ভোক্তাকণ্ঠ ডেস্ক: কয়েক মাস ধরে বাংলাদেশে ডিম নিয়ে তুলকালাম চলছে। ডিমসহ নানা ভোগ্যপণ্যের প্রকৃত এবং ‘কৃত্রিম’ সংকট, মজুতদারদের দাপট ইত্যাদি নিয়ে গণমাধ্যমে কথা বলেছেন জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এ. এইচ. এম. সফিকুজ্জামান।
ডিমের বাজার নিয়ে ভোক্তারা কি আপনাদের কাছে কোনো অভিযোগ করেছে? যদি করে থাকে, তাহলে সেই অভিযোগগুলোর মূল বিষয়বস্তু কী? আপনারা কিভাবে সেগুলোর জবাব দিয়েছেন?
এ. এইচ. এম. সফিকুজ্জামান: প্রথমত ডিম নিয়ে ইনডিভিজুয়ালি ভোক্তারা কোনো অভিযোগ করেনি। আমরা আসলে বাজার পরিস্থিতি দেখে কাজ করি। আমরা যে অভিযানগুলো করি- খুচরা, পাইকারি এবং কর্পোরেট গ্রুপগুলোর বিরুদ্ধেও আমরা আমাদের কার্যক্রম বা অভিযান বা মনিটরিং করেছি। এর ফলে কিন্তু ডিমের বাজারে যেটি ১৫ টাকা হয়ে গিয়েছিল, আমাদের এই কার্যক্রমের ফলে কিন্তু বারো থেকে সাড়ে বারো টাকায় নেমেছে খুচরা পর্যায়ে। প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় যখন দাম ঘোষণা করলো, উৎপাদন পর্যায়ে সাড়ে ১০ টাকা এবং ভোক্তা পর্যায়ে ১২টাকা। আমরা ঠিক ১২টাকা ভোক্তা পর্যায়ে করতে পারিনি- এর পেছনে একটা কারণ ছিল যে, উৎপাদন পর্যায়ে যে সাড়ে ১০টাকা ছিল, এটা কর্পোরেট গ্রুপগুলো মানেনি। তারা সাড়ে এগারো টাকা থেকে এগারো টাকা সত্তর পয়সা পর্যন্ত ফার্ম পর্যায়ে বিক্রি করেছে, যেটা মূলত তারাই নিয়ন্ত্রণ করে। যদিও এখানে আমাদের প্রান্তিক খামারিদের অংশটাই সবচেয়ে বড় অংশ, ৮০ শতাংশ প্রান্তিক খামারিই এই ডিম উৎপাদন করে সাপ্লাই দেয়। কিন্তু এরা আসলে কর্পোরেট খামারিদের কাছেই জিম্মি হয়ে আছে। তারা ফিড নিয়ন্ত্রণ করে। ফিডের দাম বেশি। এটা নিয়ে আমরা কাজ করছি। বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশন এটা বিশ্লেষণ করছে। পাশাপাশি প্রান্তিক খামারিদের যে সংগঠন আছে, তাদেরকে আমরা বলেছিলাম যে, তারা সরাসরি ট্রাক সেলের মাধ্যমে ঢাকায় বিক্রি করে। প্রায় ২০-২৫ দিন আগে এই উদ্যোগটা উদ্বোধন করলাম। এই উদ্যোগের ফলে তারা ট্রাকে করে সরাসরি তাদের খামার থেকে নিয়ে এসে ১২টাকার নীচে ডিম বিক্রি করছিল। গতকাল থেকে সাদা ডিম ১১ টাকা এবং লাল ডিম সাড়ে ১১ টাকা আপনার খুচরা পর্যায়ে ট্রাকে করে ঢাকার বিভিন্ন পয়েন্টে ঢুকে যাচ্ছিল। এতে করে আসলে একটা প্রভাব পড়েছে। এতে করে ডিমের দাম সরকার-নির্ধারিত দামের মধ্যেই চলে এসেছে।
এই বাজার বিশ্লেষণ আপনারা কীভাবে করেন, আপনাদের কি কোনো গবেষণা ইউনিট রয়েছে?
আমরা জনবলের চরম সংকটে ভুগছি। বিশেষ করে, কখনো কখনো সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসে আমাদের পেঁয়াজের যে দাম বেড়ে যায়, এই যে আলু নিয়ে অস্থিরতা, আবার হঠাৎ করে মুরগির দাম বেড়ে যায়, এসব বিষয়ে বাজার ব্যবস্থাপনার ত্রুটি, বিশেষ করে বিপণন ব্যবস্থার চরম ত্রুটি নিয়ে গবেষণা করা দরকার। এমনকি আমাদের এখানে ভোক্তারা প্রচুর অভিযোগ করে। অনলাইনেও অনেকে অভিযোগ করে। গত সাত মাসে ২০ হাজার অভিযোগ এসেছে। এই অভিযোগগুলো আসলে ভোক্তাদের কষ্টের বিষয়, ভোক্তারা যেখানে প্রতারিত হচ্ছেন- সেই অভিযোগ। এসব অভিযোগ বিশ্লেষণ করা দরকার। এই বিশ্লেষণের মাধ্যমে প্রিভেন্টিভ মেজার নেওয়া দরকার। আমরা আসলে খুচরা বা পাইকারি পর্যায়ে সমস্যা হয়ে যাওয়ার পরে কাজে নামছি। এতে কাঙ্ক্ষিত ফলাফল পাওয়া যাচ্ছে না। সেক্ষেত্রে আমি মনে করি, আমাদের যদি গবেষণা থাকে এই প্রতিটা বিষয় নিয়ে, তখন আমরা মূল কারণ নিয়ে যদি প্রিভেন্টিভ মেজার নিতে পারি, তাহলে আমাদের দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ থেকে শুরু করে ভোক্তার অভিযোগের বিষয়গুলো আমরা আরও ভালোভাবে অ্যাড্রেস করতে পারবো বলে আমার বিশ্বাস।
ডিমের বাজার বর্তমান জায়গায় আসার পেছনে আপনারা কী কী কারণ খুঁজে পেয়েছেন? অনেকে কলকাতার সাথে বাংলাদেশের বাজারের তুলনা করে থাকে। আপনাদের বিশ্লেষণে কি এ রকম কিছু এসেছে? বাংলাদেশে ডিমের আদর্শ মূল্য কত হতে পারতো?
যখন বাজারে অস্থিরতা সৃষ্টি হয়, তখন আমরা খুচরা-পাইকারি আড়ত থেকে শুরু করে কর্পোরেট গ্রুপগুলোর ওখানেও বিভিন্ন সময় অভিযান করি। তারা একে অপরকে দোষ দেয়। এখানে কিন্তু প্রতিটা পক্ষই সুযোগটা নিচ্ছে। কিন্তু কেউ নিজের দোষ স্বীকার করে না। ফিডের দাম ১০ থেকে ১২ টাকা অতিরিক্ত বলা হচ্ছে, কিন্তু এটাও কর্পোরেট গ্রুপদের হাতে। আপনারা দেখবেন যে, তারা মিডিয়াতে বিভিন্নভাবে প্রচার করে যে, এখানে তাদের পোল্ট্রি ফিডের কাঁচামাল যেটা আছে সেটা ইম্পোর্টেড। তারা বলছে যে, ইম্পোর্টের ডিউটি আছে। আসলে পোল্ট্রি ফিডের কাঁচামাল যেটা ইম্পোর্ট হয় সেটা কিন্তু জিরো ডিউটি। ভুট্টার ৫০ শতাংশ দেশে উৎপাদিত হয়। সয়াবিন আমাদের বড় বড় রিফাইনারিগুলো থেকে আসে। এগুলোর কোনোটাই কিন্তু আমাদের ইম্পোর্ট করতে হয় না। এবং ইম্পোর্টের ক্ষেত্রেও কিন্তু ডিউটি নেই। এখন তারা এই কথাগুলো বলে ১০ থেকে ১২ টাকা অতিরিক্ত মূল্য ফিডে নিচ্ছে। ২৮% ডিউটি দিয়ে ভারতের ডিম ঢুকেছে ৭ টাকা ১০ পয়সায়। ভারত যদি ৬ টাকায় ডিম উৎপাদন করে, আমাদের দেশে কেন এটি সাড়ে ১০টাকা হবে? আর আমরা যদি ফিডের দাম প্রকৃত দামে নিয়ে আসতে পারি, তাহলে স্বাভাবিকভাবেই ডিমের উৎপাদন খরচ ২ থেকে ৩ টাকা কমে আসবে।
উৎপাদন খরচ ঠিক করা গেলে আমরা কত টাকায় ডিম খেতে পারতাম?
যেটা ধারণা, উৎপাদন খরচ সাড়ে ১০ টাকা বলে সেটি আসলে ৮ থেকে সাড়ে ৮ টাকার মধ্যে চলে আসার কথা। তাহলে আমাদের বাংলাদেশের ডিমের উৎপাদন হয় তা দশ টাকার নীচেই বাজারে আসার কথা।
আমাদের আরো নানা পণ্যের ক্ষেত্রে সরকার যখন আর কোনো ভাবে অভ্যন্তরীণ বাজার সামাল দিতে পারে না, তখন আমদানি করে। এখানেও অনেকের অভিযোগ রয়েছে। বিশেষ করে মুরগীর ক্ষেত্রে যেটা হয়েছিল, দেশি ছোট খামারিরা বিপর্যয়ে পড়েছিল, কেউ কেউ ব্যবসা ছেড়ে দিয়েছিল।
আমার একটাই কথা যে, বৈশ্বিক ব্যবসার এখন যেই প্যাটার্ন, সেখানে আমার যেখানে সক্ষমতা নেই, আমার যেখানে ১৭ কোটি সাধারণ মানুষ অতিরিক্ত মূল্যে কিনছে, সেখানে আমদানি করে যদি এটা নিয়ন্ত্রণ করা যায়, সেখানে আমাদের এই জিনিসগুলো অবশ্যই ভাবতে হবে। কখন পেঁয়াজ আমদানি করতে হবে, সেটা আমরা বিবেচনা করি। কৃষকদের হাতে যখন পিঁয়াজ থাকে, তখন আমরা কিন্তু আমদানি নিষিদ্ধ করে রাখি।
ডিমের ডোমেস্টিক ইন্ডাস্ট্রি বিকশিত হয়েছে, আমদানি বন্ধ দেখেই এইটা হয়েছে। কিন্তু এর অর্থ এই নয় যে, আমাদের ১৫ টাকায় ডিম খেতে হবে। যারা এখানে ম্যানুপুলেট করছে, তাদের সাথে আমরা বসেছি। কিন্তু তারা আমাদের কথা শুনছে না। তখন আমরা ইম্পোর্ট করেছি সাধারণ মানুষের কথা চিন্তা করে।
আমি মনে করি যে, উৎপাদন এবং বিপণন পর্যায়ে যেই চক্রগুলো আছে, সেই জায়গাগুলোতে আমাদের অনেক অনেক কাজ করার আছে এবং তাদেরও অংশগ্রহণ করতে হবে। যতক্ষণ এটা না হবে ততক্ষণ এরকম অস্থিরতা তৈরি হবে এবং তখনই বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে আমদানির সিদ্ধান্ত আসতে পারে।
অভিযোগটা এ রকম- বড় ব্যবসায়ীরা দাম বাড়ায়, সরকার আদমানি করে, ছোট ব্যবসায়ীরা ধ্বংস হয়ে যায়, এরপর বড় ব্যবসায়ীরা আবার চুটিয়ে ব্যবসা করে।আমদানির কেইসটা এ রকম হয়ে যায় কি-না?
এই মুহূর্তে আমদানির সিদ্ধান্ত না নিলে ডিম-আলুর বাজারে কিন্তু স্বস্তি আসতো না। ১৭ কোটি মানুষকে নিয়ে আমাদের চিন্তা করতে হয়। সেখানে প্রতিটা মানুষ যেভাবে কষ্টে আছে, এখন এই খামারিরা যেমন অনেক ক্ষেত্রে তাদের যুক্তি দেখায়, বিশেষ করে বড় বড় কর্পোরেটগুলো যে, তারা একসময় লস করেছে, তাই এখন লাভের জন্য এবং তারা মিডিয়ার সামনে গিয়ে দাম্ভিকতার সাথে বলে। ব্যবসায়ে লাভ-লস থাকবে। কর্পোরেট কোম্পানিগুলো এই দেশের মানুষের উপরই তো ব্যবসাগুলো করছে। তারা কি তাদের ব্যবসা গুটিয়ে নিয়ে যাচ্ছে? আপনি দেখেন, তাদের ব্যবসা কিন্তু এক্সপান্ড হচ্ছে। কিন্তু মানুষকে জিম্মি করে তো এইভাবে ব্যবসা করতে হয় না। এখানে এথিকাল স্ট্যান্ডার্ড যেটা আছে সেটা একদম নিম্ন পর্যায়ে নেমে গেছে। সেখানে আমি মনে করি যে, এফবিসিসিআইসহ যেই অ্যাসোসিয়েশনগুলো আছে- সেখানে তারা ইতিবাচকভাবে আমাদের সাথে কাজ করছে। কিন্তু রুট পর্যায়ে যেই ব্যবসায়ীরা আছে, তারা প্রতিটা পর্যায়ে যে যেরকম পারছে মানুষকে জিম্মি করে অতিমুনাফার জন্য যেই চিন্তাভাবনা তা বাস্তবায়ন করছে। এখানে পুরোপুরি একটি অসাধু চক্রের হাতে জিম্মি হয়ে আছে আমাদের ১৭ কোটি মানুষ।
অনেকে এটাও বলে যে, দীর্ঘমেয়াদী স্বার্থে আমদানি না করে বাজারের অন্য বিভিন্ন ব্যবস্থাপনা ঠিক করতে হয়, যাতে বড় ব্যবসায়ীরা বাজারকে জিম্মিও করতে পারবে না, আবার আমদানিও করা লাগবে না…
আমাদের যেই রেগুলেটরি অথরিটিগুলো আছে, সেখানে আমার মনে হয় যে, হার্ড লাইনে যেতে হবে। অনেকেই একটা অভিযোগ ভোক্তা অধিকার অধিদপ্তর নিয়ে সবসময় করে যে, আমরা বড় বড় জায়গাগুলোতে যাচ্ছি না। আমরা কিন্তু বড় বড় জায়গাগুলোতে যাচ্ছি। প্রতিটা বিষয় আমরা সরকারের কাছে তুলে ধরেছি, কোথায় প্রবলেম। কম্পিটিশন কমিশন হয়েছে, তারা কিন্তু আমাদের রিপোর্টের প্রেক্ষিতে ৭৬টা মামলা করেছে, তার মধ্যে ২টা মামলার রায় হয়েছে, সাড়ে আট কোটি টাকা জরিমানা করেছে। বিশেষ করে ব্রয়লার মুরগি নিয়ে যে কাহিনিটা হয়েছিল গতবছর, সেটাসহ আরও প্রায় ২০টা মামলার রায় আসছে। এখানে যে, কাজ হচ্ছে না তা না, কিন্তু কথাটা হলো যে, ব্যবসায়ীদের যে মানবিক বিষয়টা এত বেশি অনুপস্থিত হয়ে গেছে, এথিকাল স্ট্যান্ডার্ডটা এত নিম্ন পর্যায়ে গেছে, এই জায়গাটা আমাদের আরও বেশি কাজ করা দরকার। ব্যবসায়ী কমিটির অংশগ্রহণ ছাড়া আমাদের সরকারের পক্ষে এই ব্যাপক বিষয়গুলো নিয়ে, পেঁয়াজের ব্যবসা করে লক্ষ লক্ষ লোক, আলুর ব্যবসা করে লক্ষ লক্ষ লোক, প্রতিটা জায়গায়ই মনিটর করে নিয়ন্ত্রণ করা আসলেই খুব কঠিন কাজ৷
বাজারের এথিকাল স্ট্যান্ডার্ড ঠিক করতে কোনো প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো তৈরির প্রয়োজন আছে?
আমাদের যে প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোগুলো আছে, সেগুলো বিভিন্ন প্রশংসনীয় কাজ করছে। তবে একটা জিনিস, যেটা মনে করি, সেটা হলো, সমবায়ভিত্তিক বাজার ব্যবস্থাপনা আনা দরকার, এটি বঙ্গবন্ধু স্বপ্ন দেখেছিলেন। প্রান্তিক গোষ্ঠীর কথা বলেন অথবা আমাদের যেই কৃষকরা সবজি উৎপাদন করেন, সমবায়ভিত্তিক বিপণন ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারিনি। এখানে সমবায়ে যারা আছেন, তাদের আসলে সংগঠিতভাবে কাজ করতে হবে। কৃষি বিপণন অধিদপ্তরকে এখানে বিপণন ব্যবস্থায় আরও বেশি মনোযোগ দিতে হবে৷ এবং আমরা যদি উৎপাদন এবং ভোক্তা পর্যায়ের বাধাগুলো যেমন হাত বদল বা যারা অতিমুনাফা করছেন- জিনিসগুলো কমিয়ে আনতে পারি তখনি কিন্তু কৃষকরা ন্যায্য মূল্য পাবেন এবং ভোক্তারাও সাশ্রয় মূল্যে পণ্য পাবেন বলে আমার বিশ্বাস৷’’
সৌজন্যে, ডয়চে ভেলে।