হোয়াইট গোল্ড বা সাদা সোনা খ্যাত ভেনামি চিংড়ি চাষ প্রথমবারের মত খুলনার পাইকগাছায় পরীক্ষামূলক চাষ শুরু হয়েছে। বেশ কয়েক বছর ধরেই ব্যবসায়ী ও রফতানিকারকরা বেশি লাভজনক ভেনামি জাতের চিংড়ি চাষ করার দাবি করেছিল।
এ প্রেক্ষিতে বাংলা নিউজ টুয়েন্টি ফোর থেকে জানা যায়, ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে বেসরকারি সংস্থা সুশীলন এবং এমইউসি ফুডসকে ভেনামির পরীক্ষামূলক চাষের অনুমতি দেয় সরকার। তবে নানা সংকটে দীর্ঘদিন ধরে তারা চাষাবাদ শুরু করতে পারছিল না।
বৃহস্পতিবার (০১ এপ্রিল) থেকে সেই অনিশ্চয়তা দূর হয়ে গেছে। বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো ভেনামি জাতের চিংড়ির পরীক্ষামূলক চাষ শুরু হয়েছে।
পরীক্ষামূলকভাবে চাষের জন্য থাইল্যান্ড থেকে ১ মিলিয়ন ভেনামি চিংড়ি আমদানি করে খুলনার পাইকগাছা উপজেলায় নেওয়া হয়েছে। সেখান থেকে চিংড়ি পোনা পরীক্ষার জন্য বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট ও বাগেরহাট চিংড়ি গবেষণা কেন্দ্রের পরীক্ষাগারে নেওয়া হয়েছে। পরীক্ষার পর পাইকগাছার লবন পানি গবেষণা কেন্দ্রের পুকুরে ছাড়া হবে।
পাইকগাছা উপজেলার সিনিয়র মৎস কর্মকর্তা পবিত্র কুমার বলেন, ‘সরকার পরীক্ষামূলকভাবে ভেনামি চাষের জন্য বেসরকারি সংস্থাকে অনুমতি দিয়েছে। আমরা এই কাজে তাদের সহায়তা করছি। পরিবেশে যাতে কোনো ক্ষতি না হয় সে জন্য পাইকগাছা লবন পানি গবেষণা কেন্দ্রে প্রাথমিকভাবে চাষ করা হচ্ছে। প্রথমে একটি পুকুরে এবং পরে চারটি পুকুরে পরীক্ষামূলকভাবে ভেনামি চিংড়ির চাষ করা হবে। ’
চিংড়ি ব্যবসায়ীরা জানান, গলদা ও বাগদা চিংড়ির চাষ বছরে একবারের বেশি করা যায় না। আর ভেনামি চাষ করা যায় বছরে তিনবার। সাধারণ পুকুরে প্রতি হেক্টরে ৩০০-৪০০ কেজি বাগদা চিংড়ি উৎপাদন করা যায়। অন্যদিকে একই পরিমাণ জমিতে সাত-আট হাজার কেজি ভেনামি চিংড়ি উৎপাদন সম্ভব। ভারতে ভেনামি চিংড়ির পরীক্ষামূলক চাষ থেকে বাণিজ্যিক উৎপাদনে যেতে পাঁচ বছর সময় লেগেছিল। বাংলাদেশে তিন বছরের মধ্যে সম্ভব। তবে পরিবেশের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে—এমন যুক্তিতে দীর্ঘদিন ভেনামি চাষে উৎসাহ বা অনুমতি কোনোটাই দেয়নি মৎস্য অধিদপ্তর।
এ প্রসঙ্গে সুশীলনের প্রধান নির্বাহী মোস্তফা নুরুজ্জামান বলেন, ‘ভেনামির পরীক্ষামূলক চাষের জন্য আমরা ছয়টি পুকুর প্রস্তুত করেছিলাম। তবে গত মৌসুমে প্রচুর বৃষ্টিপাতের কারণে পুকুরে পানিতে প্রয়োজনীয় লবণাক্ততা ছিল না। সে কারণে পোনা আমদানির প্রক্রিয়া থেকে পিছিয়ে যাই আমরা। যা হোক, এবার থাইল্যান্ড থেকে ভেনামি চিংড়ির পোনা আনা হয়েছে। আমরা চাষাবাদের প্রক্রিয়া শুরু করেছি। ’
তিনি বলেন, ‘চিংড়িতে রফতানি আয় বাড়াতে ভেমানি চাষের বিকল্প নেই। আমি মনে করি এটি পরিবেশের উপর কোনো প্রভাব ফেলবে না। ’
বাংলাদেশ ফ্রোজেন ফুড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সূত্রে জানা গেছে, দেশে প্রায় পৌনে তিন লাখ হেক্টর জমিতে চিংড়ি চাষ হয়। তবে দিন দিন রপ্তানির পাশাপাশি চিংড়ির উৎপাদনও কমেছে। যেমন গত ২০১৩-১৪ অর্থবছরে ৩৪ হাজার ৭৩৩ মেট্রিক টন বাগদা ও ৬ হাজার ৫০৩ মেট্রিক টন গলদা চিংড়ি উৎপাদিত হয়। গত ২০১৮-১৯ অর্থবছরে বাগদা চিংড়ি উৎপাদন কমে ২৪ হাজার ৩৯৬ মেট্রিক টনে নেমেছে। আর গলদা চিংড়ি উৎপাদন কমে হয়েছে ৫ হাজার ১৪৬ মেট্রিক টন।
অন্যদিকে ২০১৩-১৪ অর্থবছরে ৫৫ কোটি ডলারের হিমায়িত চিংড়ি রপ্তানি হয়, যা পরের অর্থবছরে কমে ৫১ কোটি ডলারে নামে। এরপরের চার অর্থবছরও ধারাবাহিকভাবে চিংড়ি রপ্তানি কমেছে। সর্বশেষ ২০১৮-১৯ অর্থবছরে হিমায়িত চিংড়ি রপ্তানি হয়েছে মাত্র ৩৩ কোটি ডলারের।
বাংলাদেশ ফ্রোজেন ফুড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএফএফইএ) সভাপতি কাজী বেলায়েত হোসেন বলেন, ‘চিংড়ির বিশ্ববাণিজ্যে ৭৭ শতাংশ দখল করে আছে ভেনামি। অনেক দেশ এটা চাষ করে হাজার হাজার কোটি টাকা আয় করছে। এ অঞ্চলে ভেনামি চাষের সফলতা পেলে দেশের অর্থনীতি উন্নয়নে চিংড়ি বেশ ভূমিকা রাখবে। ’
জানা গেছে, ভেনামি চিংড়ি প্রথম ১৯৭০ সালে যুক্তরাষ্ট্রে পরিচিতি পায়। ১৯৮০ সালের দিকে এই প্রজাতির বাণিজ্যিক চাষ শুরু হয়। এরপর থেকে চীন, থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া এবং ভারতের মতো এশিয়ার অনেক দেশে ব্যাপকভিত্তিক চাষ শুরু হয়।
মৎস্যখাত উন্নত করার লক্ষ্যে বাংলাদেশে বিনিয়োগ করে যুক্তরাজ্যের শীর্ষ খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ কোম্পানি ‘সিমার্ক’। ২০০০ সালের নভেম্বরে চট্টগ্রামে সামুদ্রিক খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানা স্থাপন করে তারা এবং ব্রিটিশ রাজকুমারি অ্যান সেটির উদ্বোধন করেন।
একসময় বাংলাদেশে সামুদ্রিক খাদ্য উৎপাদন এবং রপ্তানিতে শীর্ষ প্রতিষ্ঠান হয়ে ওঠে সিমার্ক। ব্ল্যাক টাইগার এবং স্বাদু পানির চিংড়ি রপ্তানিতে সাফল্যের কারণে তারা বিভিন্ন পুরস্কারও জেতে। বাজারে ভেনামি নামে নতুন প্রজাতির সাদা চিংড়ি আসায়, গত ১০ বছর ধরে ব্ল্যাক টাইগারের চাহিদা কমতে শুরু করে।
২০১২ সালে ব্ল্যাক টাইগার এবং স্বাদু পানির চিংড়ি রপ্তানি করে বাংলাদেশের মোট আয় হয়েছিল ৫৯০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। অন্যদিকে ২০১৯ সালে মোট আয় হয় ৩৬৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। এ সময়ের মধ্যে ৮৫ শতাংশ চিংড়ি কারখানা উচ্চ ঋণে জর্জরিত হয়ে বন্ধ হয়ে গেছে বা উৎপাদন থেমে গেছে।
এদিকে গত ১৫ বছর ধরে ভেনামিই চাষ করছে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত, ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়া ও চীন। এসব চিংড়ি যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ, রাশিয়া, আফ্রিকা, জাপান, অস্ট্রেলিয়া এবং মধ্য প্রাচ্যের কয়েকটি দেশে রপ্তানি করছে তারা। বিশ্বজুড়ে ভেনামি চিংড়ির বাৎসরিক বাজার মূল্য ৭০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।
আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে এবং যথাযথ নেতৃত্বের অভাবে বাংলাদেশে ভেনামির চাষ শুরু করতে অনেকটা দেরি হলো।
সূত্রঃ বাংলা নিউজ টুয়েন্টি ফোর