ভোক্তাকণ্ঠ ডেস্ক: জ্বালানি সংকট মোকাবিলায় তিন বিকল্পের কথা ভাবছে দেশে জ্বালানি সরবরাহের দায়িত্বে থাকা রাষ্ট্রীয় সংস্থা বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি)। ডলার সরবরাহ বাড়িয়ে নতুন ঋণপত্র (এলসি) খোলা অব্যাহত রাখা, রেশনিং করে পরিবহনের পেছনে খরচ হওয়া জ্বালানি দ্রুত ৫০ শতাংশ কমিয়ে আনা এবং করোনাকালের মতো অফিস-আদালতের কর্মসময়ে পরিবর্তন এনে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার বিষয়ে জোর দিতে বলছে সংস্থাটি। তাদের এই ভাবনা প্রস্তাবনা আকারে শিগগির বিদ্যুৎ ও জ্বালানি মন্ত্রণালয়কে জানাবে বিপিসি। তবে এই সংকটের মধ্যে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর পরিকল্পনা আগে থেকেই রয়েছে সরকারের।
ডলার সংকটে ব্যাংকগুলো এলসি না খোলায় দেশে জ্বালানি তেল আমদানি ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়ছে বলে সংশ্নিষ্ট মন্ত্রণালয় ও কেন্দ্রীয় ব্যাংককে একাধিকবার চিঠি দিয়ে জানিয়েছে বিপিসি। তবে এই সংকটের বৃত্ত থেকে বের হওয়ার সমাধান এখনও পায়নি তারা। অথচ ঋণপত্র খোলা না গেলে নতুন করে জ্বালানি তেলের ক্রয়াদেশ দেওয়া যাবে না। এতে ব্যাহত হবে তেল আমদানি। আর আমদানি কমে গেলে বিদ্যুৎ উৎপাদনে ঘটবে ব্যাঘাত। সংকটে পড়বে পরিবহন খাত। জটিলতা তৈরি হবে কৃষকের সেচকাজেও।
সূত্র জানিয়েছে, গত জুন থেকে জুলাই পর্যন্ত চার দফা চিঠির মাধ্যমে অর্থ বিভাগ, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ, বাংলাদেশ ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগকে ঋণপত্র খোলার বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে অনুরোধ করে বিপিসি। সবশেষ বৃহস্পতিবারও জ্বালানি বিভাগে বিপিসি চিঠি পাঠিয়েছে। এতে বলা হয়, আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দর এবং অভ্যন্তরীণ বাজারে ডলারের চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় যথাসময়ে এলসি খোলা ও মূল্য পরিশোধ করা সম্ভব হচ্ছে না।
দেশে পরিবহন খাতের ৯০ শতাংশের বেশি যানবাহন জ্বালানি তেলের ওপর নির্ভরশীল। আবার বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতারও ৩৪ শতাংশ নির্ভর করে জ্বালানি তেলের ওপর। চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে বাংলাদেশ বছরে ৬৫ লাখ টন জ্বালানি তেল আমদানি করে। বছরে ৪০ লাখ টন শুধু ডিজেলই আমদানি করে বিপিসি।
জ্বালানি তেল আনতে প্রতি মাসে গড়ে ১৫ থেকে ১৬টি আমদানি ঋণপত্র খোলা হয় দেশে। এখন ৩৫ থেকে ৪০ দিনের জ্বালানি তেল মজুত করতে পারে বিপিসি। ঋণপত্র খুলতে দেরি হলে বিপিসির এই মজুতে টান পড়বে।
জানতে চাইলে বিপিসির চেয়ারম্যান এ বি এম আজাদ বলেন, ‘জ্বালানি তেল নিয়ে সংকটে আছে পুরো বিশ্ব। আমাদের দেশেও এর প্রভাব পড়ছে। ব্যাংকে আমাদের কী সমস্যা হচ্ছে, তা একাধিক চিঠি দিয়ে মন্ত্রণালয়কে জানিয়েছি। পাশাপাশি কিছু বিকল্প প্রস্তাবনাও আমরা তুলে ধরব শিগগির।’ সেই বিকল্প ভাবনায় কী আছে- এমন প্রশ্নের জবাবে চেয়ারম্যান বলেন, ‘সংকটকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে পুরো ব্যবস্থাপনাই কিছু পরিবর্তন আনার কথা বলব আমরা। সবার আগে ঠিক রাখতে হবে সরবরাহ। ঋণপত্র খোলার প্রক্রিয়া কোনোভাবে বাধাগ্রস্ত করা যাবে না। এটি সচল রাখতে জরুরি উদ্যোগ নিতে হবে মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ ব্যাংককে। পরিবহনের পেছনে আমাদের ব্যাপক জ্বালানির প্রয়োজন হয়। একদিন বিজোড়, অন্যদিন জোড় সংখ্যার গাড়ি নামানো যেতে পারে সড়কে। এতে করে দ্রুত জ্বালানি সাশ্রয় হবে প্রায় অর্ধেক। করোনাকালে অফিস-আদালতের অনেক কাজ হয়েছে ঘরে বসে। শিফটিং করেও চলেছে অফিস। প্রয়োজনে হাঁটতে হবে এই পথেও।’
প্রতি মাসে ৭৩ থেকে ৭৫ কোটি ডলারের ঋণপত্র খোলা দরকার উল্লেখ করে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো এক চিঠিতে বিপিসি উল্লেখ করে, এপ্রিল থেকেই ঋণপত্র খোলা ও তেলের দাম পরিশোধ নিয়ে জটিলতা তৈরি হচ্ছে। মাঝে কিছু ডলার ছাড়া হলেও এখন আবার নতুন করে ব্যাংকে সমস্যা হচ্ছে। কোনো কোনো ব্যাংক নতুন করে ঋণপত্র খুলতে জানাচ্ছে অপারগতা। আবার ঋণপত্র খুললেও তেল সরবরাহকারীর দর পরিশোধে দেরি করছে কেউ কেউ। এতে করে জ্বালানি তেল সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের অবনতি হতে পারে। জ্বালানি তেলের ঋণপত্র সাধারণত সোনালী, অগ্রণী, রূপালী, জনতা, ওয়ান, ইসলামী ও ইস্টার্ন ব্যাংকে খোলা হয়ে থাকে। সংকট উত্তরণে বাংলাদেশ ব্যাংকের ত্বরিত হস্তক্ষেপেরও প্রত্যাশা করা হয় চিঠিতে।
এ ব্যাপারে অর্থনীতিবিদ এবি মির্জ্জা মো. আজিজুল ইসলাম বলেন, সংকট থাকলেও জ্বালানি পণ্য সরকারকে আমদানি করতেই হবে। এ জন্য ডলার সরবরাহ বাড়ানোসহ প্রয়োজনীয় সব পদক্ষেপ নিতে হবে। পাশাপাশি ব্যবহারেও সাশ্রয়ী হতে হবে।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ম. তামিম বলেন, বিশ্ববাজারে জ্বালানি পণ্যের দাম বাড়ছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে সরকার নানা রকম সাশ্রয়ী পদক্ষেপ নিয়েছে। বিলাসবহুল পণ্য আমদানিতে লাগাম টেনেছে। এসব পদক্ষেপের সুফল পেতে বেশ কিছুদিন সময় লাগবে। এর মধ্যে যদি বিশ্ববাজারে দাম কমে, তবে বাংলাদেশের জন্য সুখবর। না হলে সাশ্রয়ের দিকে যেতে হবে।
ডলার সংকট, এলসি খুলছে না ব্যাংকগুলো :ডলার সংকটের কারণে সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকগুলো জ্বালানি তেলের এলসি খুলছে না। ফলে তেল সরবরাহকারী কোম্পানিগুলোর পাওনা পরিশোধ করতে পারছে না বিপিসি। গত ৪ ও ৫ জুলাই অগ্রণী ও সোনালী ব্যাংকে দুটি এলসি খোলার জন্য অনুরোধ করা হলেও এখন পর্যন্ত তা খোলা হয়নি। ৭ জুলাই অগ্রণী ব্যাংক ৪৮ মিলিয়ন মার্কিন ডলার পরিশোধের সময় নির্ধারণ করা হলেও মাত্র ১৫ মিলিয়ন ডলার পরিশোধ করেছে। এ ছাড়া অগ্রণী ব্যাংকের মাধ্যমে ১২ জুলাই ৪২ মিলিয়ন ও জনতা ব্যাংকের মাধ্যমে ১০ জুলাই ৪৭.২৫ মিলিয়ন ডলার পরিশোধ করা যায়নি। বিপিসি বলেছে, আমদানি মূল্য নির্দিষ্ট দিনে পরিশোধ করা সম্ভব না হওয়ায় আন্তর্জাতিক অঙ্গণে দেশীয় ব্যাংকগুলোর তথা দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হচ্ছে। এ ছাড়া বিলম্বে আমদানি মূল্য পরিশোধের কারণে জরিমানাও দিতে হচ্ছে।
বৈদেশিক মুদ্রাবাজারে স্থিতিশীলতা ফেরাতে বিভিন্ন উদ্যোগ নিচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। একইসঙ্গে জ্বালানি তেলসহ সরকারের প্রয়োজনীয় আমদানি দায় মেটাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রচুর ডলার বিক্রি করছে। আমদানিতে ব্যাপক প্রবৃদ্ধি এবং রেমিট্যান্স কমায় এমনিতেই বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ চাপে রয়েছে। গত আগস্টে ৪৮ বিলিয়ন ডলারের ঘর অতিক্রম করা রিজার্ভ এখন ৪০ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমেছে।
একই সঙ্গে এক বছরে ডলারের দর ১০.২০ শতাংশ বেড়ে আন্তঃব্যাংকে এখন ৯৩ টাকা ৯৫ পয়সায় বেচাকেনা হচ্ছে। এ পরিস্থিতিতে ডলারের খরচ কমাতে না পারলে রিজার্ভ বিপৎসীমায় নামতে পারে। আবার ডলারের দর এভাবে বাড়তে থাকলে সবকিছুর দর আরও বাড়তে পারে। যে কারণে কেন্দ্রীয় ব্যাংক চাহিদার পুরো ডলার সরবরাহ না করে অর্ধেক দিচ্ছে। বাকিটা নিজ উদ্যোগে সরবরাহ করতে বলছে। পাশাপাশি আমদানি খরচ কমাতে এবং ডলারের সরবরাহ বাড়াতে বিভিন্ন নির্দেশনা দিচ্ছে।
এ ব্যাপারে ওয়ান ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মনজুর মফিজ বলেন, ‘জাতীয় স্বার্থ বিবেচনায় সব সময় তারা জ্বালানির এলসি খুলে আসছেন। ডলার সংকটের কারণে আপাতত খুলতে পারছেন না।’ তিনি বলেন, ‘এ ধরনের এলসির দায় পরিশোধে এক দিন দেরি করলেও সমস্যা হয়। এ কারণে অনেক ভেবেচিন্তে খুলতে হয়।’
জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘ব্যাংকগুলোর চাহিদার বিপরীতে প্রায় প্রতিদিনই ডলার বিক্রি করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তবে চাহিদার পুরোটা না দিয়ে ব্যাংকগুলোকে রেমিট্যান্স সংগ্রহ ও রপ্তানি আয় বাড়ানোর ওপর জোর দেওয়া হচ্ছে। তা না করে পুরো ডলার তো আর কেন্দ্রীয় ব্যাংক দিতে পারবে না।’ সমকাল।