ভোক্তাকণ্ঠ ডেস্ক: স্ত্রী ও দুই সন্তান নিয়ে বরিশাল নগরীর ১১ নম্বর ওয়ার্ডের বঙ্গবন্ধু কলোনিতে ভাড়া বাসায় থাকেন ষাটোর্ধ্ব সাত্তার হাওলাদার। নিজে বার্ধক্যজনিত রোগে ভুগলেও পরিবারের বোঝা তার কাঁধে। রিকশা চালিয়ে চলে সংসার। একদিন রিকশার চাকা বন্ধ থাকলেই হাত পাততে হয় অন্যদের কাছে।
রিকশা চালিয়েই ঘরভাড়া, বিদ্যুৎ বিল, বাজার-সদাই, স্ত্রীর ওষুধ ও ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার খরচ জোগাতে হয় সাত্তার হাওলাদারকে। তবে প্রতিদিনই সবকিছুর দাম যে হারে বাড়ছে তাতে কোনো হিসাব মেলাতে পারছেন এ বৃদ্ধ।
সাত্তার হাওলাদার বলেন, ‘দিন দিন যে হারে সবকিছুর দাম বাড়ছে তাতে আমাদের মতো মানুষদের না খেয়ে মরা ছাড়া উপায় নেই। প্রতি মাসেই সব খরচের একটা হিসাব থাকে। কিন্তু সব হিসাব উল্টে যায় মাস শেষে। সংসারের বাজার খরচ, বিদ্যুৎ বিল, ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার খরচ, স্ত্রীর ওষুধের খরচ প্রতি মাসেই বেড়ে যাচ্ছে। রিকশার (ব্যাটারিচালিত) জমা খরচ আগে যেখানে ছিল ২০০ টাকা, এখন তা বেড়ে ৩০০ টাকা হয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘আগে প্রতি মাসে স্ত্রীর জন্য ১ হাজার ২০০ থেকে ১ হাজার ৬০০ টাকার ওষুধ লাগতো। এখন সেই একই ওষুধের দাম বেড়ে ১ হাজার ৮০০ টাকা হয়েছে। এভাবে প্রতিটি জিনিসের দাম বাড়ায় আমি আর পেরে উঠছি না।’
শুধু সাত্তার হাওলাদার নন, তার মতো নিম্নআয়ের মানুষেরা বলছেন, সবকিছুর সঙ্গে জীবন রক্ষাকারী ওষুধের দামও বেড়ে যাওয়ায় উভয় সংকটে পড়েছেন। খরচ কাটাছেঁড়া করেও তারা হিসাব মেলাতে পারছেন না।
নগরীর আলেকান্দা নুরিয়া স্কুল এলাকার রাজমিস্ত্রি ইউনুস জোমাদ্দার একজন হার্টের রোগী। তিনি বলেন, ‘দু তিনমাস আগেও যেই ওষুধ (কার্ভিস্টা, বাইজোরান, লিপিকন, এটোবা-২০) কিনছি ২ হাজার ৮০ টাহায়, এহন হেই ওষুধ কিনতে লাগে ২ হাজার ৫০০ টাহার বেশি। মাঝে মাঝে পুরা এক মাসের ওষুধ কিনতেও পারি না। ২-৩ হপ্তার ওষুধ কিইন্না বাড়ি ফিরি। ওষুধের দাম এই রহম যদি বাড়তে থাহে তাহলে মাসের অর্ধেক সোময় ওষুধ না খাইয়া থাকতে হবে।’
নগরীর সাগরদী এলাকার শিক্ষিকা ছালমা আক্তারের ছেলে সোহেল শিকদার বলেন, তার বাবা একজন প্রেসারের রোগী। পাশাপাশি ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। প্রতি মাসেই তার জন্য প্রেসারের টেনোলক ও ডায়াবেটিসের ইনোবেটসহ বেশ কয়েকটি ওষুধ কিনতে হয়।
সোহেল শিকদার বলেন, ‘দু চারমাস আগেও যা কিনতে প্রতি মাসে খরচ হতো আড়াই থেকে তিন হাজার টাকা, এখন সেই ওষুধ কিনতে হচ্ছে সাড়ে তিন থেকে চার হাজার টাকায়। এভাবে সব জিনিসপত্রের সঙ্গে ওষুধের দামও সমানতালে বাড়ছে। আর বাড়লেও তো আমাদের মতো সাধারণ মানুষের কিছু করার নেই। বাধ্য হয়েই আমাদের কিনতে হয়।’
নগরীর আমতলা এলাকার ভ্রাম্যমাণ সবজি বিক্রেতা নুর আলম বলেন, ‘কোনো রহম জীবন নিয়ে বাইচ্চা আছি ভাই। মাছ-মাংসের কথাতো বাদ, ডিম কিইন্না খাইতেও এহন কষ্ট। হের মধ্যে মেলাদিন ধইরা গ্যাস্ট্রিকের রোগে ভোগদেআছি। আগে যে গ্যাস্ট্রিকের ওষুধ ৮০ টাহায় পাতা কিনছি, এহন হেই ওষুধ ১২০ টাহায় পাতা কেনা লাগে। বুক জইল্লা গেলেও মাঝে মাঝে ওষুধ কিনি না।’
শনিবার বরিশাল নগরীর বিভিন্ন এলাকার ওষুধের দোকান ঘুরে জানা যায়, প্যারাসিটামলসহ সব ধরনের ওষুধের দাম বেড়েছে কয়েক শতাংশ। ছয় মাসের ব্যবধানে প্যারাসিটামল গ্ৰুপের সব ওষুধ পাতাপ্রতি ৪-৮ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে।
প্যারাসিটামল গ্ৰুপের নাপা প্রতি পাতা ৮ টাকা থেকে বেড়ে ১২ টাকা, নাপা এক্সটেন্ড ১৫ থেকে বেড়ে ২০ টাকা, এইচ ১২ থেকে ১৬ টাকা, নিউ ভাইটাল ৫ থেকে বেড়ে ৯ টাকা, নাপাডল ৮ থেকে বেড়ে ১৪ টাকা করে বিক্রি হচ্ছে। ডিফল্যাক্স ৪৫ থেকে বেড়ে ৬০ টাকা এবং বিসলল ২.৫ এমজি আগে ৮৪ টাকায় বিক্রি হলেও এখন ৯৮ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
বিভিন্ন ধরনের সিরাপের দাম বোতলপ্রতি ১০ থেকে ৫০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। নাপা সিরাপ ২০ থেকে বেড়ে ৩৫ টাকা, ফেক্সো ৬০ থেকে বেড়ে ৮০ টাকা, সেকরিন টু ৯০ থেকে বেড়ে ১০০ টাকা, নেপ্রো এ প্লাস ১০ থেকে বেড়ে ১২ টাকা, ওকফ ১০০ থেকে বেড়ে ১১০ টাকা, ডেক্সপ্রোটিন ১০০ থেকে ১১০ টাকা এবং সিনকারা ২০০ থেকে বেড়ে ২৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। পাঁচ টাকার ওরস্যালাইন প্যাকেটপ্রতি দুই টাকা করে বেড়ে সাত টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
নগরীর আলেকান্দা এলাকার কেয়ার ফার্মার স্বত্বাধিকারী মেহেদী হাসান শাম্মী বলেন, গত ছয়মাসে প্রায় সব ওষুধের দাম বেড়েছে। পাতা ও বোতলপ্রতি ২ থেকে ৫০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। তবে মূল্যবৃদ্ধির বিষয়টি সরাসরি ঔষধ প্রশাসন নিয়ন্ত্রণ করে বলে জানান এ বিক্রেতা।
তিনি আরও বলেন, ‘কোনো ফার্মেসি মালিক ওষুধের দাম বাড়াতে পারেন না। ফার্মেসি মালিকরা ঔষধ প্রশাসন কর্তৃক নির্ধারিত মূল্যেই ওষুধ বিক্রি করেন। বরং ওষুধের গায়ে লেখা মূল্যের চেয়ে কম মূল্যে বিক্রি করতে হয়।’
নগরীর রূপাতলী এলাকার সৈয়দ ফার্মেসির মালিক আবু হোরায়রা লিটন বলেন, ওষুধ কোম্পানিগুলো কোনো কারণ ছাড়াই দাম বাড়াচ্ছে। কোম্পানিগুলোর বিক্রয় প্রতিনিধিদের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তারা জানান, দেশে কাঁচামাল সংকট। ডলার সংকট থাকায় বিদেশ থেকে পর্যাপ্ত পরিমাণে কাঁচামাল আমদানি করতে না পারা মূল্যবৃদ্ধির অন্যতম কারণ।
এ বিষয়ে বরিশাল ফার্মেসি মালিক সমিতির সভাপতি গাজী আক্তারুজ্জামান হিরু বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে ডলারের মূল্যবৃদ্ধি ও ডলার সংকটের কারণেই মূলত ওষুধের দাম বাড়ছে। তবে ওষুধের মূল্য নির্ধারণের বিষয়টি সরাসরি সরকারের হাতে।
‘আমরা সরকার নির্ধারিত মূল্যে ওষুধ বিক্রি করি। কোম্পানিগুলো আমাদের ১২ শতাংশ পর্যন্ত লভ্যাংশ দিয়ে থাকে, যা দিয়ে সরকারি ট্যাক্স, দোকান ভাড়া, কর্মচারী বেতন ও বিদ্যুৎ বিল দিয়ে টিকে থাকা এখন দায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। লভ্যাংশ না বাড়ালে এভাবে চলতে থাকলে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে যাবে। যার ভয়ংকর প্রভাব পড়বে ওষুধ শিল্পের ওপর,’ যোগ করেন গাজী আক্তারুজ্জামান হিরু।
ওষুধের মূল্যবৃদ্ধির বিষয়ে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর বরিশাল বিভাগীয় কার্যালয়ের উপ-পরিচালক অপূর্ব অধিকারী বলেন, ফার্মেসিগুলোতে আমাদের নিয়মিত অভিযান অব্যাহত রয়েছে। কেউ মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ বিক্রি করলে তাকে জেল-জরিমানা করা হচ্ছে। সরকার নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে বেশি মূল্যে ওষুধ বিক্রি করলেও আইনের আওতায় আনা হবে।
সৌজন্য, জাগো নিউজ।