ভোক্তাকণ্ঠ রিপোর্ট: পাইকারীর পর এবার খুচরা পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর আবেদন করেছে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি)। গড়ে ১৯ দশমিক ৪৪ শতাংশ দাম বাড়ানোর আবেদন করেছে দেশের বিদ্যুতের প্রধান এ সংস্থাটি।
এর আগে গত সোমবার (২১ নভেম্বর) পাইকারি পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম ১৯ দশমিক ৯২ শতাংশ বৃদ্ধি করে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)। ওই দাম বাড়ানোর বিপরীতে ৬৬ শতাংশ দাম বাড়ানোর প্রস্তাব করেছিল পিডিবি।
তবে লোকসানের পরিমাণ উল্লেখ করে পিডিবি পাইকারী পর্যায়ে দাম বাড়ানোর আবেদন করলেও আগের দামই পুনর্বহাল রেখেছিল বিইআরসি। পিডিবির করা আবেদনের পেক্ষিতে যাচাই-বাছাই এবং গণশুনানি শেষে গত মাসের ১৩ অক্টোবর বিদ্যুতের দাম না বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেয় প্রতিষ্ঠানটি। তবে এর মাত্র এক মাস আট দিনের মাথায় পিডিবির রিভিউ আবেদনের প্রেক্ষিতে ১৯ দশমিক ৯২ শতাংশ দাম বাড়ানো হয়।
যদিও পাইকারী দাম বাড়ানো হলেও এখনই খুচরা দামে প্রভাব পড়বে না বলে জানিয়েছিল বিইআরসি এবং বিদ্যুৎ ও জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ। কিন্তু পিডিবি সবার আগে খুচরা দাম বাড়ানোর আবেদন জমা দিল। পিডিবির আওতাধীন বাকি পাঁচ বিতরণ কোম্পানির মধ্যে দুটি আজ বৃহস্পতিবার সকালে জমা দিয়েছে বলে বিইআরসি সূত্র নিশ্চিত করেছে। কোম্পানি দুটি হলো ডিপিডিসি এবং ওজোপাডিকো। বাকি তিনটিও আজ বিকেলের মধ্যে জমা দিতে পারে বলে জানা গেছে।
এ বিষয়ে বিইআরসির সদস্য (অর্থ) আবু ফারুক ভোক্তাকণ্ঠকে বলেন, ‘কমিশনের আবেদনপত্র গ্রহণ শাখায় দুপুর পর্যন্ত তিনটি আবেদন জমা হয়েছে বলে জেনেছি। বিকেলের দিকে কোন আবেদন পড়েছে কি না জানি না। অফিসের কাজে দুপুরের পর থেকে বাইরে আছি।’
এদিকে বিইআরসি বেআইনি ভাবে বিদ্যুতের পাইকারী মূল্য নির্ধারণ করেছে বলে জানিয়েছেন কনজুমারস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট ও জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক এম শামসুল আলম।
ভোক্তাকণ্ঠকে তিনি বলেন, ‘হাইকোর্টের আদেশ অনুযায়ী (বিদ্যুৎ-জ্বালানি) দাম নির্ধারণ বা পুনর্বিবেচনার জন্য গণশুনানির বাধ্যবাধকতা রয়েছে৷ কিন্তু বিইআরসি আইনের অবমাননা করে (গণশুনানি ছাড়া) বেআইনি ভাবে দাম পুনর্বিবেচনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যা ভোক্তা অধিকারের পরিপন্থী।’
তবে গণশুনানি ছাড়া বিইআরসি দাম পুনর্বিবেচনা করতে পারে কি না- এমন প্রশ্নে বিইআরসি সদস্য আবু ফারুক সোমবার মূল্য পুনর্বিবেচনা সভায় বলেছিলেন, পিডিবির রিভিউ আবেদনের প্রেক্ষিতে আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি। যেহেতু ঘোষণার সময়ই বলা হয়েছিলো পিডিবি চাইলে এই ঘোষণার বিরুদ্ধে পুনর্বিবেচনার আবেদন করতে পারবে।
ভোক্তা পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর যৌক্তিকতা রয়েছে কি না- এমন প্রশ্নে বাংলাদেশ সাধারণ নাগরিক সমাজের আহ্বায়ক মহিউদ্দীন আহমেদ ভোক্তাকণ্ঠকে বলেন, ‘শুনানির পরিপ্রেক্ষিতে তারা মূল্যবৃদ্ধির সিদ্ধান্ত বাতিল করেছিল। আমরা কমিশন ও সরকারকে ধন্যবাদ জানিয়েছিলাম। কিন্তু দুঃখের বিষয় হচ্ছে এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের সঙ্গে দাতা সংস্থাগুলোর বৈঠকের পর তাদের সিদ্ধান্ত পরিবর্তন হয়ে গেল। দেশ ও দেশের জনগণের কথা কোন ভাবেই আমলে নিল না। বর্তমান বাজারে যে নৈরাজ্য এবং বিশৃঙ্খলা চলছে, খুচরা পর্যায়ে আবার বিদ্যুতের দাম বাড়লে এই বিশৃঙ্খলা আরেক ধাপ উসকে দেবে এতে কোন সন্দেহ নেই।
এর আগে বিশ্ব ব্যাংকের (আইএমএফ) প্রতিনিধি দল বিইআরসি চেয়ারম্যান আব্দুল জলিলের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। সাক্ষাতে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে ভর্তুকি কমানোর বিষয়ে প্রস্তাব করা হয়েছে বলে একাধিক সূত্র দাবি করে। তবে বিদ্যুতের পাইকারী দাম বাড়ানোর (পুনর্বিবেচনা) বিষয়ে বিশ্ব ব্যাংকের কোন প্রভাব পড়েনি বলে সোমবারের ওই ভার্চুয়াল সভায় দাবি করেছিলেন আব্দুল জলিল।
এদিকে, দাম বাড়ানোর পেছনে বিশ্ব ব্যাংকের শর্তের প্রভাব রয়েছে কি না- এমন প্রশ্নে মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, এটা দিনের মতো সত্য যে বিইআরসি তড়িঘড়ি করে বিদ্যুতের দাম বাড়িয়েছে সরকারের চাপে। কারণ বিশ্ব ব্যাংকের ঋণ দেওয়ার অন্যতম শর্ত হলো বিদ্যুৎ ও জ্বালানিসহ সেবা খাতে ভর্তুকি কমানো। আর ঋণের শর্ত হিসাবে জ্বালানি খাতে ভর্তুকি কমানোর জন্য সরকারকে প্রস্তাব করেছে বিশ্ব ব্যাংক।
তথ্যমতে, প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম গড়ে ১ টাকা ৪৭ পয়সা বাড়ানোর আবেদন করেছে পিডিবি। আর পাইকারি দাম বেড়েছে ইউনিটে ১ টাকা ৩ পয়সা। দাম বাড়ানোর আবেদন জমা দিতে বাকি বিতরণ সংস্থার প্রস্তুতিও শেষের দিকে, যেকোনো সময় তারা জমা দিতে পারে। সবাই গড়ে প্রায় ২০ শতাংশ বাড়ানোর আবেদন করবে বলে ধারণা পাওয়া গেছে।
এ বিষয়ে আবু ফারুক বলেন, ‘নিয়ম অনুযায়ী (পাইকারী পর্যায়ে দাম বাড়ার পর) ভোক্তা পর্যায়ে দাম বাড়ানোর বিষয়ে বিতরণ কোম্পানি আবেদন করতে পারে। তবে দাম বাড়ানো হবে কি-না সেটা গণশুনানির পর বোঝা যাবে।’
বিইআরসি চেয়ারম্যান আবদুল জলিল গণমাধ্যমকে বলেন, ‘সব বিতরণ সংস্থার আবেদন জমা হলে তা যাচাই-বাছাই করে আইন ও বিধি অনুসারে পরবর্তী ব্যবস্থা নেয়া হবে।’
বিইআরসির কর্মকর্তারা বলছেন, আবেদনে সব তথ্য ও সংযুক্ত প্রমাণাদি ঠিক থাকলে তা আমলে নেবে কমিশন। এরপর একটি কারিগরি মূল্যায়ন কমিটি গঠন করা হবে। কমিটি প্রতিবেদন তৈরির পর সব পক্ষকে নিয়ে গণশুনানি করা হবে। এরপর গণশুনানি পরবর্তী কোন ব্যাখ্যা বা জবাব নেয়া হতে পারে। এরপর আদেশ ঘোষণা করবে কমিশন। এতে অন্তত এক থেকে দেড় মাস সময় লাগতে পারে।
এদিকে, গত ১৪ বছরে বিদ্যুতের দাম বেড়েছে নয় বার। এ সময় পাইকারি পর্যায়ে ১১৮ শতাংশ ও গ্রাহক পর্যায়ে ৯০ শতাংশ বেড়েছে বিদ্যুতের দাম। সবশেষ দাম বাড়ানো হয় ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে, যা ওই বছরের মার্চ থেকে কার্যকর হয়। ওই সময় পাইকারি পর্যায়ে ৮ দশমিক ৩৯ শতাংশ বাড়ানো হয় দাম। একই সময়ে খুচরা পর্যায়ে দাম বাড়ানো হয় ৫ দশমিক ৩ শতাংশ।
পিডিবি বিদ্যুতের একক পাইকারি বিক্রেতা। বিউবোর অধীনস্থ বিতরণকারী পাঁচ কোম্পানী হলো- ওয়েস্ট জোন পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড (ওজোপাডিকো), নর্দান ইলেকট্রিসিটি সাপ্লাই কোম্পানি লিমিটেড (নেসকো), পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড (আরইবি), ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড (ডিপিডিসি) ও ঢাকা ইলেকট্রিসিটি পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড (ডেসকো)।
বিতরণ কোম্পানির কাছে পাইকারি দরে বিদ্যুৎ বিক্রির পাশাপাশি পিডিবি নিজেও ময়মনসিংহ, সিলেট ও চট্টগ্রাম বিভাগের শহরাঞ্চলসহ অন্যান্য কিছু অঞ্চলে ভোক্তা পর্যায়ে বিদ্যুৎ বিতরণ করছে।