‘অধিকাংশ পণ্যের মূল্য মানুষের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে’

ভোক্তাকণ্ঠ রিপোর্ট: আপাত দৃষ্টিতে বাজারে সরবরাহে ঘাটতি নেই। তা সত্ত্বেও দেশে উৎপাদিত এবং বিদেশ থেকে আমদানিকৃত নিত্যপ্রয়োজনীয় প্রায় সব পণ্যের মূল্য হু হু করে বাড়ছে। অধিকাংশ পণ্যের মূল্য এখন সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে। অনেকে সঞ্চয় ভেঙ্গে আর ধার-কর্জ করে অতি প্রয়োজনীয় পণ্য ক্রয় করছেন। অনেক চাহিদাই পূরণ সম্ভব হচ্ছে না। জীবনমানে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে।

মঙ্গলবার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে জাতীয় প্রেস ক্লাবের জহুর হোসেন চৌধুরী হলে ‘দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি ও করণীয়’ শীর্ষক একটি সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা বলেন কনজুমারস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) এর সভাপতি গোলাম রহমান।

তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অব্যাহত মূল্যবৃদ্ধির ফলে জনসাধারণের কষ্টে একাধিকবার দুঃখ প্রকাশ এবং মুদ্রাস্ফীতির লাগাম টানায় উদ্যোগ নিতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দিয়েছেন। অন্যদিকে, অর্থমন্ত্রী আ হ ম মোস্তফা কামালসহ জ্যেষ্ঠ মন্ত্রীদের অনেকে বলছেন, মুদ্রাস্ফীতি সরকারের নিয়ন্ত্রণে আছে। বাংলাদেশের মানুষ পৃথিবীর অন্যান্য দেশের তুলনায় অনেক ভালো আছে।

তিনি আরও বলেন, বিগত বছরের বাজেটে মুদ্রাস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রা স্থির করা হয়েছিল ৫ দশমিক ৬ শতাংশ। সংশোধিত বাজেটে নির্ধারণ করা হয় ৭ দশমিক ৫ শতাংশ। এই লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণের কয়েকদিনের মধ্যে প্রকাশিত বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাবে দেখা যায়, ২০২২-২৩ অর্থ বছরে মুদ্রাস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ০২ শতাংশ, যা বিগত এক যুগের মধ্যে সর্বোচ্চ। আর টিসিবির বাজার দর পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, গত এক বছরে অনেক পণ্যেরই মূল্যবৃদ্ধি ছিল তার চেয়ে অনেক বেশি।অনেকে মনে করেন সাধারণ মানুষের জীবনে মুদ্রাস্ফীতির আঁচ পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাবে সঠিক ভাবে প্রতিফলিত হচ্ছে না।

গোলাম রহমান বলেন, সরকারের ধারণা, করোনা মহামারি পরবর্তী সময়ে বিশ্বজুড়ে সরবরাহ সংকট, বর্ধিত চাহিদা, জাহাজ ভাড়া বৃদ্ধি ইত্যাদি কারণে পণ্যমূল্য বেড়েছে। আর সাম্প্রতিক মূল্যবৃদ্ধির কারণ, এক বছরেরও বেশি সময় ধরে চলা রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। অর্থনীতিবিদদের অনেকে মনে করেন, অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাংক, বিশেষ করে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে মাত্রাতিরিক্ত ঋণ গ্রহণের ফলে মুদ্রা সরবরাহ বেড়েছে, যা মুদ্রাস্ফীতিকে উসকে দিয়েছে। ব্যবসায়ী নেতারা বলছেন, ডলার সংকটের কারণে আমদানি ব্যাহত হচ্ছে, সরবরাহ চেইন বিঘ্নিত হচ্ছে এবং মূল্যবৃদ্ধি পাচ্ছে।

তিনি বলেন, চাহিদা-সরবরাহের ফারাক, আন্তর্জাতিক বাজার মূল্য অথবা মুদ্রা সরবরাহ বৃদ্ধি, কোনো ব্যাখ্যাই সাধারণ মানুষের নিকট প্রাসঙ্গিক নয়। তারা মূল্যবৃদ্ধিতে কষ্টে আছে। তাদের জীবনমানের অবক্ষয় হচ্ছে। তারা মনে করে সরকারের ব্যর্থতার কারণে অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি হচ্ছে।

তিনি আরও বলেন, প্রধান প্রধান গণমাধ্যম, পত্রিকা ও টেলিভিশন নিয়মিত ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট এবং তাদের তদারকিতে ও নিয়ন্ত্রণে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ব্যর্থতাকে মূল্যবৃদ্ধির জন্য দোষারোপ করছে। এ অভিযোগের কিছুটা ভিত্তি থাকলেও, পরিপূর্ণ ব্যাখ্যা নয়। জাতীয় ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয় বাজার তদারকি এবং অভিযান পরিচালনা, ব্যবসায়ী নেতৃবৃন্দ, উৎপাদক, পরিশোধনকারী, পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আলোচনা ও দেন-দরবারের মাধ্যমে কিছু পণ্যের মূল্য নির্ধারণ ও নিয়ন্ত্রণের উদ্যোগ নিয়েছে এবং ক্ষেত্র বিশেষে সফলতা লাভ করেছে। সার্বিক মূল্যস্ফীতির লাগাম টানায় তা কোনো অবদান রাখছে বলে মনে হয় না। সরকারের নির্দেশে, টিসিবি এক কোটি পরিবারের মধ্যে ভর্তুকি মূল্যে কয়েকটি পণ্য বিক্রি করছে। এতে সুবিধাভোগী দরিদ্র পরিবার উপকৃত হচ্ছে, কিন্তু মুদ্রাস্ফীতির ঊর্ধ্বগতি থামছে না। সরবরাহ সংকট অথবা চাহিদা বৃদ্ধির কারণে মূল্য বাড়ছে এমন সরল ব্যাখ্যা বর্তমান প্রেক্ষাপটে সঠিক নয়। তাই একক ভাবে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে কাঠগড়ায় উঠানো যুক্তিযুক্ত মনে হয় না।

ক্যাব সভাপতি বলেন, বিশ্ব বাজারে অনেক পণ্যেরই মূল্য কমে এসেছে। বিভিন্ন দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও অর্থ মন্ত্রণালয় স্ব-স্ব দেশের ভোক্তাদের বিদেশ থেকে আক্রান্ত মুদ্রাস্ফীতি থেকে রক্ষার জন্য মুদ্রা ও আর্থিক ব্যবস্থাপনায় নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক বার বার ‘সুদের হার’ বৃদ্ধি এবং অর্থ মন্ত্রণালয় মুদ্রাস্ফীতি নিরোধক আর্থিক ও রাজস্ব ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে স্ব-স্ব দেশে মুদ্রাস্ফীতির লাগাম টানার উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। প্রতিবেশী ভারতে গত এপ্রিলে মুদ্রাস্ফীতির হার ছিল ৪ দশমিক ৭ শতাংশ, যা অক্টোবর ২০২১ এর পর সর্বনিম্ন। মে মাসে ইউরো জোনে মুদ্রাস্ফীতি ৬ দশমিক ১ শতাংশে নেমে এসেছে, যা রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর সবচেয়ে কম। এপ্রিলে কানাডা, ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়ায় মুদ্রাস্ফীতি ছিল যথাক্রমে ৪ দশমিক ৩, ৪ দশমিক ৩ এবং ৩ দশমিক ৪ শতাংশ। চীনে মে মাসে মূল্যবৃদ্ধি ছিল মাত্র ০ দশমিক ২ শতাংশ, যা দুই বছরে সর্বনিম্ন, আর ভিয়েতনামে ২ দশমিক ৪৩ শতাংশ, বিগত ১৪ মাসে সবচেয়ে কম। এপ্রিলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মুদ্রাস্ফীতি ৫ দশমিক ০ শতাংশে নেমে এসেছে। স্পষ্টতই, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধকে দেশে মূল্যবৃদ্ধির অজুহাত হিসাবে দেখানো, বড়জোর খোড়া যুক্তি।

তিনি বলেন, সারা বিশ্ব মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য যেসব ব্যবস্থা নিয়েছে, বাংলাদেশ তা থেকে বিরত থেকেছে। পৃথিবীর সর্বত্র কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুদের হার বৃদ্ধি করাকে মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করে। বাংলাদেশ ব্যাংক ২০২০ সালে ব্যাংক আমানতের সর্বোচ্চ হার ৬ দশমিক ০ শতাংশ এবং ঋণের সর্বোচ্চ হার ৯ দশমিক ০ শতাংশ নির্ধারণ করে এবং সময়ের সঙ্গে সংশোধন না করে জেদি ভাবে, তা অনুসরণ করে এসেছে। বাজেট ঘাটতি মেটাতে অর্থ মন্ত্রণালয় বিগত অর্থবছরে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে এক লাখ এক হাজার কোটিরও বেশি টাকা ঋণ নিয়েছে। টাকশালে টাকা ছাপিয়ে এই ঋণ দেয়া হয়েছে। অর্থনীতিবিদদের ধারণা- এতে অর্থনীতিতে মুদ্রা সরবরাহ পাঁচ গুণ, অর্থাৎ পাঁচ লক্ষ কোটি টাকা বেড়েছে। (তবে বাংলাদেশ ব্যাংক রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করে বড় অংকের অর্থ বাজার থেকে তুলে নেয়ার দাবি করছে)।

তিনি আরও বলেন, অর্থনীতির সূত্র অনুযায়ী- অর্থ সরবরাহ বাড়ার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে পণ্য ও সেবার মূল্য বাড়ে। বার বার বিদ্যুৎ, গ্যাস ও জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধিও মুদ্রাস্ফীতিকে উসকে দিয়েছে। রপ্তানি ও রেমিটেন্স থেকে বৈদেশিক মুদ্রার আয় আমদানি ব্যয় থেকে পরিমাণে অনেক কম হওয়ায় বিগত এক বছরের কিছু বেশি সময়ে ডলারের বিপরীতে টাকার মূল্য ২৫ শতাংশের অধিক হ্রাস পেয়েছে। বৈদেশিক মুদ্রার মূল্যবৃদ্ধির ফলে টাকায় আমদানিকৃত পণ্যের মূল্য বহুলাংশে বাড়ছে। সঙ্গে সঙ্গে টাকার অংকে কর ভ্যাটও বাড়ছে। ফলশ্রুতিতে পণ্য মূল্য বাড়ছে। এ প্রেক্ষিতে বিশ্ব বাজারে পণ্যের দর পতনের সুফল থেকেও বাংলাদেশের ভোক্তারা বঞ্চিত হচ্ছে।

গোলাম রহমান বলেন, অর্থমন্ত্রী মোস্তফা কামাল ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটে মুদ্রাস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রা ৬ দশমিক ০ শতাংশ নির্ধারণ করেছেন। সরকারের ব্যয় মেটানোর জন্য ব্যাংকিং খাত, বিশেষ করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে অধিক ঋণ গ্রহণের সম্ভাবনা কিন্তু শুভ লক্ষণ নয়। এতে মুদ্রাস্ফীতি আরও লাগামহীন হয়ে পড়তে পারে।

তিনি বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক জুলাই-ডিসেম্বর ২০২৩ এর মুদ্রানীতি প্রকাশ করেছে। বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার বাজারভিত্তিক করা এবং অপ্রয়োজনীয় ও বিলাসবহুল পণ্য আমদানি নিয়ন্ত্রণ অব্যাহত রাখার কথা বলা হয়েছে। আশা করা যায়, এতে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কিছুটা হলেও বাড়বে। মুদ্রানীতি ঘোষণার সময় বাংলাদেশ ব্যাংকের গর্ভনর বলেছেন, ‘নয়-ছয়’ সুদের হার নির্ধারণ এবং তা কিছুটা শিথিল করার সিদ্ধান্ত রাজনৈতিক। অর্থনীতিবিদদের ধারণা, এতে ‘সুদের হার’ বাজারভিত্তিক হবে না। অধিকন্তু, মুদ্রাস্ফীতি এক জটিল রোগ, এ ক্ষেত্রে শক্তিশালী ওষুধের প্রয়োজন। সুদের হার এক-দুই শতাংশ বৃদ্ধি করে কোনো কাজ হবে না। মুদ্রাস্ফীতির লাগাম টেনে মানুষের দুঃখ-কষ্ট লাঘব করতে হলে পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মতো কেন্দ্রীয় ব্যাংক অর্থাৎ বাংলাদেশ ব্যাংককে ‘সুদের হার’ নির্ধারণের পূর্ণ স্বাধীনতা প্রদানের কোনো বিকল্প নেই। সরকারের ব্যবসাবান্ধব ‘সুদ নীতি’ মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সহায়ক হবে না।

তিনি আরও বলেন, অর্থনীতিবিদদের অনেকের ধারণা বাংলাদেশ যদি বাজারভিত্তিক বিনিময় হার অনুসরণ করতো, তবে বিনিময় হারের ব্যাপক দরপতন ও ডলার সংকট আদৌ দেখা দিতো না। একইসঙ্গে নয়-ছয় সুদের হারের পরিবর্তে বাজারভিত্তিক সুদের হার নিরূপণ করা হলে সার্বিক অর্থনৈতিক সূচকেও স্থিতিশীলতা বজায় থাকতো।

ক্যাব সভাপতি বলেন, মূল্য পরিস্থিতি এক দিনে বর্তমান পর্যায়ে আসেনি, তাৎক্ষণিক ভাবে তা নিয়ন্ত্রণও সম্ভব নয়। মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে উপযুক্ত মুদ্রা ও আর্থিক ব্যবস্থাপনা অত্যাবশ্যক, তবে তা পর্যাপ্ত নাও হতে পারে। অধিকাংশ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য স্থিতিশীলতা কম। সরবরাহ সামান্য হ্রাস পেলে ব্যাপক মূল্যবৃদ্ধি পায়। ১৯৯১ সাল থেকে অনিয়ন্ত্রিত ‘মুক্তবাজার অর্থনীতি’ অনুসরণের ফলে দেশে গুটিকতক ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান প্রায় প্রতিটি নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের সরবরাহ নিয়ন্ত্রণের সক্ষমতা অর্জন করেছে। ধারণা করা হয়, বাজারে প্রতিযোগিতা না থাকায় এসব প্রতিষ্ঠান পণ্যের সরবরাহ ও মূল্য নির্ধারণ করে অস্বাভাবিক মুনাফা অর্জন করছে। কখনো ভোজ্যতেল, কখনো চিনি অথবা পেঁয়াজ, আদা, ডিম, কাঁচা মরিচ ইত্যাদি পণ্যের সরবরাহ সংকট সৃষ্টি করে ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট হাজার হাজার কোটি টাকা ভোক্তার পকেট থেকে লুটে নিচ্ছে। অনেক সময় আমদানি নিয়ন্ত্রণে অশুল্ক বাধা, যেমন, চাল আমদানিতে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন; পেঁয়াজ, কাঁচা মরিচ, ইত্যাদি কৃষি পণ্য আমদানিতে কৃষি মন্ত্রণালয়ের পারমিট, অসাধু ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটকে অতি মুনাফা অর্জনের সুযোগ করে দেয়। তাছাড়া পথে ও বাজারে চাঁদাবাজি, বৈরি আবহাওয়া ইত্যাদি অজুহাত তো আছেই।

তিনি বলেন, ভোক্তা স্বার্থ দেখার জন্য বিলম্বে হলেও ২০০৯ সালে ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ আইন এবং ২০১২ সালে বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা আইনসহ আরও কয়েকটি আইন প্রণয়ন করা হয়েছে। প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে জাতীয় ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর, বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশন, বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ ইত্যাদি। তাছাড়া আছে, বিএসটিআই, কৃষি সম্প্রাসরণ অধিদপ্তর, ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর এবং আরও নানা সংস্থা। ভোক্তা-অধিকার রক্ষায় এসব সংস্থার সক্ষমতা সীমিত এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে একেবারে অকার্যকর। বড় অপরাধীদের আইনের আওতায় আনার নজির নেই বললেই চলে।

তিনি আরও বলেন, জনজীবনে ‘মুক্তবাজার অর্থনীতি’ অনুসরণের ফলাফল মূল্যায়ন করে এর উপযোগীতা পুনঃনির্ধারণ ও সংস্কারের সময় এসেছে। বাজারে প্রতিযোগিতা থাকলে কারসাজি করে অতিরিক্ত মুনাফা অর্জন সম্ভব নয়। অতএব, গুটিকতক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের একচেটিয়া বাজার নিয়ন্ত্রণ, ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট ও কার্টেলের বিরুদ্ধে নিয়ন্ত্রণমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের পাশাপাশি সরকারকে খাদ্য বিভাগ, টিসিবির ন্যায় সরকারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে নিত্যপণ্য সরবরাহ ও বিক্রির ব্যবস্থা গ্রহণ, মূল্যবৃদ্ধির লাগাম টানায় কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে। সরকারের ব্যবসা থেকে দূরে থাকার নীতিতে জনস্বার্থ রক্ষিত হচ্ছে না। ভারত সরকার নব্বই এর দশকে ভোক্তা স্বার্থ দেখার জন্য একটি পৃথক মন্ত্রণালয় সৃষ্টি করেছে। বাংলাদেশেও ‘ভোক্তাবান্ধব, জনবান্ধব’ নীতি গ্রহণ সময়ের দাবি। ন্যায্য ও সাশ্রয়ী মূল্যে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য সরবরাহ, ভোক্তা-স্বার্থ সংক্রান্ত বিষয়াদি তদারকি, সরকারের নীতি নির্ধারণে ভোক্তা স্বার্থের প্রতিফল, ভোক্তা স্বার্থ রক্ষায় বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও সংস্থার কার্যক্রমে সমন্বয় সাধনের লক্ষ্যে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে ‘ভোক্তা সম্পর্কিত’ একটি বিভাগ সৃষ্টি সময়োপযোগী হবে বলে মনে করি। অন্যদিকে, ‘বাণিজ্য সম্পর্কিত’ অন্য একটি বিভাগ, বাণিজ্য নীতি, বৈদেশিক বাণিজ্য, বাণিজ্যিক সংস্থা ইত্যাদি বিষয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের উপর অর্পিতচিরাচরিত দায়িত্ব পালন অব্যাহত রাখতে পারে।

গোলাম রহমান বলেন, পণ্যমূল্য একবার বৃদ্ধি পেলে তা আবার পূর্বাবস্থায় ফিরে আসবে এমন সম্ভাবনা ক্ষীণ। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা অর্জনের সময় অথবা গত শতাব্দীতে পরবর্তী সময়ে মূল্য পরিস্থিতি যেমন ছিল তা আবার আশা করা অবাস্তব। সাধারণ মানুষের কর্মসংস্থান বাড়লে, আয়-রোজগার মূল্যস্ফীতির চেয়ে অধিক হারে বাড়লে, তাদের জীবনমানের উন্নতি হয়, কল্যাণ বাড়ে। মূদ্রাস্ফীতির আঁচ সহ্য করা সহজ হয়।

তিনি বলেন, স্বাধীনতার পর থেকে, বিশেষ করে বিগত দেড় দশকে, দেশের অর্থনীতির প্রভূত উন্নতি হয়েছে। বিশ্ব ব্যাংকের ক্রম অনুযায়ী বাংলাদেশ ইতোমধ্যে নিম্নআয়ের দেশের কাতার থেকে নিম্নমধ্যম আয়ের দেশের পর্যায়ে পৌঁছেছে এবং জাতিসংঘের শ্রেণি বিন্যাসে ২০২৬ সালে স্বল্প-উন্নত দেশের কাতার থেকে উন্নয়নশীল দেশের পর্যায়ে উন্নীত হওয়ার সকল মানদণ্ড পূরণ করেছে। আশা করা যায়, বাংলাদেশ ১০ বছরের মধ্যে উচ্চ-মধ্যম আয়ের দেশে এবং ২০৪১ সালে উন্নত দেশে পরিণত হবে। স্বাধীনতা অর্জনের সময় দেশের ৮০ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্য সীমার নিচে বাস করতো, এখন তা ২০ শতাংশেরও কম, তবে সংখ্যায় তিন কোটি ৫০ লাখের অধিক মানুষের আয় এখনও দারিদ্র্য সীমার নিচে।

তিনি আরও বলেন, পূর্ববর্তী যেকোনো সময়ের তুলনায় দেশে আয় বৈষম্য বেড়েছে। ২০১০ থেকে ২০২২ এর মধ্যে বৈষ্যমের পরিমাপক গিনি ইনডেক্স ০ দশমিক ৪৬ থেকে ০ দশমিক ৫৭ এ বৃদ্ধি পেয়েছে। নিম্নআয়ের ৫০ শতাংশ জনগণের ব্যক্তিগত সম্পদের ৪ দশমিক ৭৭ শতাংশের মালিকানার বিপরীতে উচ্চ আয়ের ১০ শতাংশের মালিকানা ৫৮ দশমিক ৭ শতাংশ। আয় ও সম্পদের এই তীর্যক পার্থক্যের প্রেক্ষাপটে দরিদ্র, নিম্ন ও নিম্ন-মধ্যবিত্ত শ্রেণি ও স্থির আয়ের জনসাধারণ মুদ্রাস্ফীতির প্রভাবে সর্বাধিক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে।

ক্যাব সভাপতি বলেন, ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের ধারণা সূচকে বাংলাদেশ ২০০১ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত পর পর পাঁচ বছর পৃথিবীর সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ হিসেবে চিহ্নিত হয়। পরবর্তীতে অবস্থানের পরিবর্তন হয়েছে, তবে এখনও সূচকে আশাব্যঞ্জক উন্নতি হয়নি। শূন্য থেকে ১০০ স্কেলে বাংলাদেশের সূচক বর্তমানে ৩০ নিচে অর্থাৎ বাংলাদেশ পৃথিবীর অন্যতম অতি দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ। দুর্নীতির কারণে দরিদ্র জনগোষ্ঠী উন্নয়নের সুফল থেকে বঞ্চিত হয়। ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য বাড়ে। দুর্নীতিরোধে আরও জোরাল পদক্ষেপ গ্রহণ প্রয়োজন।

তিনি বলেন, জ্বালানি, কৃষি ও শিল্প খাতে উৎপাদন ও উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি; বিশ্বের সঙ্গে বাণিজ্য সম্পর্ক সম্প্রসারণ ও বহুমুখীকরণ; শিক্ষা, স্বাস্থ্য, অবকাঠামো ইত্যাদি ক্ষেত্রে মান উন্নয়ন উন্নয়নের সোপান। সরকারের কর্মকাণ্ডে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠা এবং আর্থিকখাতে সুশৃঙ্খলা অর্জন টেকসই উন্নয়নের আবশ্যকীয় উপাদান।

তিনি আরও বলেন, ন্যায়ভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য প্রয়োজন সুশাসন। সরকারের নীতি হবে পক্ষপাতিত্বহীন। একপেশে ‘ব্যবসা-বান্ধব’ নীতি নয়, সময়ের চাহিদা সরকারের ‘ভোক্তাবান্ধব, জনবান্ধব’ নীতির অনুসরণ। সাধারণ মানুষের আয়-রোজগার বৃদ্ধি, তাদের কল্যাণ ও জীবনমানের উৎকর্ষ সাধন এবং মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে লাগসই নীতি গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করা হলেই কেবল ঊর্ধ্বমুখী মূল্য পরিস্থিতির লাগাম টেনে জনজীবনে স্বস্তি ও শান্তি আনা সম্ভব হতে পারে। বাজারের আগুনের আঁচ তাতে কিছুটা হলেও সহনীয় হবে।

-এসআর