এস এম রাজিব: সরকার যখন দেশকে শত ভাগ বিদ্যুতের আওতায় আনার দাবি করছে, ঠিক তখনই আবার লোডশেডিং গ্রাহকদের অতিষ্ঠ করে তুলছে।
তবে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি মন্ত্রণালয় থেকে বলা হচ্ছে, আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানির অস্থিরতার কারণে দেশে বিদ্যুৎ সরবরাহ কমিয়ে দেয়া হয়েছে।
অন্যদিকে বিশেষজ্ঞদের মতে, জ্বালানি সংকটে সৃষ্ট দেশিয় বিপর্যয়ের জন্য সরকারের জ্বালানি নীতিই দায়ী।
বিদ্যুৎ ও জ্বালানি কর্মকর্তারা বলছেন, জ্বালানি তেলের দামও বিশ্ববাজারে অনেক বেশি হওয়ায় পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশনকে দিনে ১০০ কোটি টাকার বেশি লোকসান দিতে হচ্ছে। সে জন্য তেলচালিত বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোও পুরো দমে চালানো হচ্ছে না।
বিশেষজ্ঞদের মতে, দেশে যেহেতু তেলের খনি নেই। তাই সরকারের উচিৎ ছিল অভ্যন্তরীণ গ্যাস উৎপাদনের দিকে নজর দেওয়া। কিন্তু তারা তা না করে আমদানি নির্ভর হয়ে পড়েছে। যার কারণে এ সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে।
তবে অভ্যন্তরীণ গ্যাস উৎপাদন বাড়ানোর ক্ষেত্রে ব্যর্থতার অভিযোগ মানতে রাজি নন প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ।
বিবিসি বাংলাকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি দাবি করেন, গত চার বছরে এক হাজার ঘনফুট গ্যাস উৎপাদন বেড়েছে।
কর্মকর্তারা দাবি করেন, দেশে বিদ্যুতের চাহিদা অনুযায়ী উৎপাদনের সক্ষমতা তৈরি হওয়ায় চার বছর ধরে কোন লোডশেডিং হয়নি। কিন্তু দু’দিন ধরে দিনে সাড়ে ১৪ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুতে চাহিদার বিপরীতে সরবরাহে ১২০০ মেগাওয়াটের বেশি ঘাটতি হচ্ছে।
তথ্যমতে, বৃহস্পতিবার দিনে বিদ্যুতের সর্বোচ্চ চাহিদার পূর্বাভাস ১২ হাজার ৩০০ মেগাওয়াট এবং সন্ধ্যায় সর্বোচ্চ ১৪ হাজার মেগাওয়াট। গত বুধবার দিনে সর্বোচ্চ বিদ্যুতের উৎপাদন ছিল ১১ হাজার ৮৩৮ মেগাওয়াট এবং সন্ধ্যায় সর্বোচ্চ ১৩ হাজার ৬১৪ মেগাওয়াট।
বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের তথ্যানুযায়ী, দেশে বর্তমানে বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ২৫ হাজার ৫৬৬ মেগাওয়াট। মাথাপিছু বিদ্যুৎ উৎপাদন ৫৬০ কিলোওয়াট। বিদ্যুৎ সুবিধা পাওয়া জনগোষ্ঠীর সংখ্যা ১০০ ভাগ। প্রি-পেইড মিটার স্থাপন করা হয়েছে ৪৭ লাখ ৩২ হাজার ৪৯টি। সোলার হোম সিস্টেম ৬০ লাখ। মোট সিস্টেম লস ৮ দশমিক ৪৮ শতাংশ।
পিডিবির হিসাবে, ১৫২টি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের স্থাপিত উৎপাদন ক্ষমতা প্রায় ২২ হাজার মেগাওয়াট। এর মধ্যে ভারত থেকে আমদানি করা বিদ্যুৎ রয়েছে ১১৬০ মেগাওয়াট। তবে ক্যাপটিভসহ মোট উৎপাদন ক্ষমতা ধরা হয় সাড়ে ২৫ হাজার মেগাওয়াটের মতো।
এর মধ্যে গ্যাসভিত্তিক কেন্দ্রগুলোর উৎপাদন ক্ষমতা প্রায় ৫১ শতাংশ, তেলভিত্তিক এইচএফও ও এইচডিও কেন্দ্রগুলোর উৎপাদন ক্ষমতা প্রায় ৩৪ শতাংশ। কয়লা থেকে প্রায় ৮ শতাংশ, আমদানি থেকে ৫ শতাংশ বিদ্যুৎ আসে। বাকিটা পূরণ করে সৌর ও পানিভিত্তিক নবায়নযোগ্য জ্বালানি।
পেট্রোবাংলার হিসাবে, আমদানি থেকে এক হাজার মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ আসার কথা থাকলেও তা আসছে অর্ধেক।
যদিও সরকার এই পরিস্থিতির জন্য ইউক্রেন-রাশিযার যুদ্ধের জেরে আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বৃদ্ধিকে দায়ী করছে।
তবে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত নিয়ে কাজ করা কল্লোল মোস্তফা বলছেন ভিন্ন কথা।
তেল, গ্যাস, খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির সদস্য ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞ প্রকৌশলী কল্লোল মোস্তফা ভোক্তাকণ্ঠকে বলেন, ‘আমাদের দেশে গত এক দশকে জ্বালানির উৎপাদন ক্ষমতা বাড়ানোর জন্য যে প্রক্রিয়া নেওয়া হয়েছে, তা দেশি বিদেশি ব্যক্তি মালিকানাধীন কোম্পানির মাধ্যমে। আর আমরা জ্বালানি আমদানি নির্ভর। এখানে তেল, কয়লা, এলএনজি আমদানি করতে হচ্ছে।’
তিনি বলেন, ‘জ্বালানি নিরাপত্তার একটা কন্ডিশন হচ্ছে সেখানে যদি লোকাল সোর্স থাকে, তাহলে সেটাকে প্রাধান্য দিতে হবে। আর এখনকার সময়ে নবায়নযোগ্য জ্বালানি উৎপাদনে গুরুত্ব অবশ্যই দিতে হবে। কিন্তু আমাদের দেশে নবায়নযোগ্য জ্বালানিকে প্রায়োরিটি (গুরুত্ব) দিতে দেখা যাচ্ছে না।’
এক প্রশ্নের জবাবে কল্লোল মোস্তফা বলেন, ‘সরকার যদি বাপেক্সকে শক্তিশালী করতো। বাপেক্সের যতটুকু সক্ষমতা আছে তা দিয়েই স্থল ভাগে উৎপাদন করা হতো। এ বিষয়ে জ্বালানি বিশেষজ্ঞ বদরুল ইমাম স্যারসহ অনেকেই দীর্ঘ দিন ধরে বলছেন। কিন্তু কোন পদক্ষেপ নিচ্ছে না সরকার।’
তিনি বলেন, ‘সাগরে অনুসন্ধান করলেই যে গ্যাস পাওয়া যাবে এমনটা নয়। কিন্তু এখন পর্যন্ত তো পরীক্ষা করা হয়নি। তাহলে বুঝবো কেমনে আছে কী নেই। ঝুঁকি নিয়ে সার্ভে না করলে তো আর সুফল আসবে না। আর সমুদ্রে গ্যাস রয়েছে- এমন সম্ভাবনা তো বিশেষজ্ঞরা দিয়েছেন।’
লোডশেডিং থেকে উত্তরণের জন্য বিদ্যুৎ বিভাগ কী পরিকল্পনা নিয়েছে- এমন প্রশ্নে বিদ্যুৎ বিভাগের সিনিয়র সচিব (পরিকল্পনা) নুরুল আলম ভোক্তাকণ্ঠকে বলেন, ‘শুক্রবার আমাদের মিটিং আছে। মিটিং শেষে বোঝা যাবে।’
তিনি বলেন, ‘লোডশেডিং শুধু বাংলাদেশে নয়। অস্ট্রেলিয়া, চীন, ভারতের মতো দেশেও জ্বালানি সঙ্কটের কারণে লোডশেডিং হচ্ছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমরা কি ধরনের ভূমিকা নেব, এ বিষয়ে কাজ শুরু করেছি। তবে এই কর্মপরিকল্পনা এখনো যেহেতু চূড়ান্ত হয়নি, তাই এই বিষয়ে মন্তব্য করা ঠিক হবে না।’
মিটিংয়ে নবায়নযোগ্য জ্বালানির উৎপাদনের দিকে নজর দেওয়া হবে কী না- এমন প্রশ্নে নুরুল আলম বলেন, ‘এ বিষয়ে বৃহৎ পরিকল্পনা রয়েছে, তবে এখন কিছু বলা যাবে না।’
গ্যাসের অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে গ্যাস উত্তোলন বৃদ্ধি করার সুযোগ রয়েছে কী না বা উত্তোলনের পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে কী না এমন প্রশ্নে বাংলাদেশ তেল, গ্যাস, খনিজ সম্পদ কর্পোরেশনের (পেট্রোবাংলা) মহাব্যবস্থাপক (পরিকল্পনা শাখা) আনোয়ারুল ইসলাম ভোক্তাকণ্ঠকে বলেন, ‘এ বিষয়ে তো কিছু প্রজেক্ট হাতে নেওয়া আছেই। আর বর্তমানে যে প্রডাক্টশন তা তো ওয়েবসাইটে দেখতেই পাচ্ছেন। তবে উত্তোলন বৃদ্ধির জন্যে আমরা চেষ্টা করছি।’
গ্যাস উৎপাদনের পরিমাণ কমছে না কী বাড়ছে- এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘আমাদের হাতে কিছু প্রজেক্ট রয়েছে। এগুলো সাকসেস হলে আশা করি উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব হবে।’
গ্যাস সংকটের কারণে আবাসিক খাত, শিল্প কারখানা এমনকি বিদ্যুৎ উৎপাদনও কমে গেছে। তাহলে এ গ্যাস সংকট থেকে উত্তরণের জন্য কতোটা সময় লাগতে পারে এমন প্রশ্নে সরকারের এ কর্মকর্তা বলেন, ‘এ বিষয়ে কিছুই বলা যাচ্ছে না।’
গ্যাস সংকটের কারণে দেশজুড়ে বিপর্যয় চলছে। সেই বিষয়টি মাথায় নিয়ে টেংরাটিলা গ্যাস ক্ষেত্র থেকে গ্যাস উত্তোলনের পরিকল্পনা রয়েছে কী না- এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘এটি অপারেশন এবং প্রোডাক্টশন বিভাগের কাজ। এ বিষয়ে আমি কিছু বলতে পারবো না।’
অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে গ্যাসের উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব কী না- এমন প্রশ্নে পেট্রোবাংলার ডেভেলপমেন্ট এন্ড প্রডক্টশন শাখার মহাব্যবস্থাপক আবু সাকলায়েন ভোক্তাকণ্ঠকে বলেন, ‘ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার অনুমতি ছাড়া আমি কিছুই বলতে পারবো না।’