ভোক্তাকণ্ঠ ডেস্ক: লোডশেডিং কেন হয়? যখন যথেষ্ট বিদ্যুৎ থাকে না তাই। চাহিদা আর জোগানের পার্থক্য সৃষ্টি হলে লোডশেডিং হয়। তাহলে সম্পূরক প্রশ্ন, বিদ্যুৎ কেন নাই? এর কারণ খুব সহজ- হয় উৎপাদন হচ্ছে না অথবা সরবরাহ হচ্ছে না। আমরা জেনেছি মূল সমস্যা উৎপাদনে- সহজ করে বললে জ্বালানির সমস্যা।
বাংলাদেশের জ্বালানি-সরবরাহ ব্যবস্থা আমদানির উপর নির্ভরশীল। আমাদের নিজস্ব গ্যাসের ঘাটতি রয়েছে, কেননা নতুন উৎসের কোনো সন্ধান নেই। জ্বালানি তেল এবং কয়লাও আমদানি করতে হয়। আমাদের নিজস্ব কয়লা যতটুকু আছে, তার উত্তোলনের তেমন সমন্বিত কোনো পরিকল্পনা নেওয়া হয়নি, তাছাড়া এর রয়েছে পারিপার্শ্বিক সমস্যা। তাই কয়লা-চালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য কয়লাও আমদানি করতে হয়।
সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, যেহেতু ডলার-সংকট রয়েছে তাই আমদানি সীমিত রাখা হয়েছে। এর কারণ অবশ্য শুধু অভ্যন্তরীণ নয়, বৈশ্বিক। সারাবিশ্ব জুড়ে করোনা অতিমারি-পরবর্তী অবস্থা এবং ইউক্রেন যুদ্ধ যে বৈশ্বিক পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে তার ফলশ্রুতিই এই জ্বালানি সংকট। এটা অর্থনৈতিক সংকটও তৈরি করেছে।
রাশিয়া থেকে গ্যাস বন্ধ হয়ে যাওয়ায় সারা ইউরোপ মধ্যপ্রাচ্য এবং অন্যান্য জ্বালানি উৎসের দিকে ঝুঁকে পড়েছে। অন্যদিকে আছে আগ্রাসী চীন এবং তার সুবিপুল উৎপাদন খাতের চাহিদা। ফলে স্বাভাবিকভাবেই দাম বেড়ে গেছে এবং জ্বালানি বাজারে আগের স্থিরতা আর নেই।
লোডশেডিংয়ের কারণ
এখনকার লোডশেডিংয়ের মূল কারণ ডলার সংকট। তবে পরিকল্পনার ঘাটতি আমাদের আগে থেকেই রয়েছে। আমাদের হালনাগাদ এনার্জি পলিসি নেই, প্রায় ত্রিশ বছর থেকে চলছে। শর্ট টার্ম বা বলা যায় তাৎক্ষণিক সমস্যা সমাধানে আমরা আগ্রহী। আমরা দূর-ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবতে চাই না। ফলে পাওয়ার সিস্টেম মাস্টার প্ল্যান করা হলেও সেগুলোর সীমাবদ্ধতাও আমরা দেখেছি।
সব মিলিয়ে পরিকল্পনাহীনতার একটা প্রবণতা আমাদের ঐতিহাসিকভাবে থাকলেও বর্তমান সংকট ধারাবাহিক পরিকল্পনার অভাবে হয়নি। একটি আঞ্চলিক যুদ্ধ এবং একটি বৈশ্বিক মহামারি বিশ্বব্যাপী কী ধরনের রিপল-ইফেক্ট তৈরি করবে সেটা পরিকল্পনা করে আগাম জানা যায় না।
লোডশেডিং থেকে আশু পরিত্রাণের কোনো লক্ষণ নেই। তবে সরকার কাতারের সঙ্গে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাসের (এলএনজি) যে দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি করেছে সেটা খুবই উৎসাহোদ্দীপক। এর ফলে অন্তত ভবিষ্যতে জ্বালানির একটি নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ নিশ্চিত করা গেল। তাছাড়া ব্রুনাইয়ের সাথেও আমাদের ভালো বোঝাপড়া হতে যাচ্ছে এবং সেখান থেকেও আমরা দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির অধীনে জ্বালানি পেতে পারি।
এগুলো ভালো দিক, আশার দিক। তবে জ্বালানি পেলেও এর ব্যবহার, সরবরাহ এবং বিলিবণ্টনে আমাদের সুপরিকল্পনার ছাপ দেখাতে হবে। যেমন ফ্লোটিং এলএনজি টার্মিনালের বদলে অনশোর রিজার্ভার বা স্থল-ডিপো বানাতে হবে, শুধু চট্টগ্রামকেন্দ্রিক এলএনজি সরবরাহ না করে পশ্চিম উপকূলে, যেমন পায়রায়, আমাদের একটা ব্যবস্থা রাখতে হবে।
খুব সম্ভবত আগামীতে আমাদের ভরসার জ্বালানি হতে যাচ্ছে এলএনজি। অতএব এর সংরক্ষণ, সরবরাহ এবং বণ্টনে আমাদের পরিপক্বতা দেখাতে হবে। নচেৎ এই ধরনের সমস্যা বারবার হবে। এতে জনজীবন মারাত্মক বিঘ্নিত হবে, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ব্যাহত হবে, আমাদের পরিস্থিতি ঘোলাটে হবে। সেটা রাজনৈতিকভাবেই কাম্য নয়।
পুরাতন বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু
বাস্তবতা হচ্ছে, অনেকগুলো পুরাতন স্টেশন আছে যাদের উৎপাদন আয়ুষ্কাল পেরিয়ে গেছে। অর্থাৎ তারা আর আগের মতো দক্ষতায় বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারছে না। এখন সেগুলো পর্যায়ক্রমে বাদ দিতে হবে। অথবা আধুনিক প্রযুক্তির আমদানি করে সেগুলো উন্নত করে লাইভ জেনারেশনে যেতে হবে। এগুলো খরচ আর সময়সাপেক্ষ।
তাছাড়া মূল জ্বালানির সমস্যা রয়েই যাচ্ছে। সেক্ষেত্রে আপতকালীন সমাধান হিসেবে এসব নিষ্ক্রিয় কেন্দ্রগুলো সোলার বসিয়ে কিছুটা বিদ্যুৎ পাওয়া যেতে পারে। জ্বালানি না পেলে আরও কিছু কেন্দ্র চলবে না সেটা একটা বাস্তব সমস্যা। জ্বালানি সংকটের বিষয়ে আগেই বলেছি।
জ্বালানি সংকট
বিশ্বের বহু দেশের মতোই বাংলাদেশও জ্বালানি আমদানি করে চলে- আমাদের জ্বালানি বাস্তবতা আমদানির বাস্তবতা। আমদানি খাতে ডলারের মূল্য কম-বৃদ্ধি হলে এই খাতও উথালপাতাল করবে। এখন সুন্দর পরিকল্পনা করে এই উথালপাতাল প্রপঞ্চকে কিছুটা প্রশমিত করা যায়, কিন্তু সবটুকু যাবে না।
সেইক্ষেত্রে জ্বালানির বিকল্প সরবরাহ (গ্যাসের জন্য ব্রুনাই, ওমান, কাতার; তেলের জন্য সৌদি আরব, রুশ; কয়লার জন্য অস্ট্রেলিয়া, ইন্দোনেশিয়া) এবং বিকল্প উৎস (সোলার, উইন্ড, বায়োগ্যাস) দেখতে হবে। এসবের জন্য চাই দীর্ঘমেয়াদি গবেষণা এবং গবেষক-দল তৈরি। একটা নির্দিষ্ট দেশীয় এক্সপার্ট-পুল থাকলে নিজেদের সমস্যার চটজলদি সমাধান আমরা নিজেরাই করতে পারব। এর জন্য চাই এনার্জি এডুকেশনে জোর দেওয়া এবং সামান্য লগ্নি।
পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্র
১,৩২০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ হয়েছে কেননা তার জ্বালানি নেই। এর জ্বালানি কয়লা এবং কেন্দ্রটির মজুদ ফুরিয়ে গিয়েছে। কেন্দ্রটির জ্বালানি সরবরাহ বা সাপ্লাই-চেইন কীভাবে ডিজাইন করা হয়েছে সেটা আমরা জানি না।
শোনা যায়, সরাসরি কোল-মাইনারদের সাথেই চুক্তিবদ্ধ। তবে কোল-ডিলার যারা আছে তাদের সাথে চুক্তি থাকলে যেভাবেই হোক সাপ্লাই-চেইন অক্ষত থাকে। এটা একটা আর্গুমেন্ট। এর পাল্টা আর্গুমেন্ট হচ্ছে, ডলার-সংকট থাকলে আপনি কয়লা কিনবেন কীভাবে? এখন এর সমাধান আমাদের হাতে নেই, কেননা সম্পূর্ণ তথ্য আমাদের হাতে নেই। শোনা যাচ্ছে, ২০-২৫ দিন পর কয়লার সরবরাহ স্বাভাবিক হবে।
সত্য হচ্ছে, কয়লা ‘দূষণকারী’ জ্বালানি হলেও তুলনামূলক সস্তা এবং প্রচুর রিজার্ভ থাকায় এটা বেশ নির্ভরযোগ্য জ্বালানি। প্রাচীনকালে মার্কো পোলো যখন চীন ঘুরে এসে জানালেন যে কালোপাথরের মতো একটা জিনিস আছে যেটা ধিকিধিকি জ্বলে আর তাপ দেয়, সেই থেকেই ইউরোপে কয়লার আগ্রহ জন্মায়।
পরে বাষ্পীয় ইঞ্জিনের হাত ধরে শিল্প-বিপ্লবের যে আগমন সেটা পুরোটাই কয়লার হাত ধরে এসেছে। আজও দেশে দেশে কয়লার জয়জয়কার। নিচের সারণি দেখলেই বোঝা যাবে বিভিন্ন দেশের বিদ্যুৎ-উৎপাদনের একটা বড় শতাংশ কয়লা থেকে আসে।
দেশে দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদনে কয়লার শতকরা অবদান (২০১৪)
এই হার এখন কমে এলেও রাতারাতি নাটকীয় কোনো পরিবর্তন হয়নি। ইন্টারন্যাশনাল এনার্জি এজেন্সির ‘কোল ২০২২’ মোতাবেক ২০২২ সালেই বৈশ্বিক কয়লার চাহিদা ৮ বিলিয়ন টন ছাড়িয়ে গেছে। চীনে গ্রীষ্মকালীন খরায় পানি বিদ্যুতের সংকটের ফলে কয়লা থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়েছে ৫০০ টেরাওয়াট-ঘণ্টা এবং সেটা শুধুমাত্র ২০২২ সালের আগস্ট মাসেই।
অন্যান্য দেশেও বাতাসের পড়তি, খরা এবং পানির স্বল্পতার ফলে কয়লা বিদ্যুতের চাহিদা বেড়েছে। ইউরোপেও একই অবস্থা। দূষণের ভয়ে অনেকেই কয়লা ব্যবহারে অনিচ্ছুক। কিন্তু সস্তা ও নির্ভরযোগ্যতার দিক থেকে কয়লার কোনো বিকল্পও নেই। সেই তুলনায় সৌরবিদ্যুৎ, বায়ুবিদ্যুৎ চমৎকার পরিবেশবান্ধব হলেও এদের নির্ভরযোগ্যতা প্রশ্নবিদ্ধ।
ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে বৈশ্বিক কয়লার মূল্যও কিন্তু অনেক বেড়ে গিয়েছিল। সেক্ষেত্রে আমাদের নিজস্ব কয়লাখনির বিষয়ে কয়লা-নীতি প্রণয়ন প্রয়োজন, সেটা কিন্তু করা হয়নি। ফলে কয়লাকে আমরা অচ্ছুত ভেবে নিলেও বাস্তবতা ভিন্ন কথা বলে।
এসব বিবেচনায় দীর্ঘমেয়াদে পরিচ্ছন্ন বিদ্যুৎশক্তির জন্য পরমাণু শক্তি অত্যন্ত নির্ভরযোগ্য এবং বিকল্প হিসেবে প্রমাণিত। এই বিষয়ে কিছু অজানা ভয় কাজ করে। কিন্তু নিউক্লিয়ার পাওয়ার একটি নির্ভরযোগ্য উৎস, বড় কথা এর প্রায় কোনো নিঃসরণ নেই। তবে এর নিরাপদ-ব্যবহার একটা সমস্যা। একে প্রকৌশলগত সমস্যা হিসেবে বিবেচনা করলে এবং এই লক্ষ্যে সক্ষমতা অর্জনে গুরুত্ব দিলে এই খাত আমাদের একটা নির্ভরযোগ্য সমাধান দেবে।
আন্তর্জাতিক জ্বালানি এজেন্সি কর্তৃক প্রকাশিত বৈশ্বিক কয়লা উৎপাদন (২০২২)
আঞ্চলিক গ্রিডের সাথে জাতীয় গ্রিড সংযুক্ত হলে বিদ্যুৎ পরিস্থিতি স্বস্তি দিতে পারে। নেপাল ও ভুটানের পানি বিদ্যুতের বিশাল সম্ভাবনা কাজে লাগিয়ে আন্তসীমান্ত বিদ্যুৎ-বাণিজ্য (ক্রস বর্ডার এনার্জি ট্রেড) আমাদের ঋতুভিত্তিক ঘাটতি পূরণ করতে সাহায্য করবে। কিন্তু এই ধরনের আন্তদেশীয় জ্বালানি বাণিজ্যে একাধিক দেশের সাথে কূটনৈতিক সখ্যতা ও স্থিতি থাকা প্রয়োজন।
এছাড়া বার্মার রাজনৈতিক পরিস্থিতি উন্নত হলে আমরা আসিয়ান গ্রিডের সাথে যুক্ত হতে পারব, ফলে এনার্জি-হুইলিং এর মাধ্যমে ভিয়েতনামের সৌর-বিদ্যুতের জোগান ব্যবহার করতে পারব, অন্তত তাত্ত্বিকভাবে। তবে আন্তদেশীয় সম্পর্ক, ইন্টারন্যাশনাল ট্রেড অ্যালায়েন্স, আঞ্চলিক সহযোগিতা ফ্রেমওয়ার্কের দরকার পড়বে রিজিওনাল গ্রিড ব্যবহারে। তবে বৈশ্বিক জলবায়ুজনিত সমস্যা, যেমন এল নিনো (EL Nino) সংক্রান্ত আঞ্চলিক খরা, থেকে উদ্ভূত সমস্যা কিন্তু থাকবেই।
সোলার চালু
সোলারের বিষয়ে এখন অনেক সচেতনতা বৃদ্ধি পেয়েছে। দেশে এখন বেশ কয়েকটি সোলার পার্ক মাঝারি পর্যায়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করছে এবং জাতীয় গ্রিডে সরবরাহ করছে। দেরিতে হলেও এদিকে সরকারি এবং বেসরকারি মনোযোগ বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে এক্ষেত্রে মূলধন লগ্নি ও আমদানিতে কিছু নীতিগত পরিবর্তনের সুযোগ আছে যা পরিবর্তন / সংশোধন / হালনাগাদকরণ প্রয়োজন।
তাছাড়া জমির লভ্যতা ও দাম এবং সূর্যালোকের প্রাপ্যতা ও ঋতুভেদে ভিন্নতা গ্রিডের জন্য সমস্যা তৈরি করে। মেগাওয়াট-স্তরে বিদ্যুৎ সঞ্চয় বা স্টোরেজ ভীষণ খরচ সাপেক্ষ। আশা করা যায়, এই খরচ কমে আসবে। কিন্তু কত কমবে, কবে কমবে সেটাও দেখার বিষয়।
ড. ফারসীম মান্নান মোহাম্মদী, পরিচালক, জ্বালানি ও টেকসই গবেষণা ইন্সটিটিউট; অধ্যাপক, তড়িৎকৌশল বিভাগ, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়।
সৌজন্যে, ঢাকা পোস্ট।