ভোক্তাকণ্ঠ রিপোর্ট: পাকিস্তান আমলের ২২ পরিবারের মতো বর্তমানে দেশের জ্বালানি খাতও গুটিকয়েক প্রভাবশালী কোম্পানির দখলে রয়েছে। তারা দেশের পুরো বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতকে নিয়ন্ত্রণ করছে বলেও মনে করেন কনজুমারস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্যেষ্ঠ সহ-সভাপতি ও জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক এম শামসুল আলম।
বৃহস্পতিবার জাতীয় প্রেসক্লাবে ‘ক্যাব প্রস্তাবিত জ্বালানি রুপান্তর নীতির বাস্তবায়নে জ্বালানি সনদ চুক্তির ভূমিকা’ শীর্ষক আলোচনায় এনজিও প্রতিনিধিদের সঙ্গে সংলাপের সময় তিনি এ কথা বলেন।
অধ্যাপক এম শামসুল আলম বলেন, ‘জ্বালানি নীতি বাস্তবায়নে যে চুক্তি করা হয়েছে এটি অবাস্তব। পাকিস্তান আমলের ২২ পরিবারের মতো বর্তমানেও সরকারকে ব্যবহার করে কিছু ব্যক্তি ও ব্যবসায়ী সুবিধা নিচ্ছে। তাই এ ধরনের জ্বালানি সনদ চুক্তি করলে পুনরায় তাদের সুযোগ করে দেওয়া হবে। আমরা দিন দিন জ্বালানি সেক্টর চালানোর সক্ষমতা হারিয়েছি। আমরা একটি পাওয়ার প্লান্ট চালাতে পারিনা। বিদেশ থেকে প্রশিক্ষিত কর্মী আনতে হয়। আমাদের সক্ষমতা শুধু দেশের জ্বালানি খাতের কর্মকর্তাদের পদোন্নতি দেওয়া।’
তিনি বলেন, ‘কানাডিয়ান কোম্পানি নাইকো (২০০৫ সালে) গ্যাস উত্তোলনের সময় দুই বার অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। মাগুরছড়ায় গ্যাস উত্তোলনের সময় অক্সিডেন্টাল কোম্পানি বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে। কিন্তু তারা যে অদক্ষ কোম্পানি তা বলা যাবে না। মূলত সেখান থেকে গ্যাস উত্তোলনের জন্য যে পরিমান অর্থের দরকার, সেই পরিমাণ অর্থ তারা পায়নি। তাদের প্রাপ্ত অর্থ থেকে টাকা আত্মসাৎ করেছে (দেশের) সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। যার কারণে এখানে প্রয়োজনীয় দক্ষতা বা যন্ত্রপাতি ব্যাবহার করতে পারেনি।’
ক্যাবের জ্যেষ্ঠ সহ-সভাপতি বলেন, ‘টেংরাটিলায় গ্যাস উত্তোলনের সময় ভয়াবহ দুর্ঘটনায় রাষ্ট্রের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। অথচ তাদের প্রিমিয়াম পাওয়ার ক্ষেত্রেও সহযোগিতা করেছে জ্বালানি বিভাগ তথা পেট্রোবাংলা। যার কারণে নাইকো আন্তর্জাতিক সালিশি আদালতে (ইকসিট) মামলা করার মাধ্যমে ২৭ বিলিয়ন ডলারের ক্ষতিপূরণ পেতে সক্ষম হয়েছে বাংলাদেশ (ক্যাবের মামলার পর উচ্চ আদালত নাইকোকে অর্থ পরিশোধে স্থগিতাদেশ দিয়েছে)।’
তিনি বলেন, ‘যে টাকা গ্যাস উৎপাদন ও উত্তোলনে খরচ করার কথা সেটি ব্যবহার করা হয়েছে আমদানিতে। জনগণের টাকা এভাবে খরচ করা লুণ্ঠনের মতো। সমুদ্রের গ্যাস উত্তোলন করতে না পারলে স্থলের গ্যাস উত্তোলন করা যায় বাপেক্সকে দিয়ে। কিন্তু সেটি করা হচ্ছে না। করা হচ্ছে শুধু আমদানি। যার ফলে মূল্যবৃদ্ধি পাচ্ছে। যার ফলে ক্ষতিকর শিকার হচ্ছেন জনগণ। ভোক্তার অধিকার রক্ষায় কিছুই করা হচ্ছে না। যার ফলাফল মানুষ সক্ষমতা হারাচ্ছে, আর দেশে বিদ্যুৎ জ্বালানির সংকট।’
অধ্যাপক এম শামসুল আলমের সভাপতিত্বে আয়োজিত সংলাপে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে স্বাগত বক্তব্য রাখেন ক্যাবের সভাপতি গোলাম রহমান।
প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ তানজীমউদ্দিন খান।
তিনি বলেন, ‘জ্বালানি সনদ চুক্তি ক্যাব প্রস্তাবিত জ্বালানি রূপান্তর নীতি বাস্তবায়নকে অসম্ভব করে তুলতে পারে। শুধু বিদেশি বিনিয়োগকারীর স্বার্থ রক্ষায় এই আন্তর্জাতিক আইনি কাঠামোটি একপেশে ভাবে কার্যকর। তাই জাতীয় স্বার্থ রক্ষায় জ্বালানি সনদ চুক্তির বিরোধিতা করাটাই মূল কাজ। রাষ্ট্র কিছু প্রতিষ্ঠানের সুবিধার জন্য দেশের পরিবেশ নষ্ট করে দিচ্ছে। এটা হতে পারেনা। এই জ্বালানি চুক্তি স্বাক্ষরে আরও চিন্তা করা দরকার। এই চুক্তিকে না বলা জরুরি। তাই রাষ্ট্র যেন এই চুক্তিতে স্বাক্ষর না করে।’
তানজীমউদ্দিন খান বলেন, ‘বিদ্যুৎ খাতে সবচেয়ে বেশি বিনিয়োগ এসেছে গত কয়েক বছরে। ফলে বোঝা যায় জ্বালানি খাত কতটুকু গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বর্তমান জ্বালানি সনদ এবং জ্বালানি নীতিতে বেশ কিছু সাংঘর্ষিক বিষয় রয়েছে। ফলে জ্বালানি চুক্তি নিয়ে নতুন করে ভাবা উচিৎ।’
এছাড়াও সংলাপে ক্যাবের সাধারণ সম্পাদক এড. হুমায়ুন কবির, ক্যাবের কোষাধ্যক্ষ ড. মনজুর ই খোদা, প্রকৌশলী শুভ কিবরিয়াসহ দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে আগত এনজিও সংগঠনের প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন।