা জ্বালাতে হবে। রান্নাঘরের দরজা-জানালা খোলা রাখলে গ্যাস ছড়ালেও তা সরে যেতে পারে। অর্থাৎ সেখানে ঝুঁকি কম থাকে।