ভোক্তাকণ্ঠ রিপোর্ট : জাতীয় ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (অতিরিক্ত সচিব) এ. এইচ. এম. সফিকুজ্জামান বলেন, নিম্নআয়ের মানুষের ক্ষেত্রে খোলা তেল বাদ দিয়ে প্যাকেটজাত তেল ব্যবহারের ক্ষেত্রে কিছুটা মুল্য বৃদ্ধি পেলেও স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি বিবেচনায় খোলা সয়াবিন তেল পরিহার করা উচিৎ। এছাড়াও খরচ কমিয়ে সাশ্রয়ী মূল্যের ছোট পেট বোতল, পাউচ প্যাক ও মিনি প্যাক প্রস্তুত করা যেতে পারে।
সোমবার বেলা ১১টার দিকে ভোক্তা অধিদপ্তরের প্রধান কার্যালয়ের সভাকক্ষে খোলা সয়াবিন তেল বিপণন ও বিক্রয় বন্ধ বিষয়ে য়োজিত সচেতনতানূলক সভায় তিনি এসব কথা বলেন।
অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বলেন, ভোজ্যতেলে ভিটামিন ‘এ’ সমৃদ্ধকরণ আইন, ২০১৩ কার্যকর হওয়ার পর থেকে ভোজ্য তেলে ভিটামিন ‘এ’ সমৃদ্ধ করার বিষয় ছিল। আমরা খোলা তেলে ভিটামিন এ পাচ্ছি না। খোলা তেলে ভিটামিন এ মিশানো হলেও প্রক্রিয়াজাত করার কারণে ভোক্তা পর্যায়ে গিয়ে প্রয়োজনীয় পরিমাণ ভিটামিন এ থাকছে না।
তিনি বলেন, খুচরা পর্যায়ে দেখা যায় সুপার পাম তেলকে সয়াবিন তেল হিসেবে বিক্রয় করছে। এ ক্ষেত্রে কোনো কোম্পানিকে শনাক্ত করা যাছে না। কারণ ড্রামে কোনো তথ্য থাকে না। এছাড়াও লিটার প্রতি ১৫-২০ টাকা বেশি বিক্রি করার প্রবণতা দেখা যায়। আমরা সকলের সমন্বয়ে সচেতনতা সৃষ্টির পাশাপাশি খোলা সয়াবিন তেল বন্ধে কাজ করতে চাই।
সভায় উপস্থিত ছিলেন অধিদপ্তরের পরিচালক মনজুর মোহাম্মদ শাহরিয়ারসহ অধিদপ্তরের প্রধান কার্যালয়ের উপপরিচালক ও সহকারী পরিচালকগণ, ডিজিএফআইয়ের প্রতিনিধি, বাংলাদেশ ট্রেড এন্ড ট্যারিফ কমিশনের প্রতিনিধি, বিএসটিআইয়ের প্রতিনিধি, এনএসআইয়ের প্রতিনিধি, ক্যাবের প্রতিনিধি, বাংলাদেশ ভেজিটেবল অয়েল রিফাইনার্স অ্যান্ড বনস্পতি ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি, সিটি গ্রুপ, এস আলম গ্রুপ, মেঘনা গ্রুপ, বসুন্ধরা গ্রুপ, টিকে গ্রুপ, রুপচাঁদাসহ বিভিন্ন ভোজ্যতেল রিফাইনারি প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি, কারওয়ান বাজার ব্যবসায়ী সমিতিসহ বিভিন্ন ব্যবসায়ী সমিতির প্রতিনিধিবৃন্দ এবং প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার সাংবাদিকবৃন্দ।
এস আলম গ্রুপের জেনারেল ম্যানেজার বলেন, আমার শিল্প মন্ত্রণালয়ের সাথে কাজ করার সুযোগ হয়েছে। খোলা ভোজ্যতেল বাজারজাতকরণ বন্ধের বিষয়ে মটিভেশনে যখন কাজ হয়নি তখন আইনে পরিণত করা হলো। আমাদের প্যাকিং করার সক্ষমতা চাহিদা অনুযায়ী নেই। তাই শতভাগ প্যাকিং এ যাওয়া কঠিন।
সভায় মেঘনা গ্রুপের প্রতিনিধি বলেন, খোলা ভোজ্যতেল বাজারজাতকরণ বন্ধের বিষয়ে আমরা একমত। কিন্তু আমাদের সক্ষমতা বিবেচনা করে তা শতভাগ বাস্তবায়নে সময় দিতে হবে।
টিকে গ্রুপের প্রতিনিধি বলেন, খোলা তেল বিক্রি বন্ধের বিষয়ে আমরা একমত। তবে পাম তেল চালু রেখে খোলা সয়াবিন তেল বন্ধ করাটা কঠিন হবে।
সভায় বাংলাদেশ এডিবল অয়েলের প্রতিনিধি বলেন, তারা কোনো খোলা তেল বাজারজাত করেন না। প্যাকিং এর ক্ষেত্রে পাউচ প্যাক প্রস্তুত করা হলে খরচ কমে যাবে।
পরে অধিদপ্তরের ঢাকা জেলা কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক আব্দুল জব্বার মন্ডল খোলা ভোজ্যতেলের ক্ষেত্রে বাজার অভিযানে প্রাপ্ত অসংগতিসমূহ যথা- অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ, ড্রামে তেলের নাম, মেয়াদ ও প্রতিষ্ঠানের নামসহ প্রয়োজনীয় তথ্য না থাকা, তেলে ভেজাল মেশানোর প্রবণতা, বেশি দামে বিক্রি ইত্যাদি বিষয়ে সভায় উপস্থিত সকলকে অবহিত করেন।
বাংলাদেশ পাইকারি ভোজ্যতেল ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি বলেন, খোলা সয়াবিন তেলের পাশাপাশি অন্যান্য খোলা নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যপণ্যের বিষয়েও পদক্ষেপ নিতে হবে। এখন হঠাৎ খোলা ভোজ্যতেল বাজারজাতকরণ বন্ধ করা হলে আমাদেরে মত ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
তার বক্তব্যের প্রেক্ষিতে মহাপরিচালক বলেন, আমরা তো আপনাদের সহযোগিতা চাচ্ছি। আমাদের একটা সময় শুরু করতে হবে। আইনের বাস্তবায়ন করতেই হবে তাই আমরা আপনাদের সহযোগিতায় সকলে মিলে তা বাস্তবায়ন করতে চাই।
আলোচনায় বিএসটিআইয়ের প্রতিনিধি বলেন, তাদের সাম্প্রতিক সার্ভে অনুযায়ী নমুনা ভোজ্য তেলে পর্যাপ্ত পরিমাণ ভিটামিন এ এর উপস্থিতি যাচাইয়ের লক্ষ্যে জুলাই ২০২২ থেকে জুন ২০২৩ পর্যন্ত ৯৭০টি নমুনা তেল (২০৪ টা ড্রামের খোলা তেল ও ৭৬৬ টি বোতলজাত তেল) নিয়ে পরীক্ষা করে দেখা যায় যে, ৮৩৭ টি নমুনা পাশ করে এবং ১৩৩ টি ফেল করে যার মধ্যে ১০৪টিই খোলা ড্রামের তেল। অর্থাৎ খোলা ড্রামের তেলের ৫২ % নমুনায় পর্যাপ্ত পরিমাণ ভিটামিন এ এর উপস্থিতি পাওয়া যায়নি।
এফবিসিসিআইয়ের পরিচালক বলেন, আমাদের এফবিসিসিআইয়ের মিটিং এ খোলা সয়াবিন তেল বন্ধের বিষয়ে বলা হয়েছে। তিনি সামগ্রিক পরিস্থিতি বিবেচনায় শতভাগ খোলা সয়াবিন তেল বন্ধের লক্ষ্যে ব্যবসায়ীদের কিছুটা সময় দেয়ার কথা বলেন।
আলোচনায় বাংলাদেশ ট্রেড এন্ড ট্যারিফ কমিশনের প্রতিনিধি বলেন, স্বাস্থ্য সুরক্ষার কথা বিবেচনা করে খোলা সয়াবিন তেল বন্ধ করা উচিৎ। তাছাড়া নিন্মআয়ের মানুষের জন্য তো পাম তেল ক্রয়ের সুযোগ থাকছে।
সভায় ক্যাব প্রতিনিধি খোলা তেলের মাধ্যমে ভোক্তারা যেন প্রতারিত না হয় সে লক্ষ্যে দ্রুত খোলা সয়াবিন তেল বন্ধের দাবি জানান।
বাংলাদেশ ভেজিটেবল অয়েল রিফাইনার্স অ্যান্ড বনস্পতি ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষে সিটি গ্রুপের প্রতিনিধি বলেন, অনেক শিক্ষণীয় একটা সভা হয়েছে। পাউচ প্যাকে তেল বাজারজাতকরণের ক্ষেত্রে পোকামাকড়ে প্যাকেট কেটে ফেলার সমস্যা ও সংরক্ষণের ক্ষেত্রে চাপে প্যাকেট ফেটে যেতে পারে।তিনি আরও বলেন, খোলা সয়াবিন তেল বন্ধের বিষয়ে কারো দ্বিমত নেই এবং এক্ষেত্রে মিল মালিক থেকে শুরু করে সকলের মধ্যে এক্ষেত্রে সমন্বয় প্রয়োজন।
অধিদপ্তরের পরিচালক মনজুর মোহাম্মদ শাহরিয়ার বলেন, জাতির পিতার সোনার বাংলা গড়ার যে প্রত্যয় আমরা দেখি, সে ক্ষেত্রে আমাদের অঙ্গীকার আছে কি না এবং কতটুকু এগিয়েছি তা নিরূপণ করা প্রয়োজন। বাংলাদেশ ভেজিটেবল অয়েল রিফাইনার্স অ্যান্ড বনস্পতি ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে খোলা সয়াবিন তেল বিক্রয় বন্ধের সময়সীমা ছয় মাস বর্ধিতকরণের আবেদন দাখিল করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে মিলগুলো ছয় মাসের মধ্যে কোন মাসে কতটুকু পর্যায়ক্রমে বাস্তবায়ন করবে তার একটি কর্মপরিকল্পনা অধিদপ্তরে দাখিল করা প্রয়োজন।
এসআর