ভোক্তাকণ্ঠ ডেস্ক: দেশে ‘এনার্জি ড্রিংকস’ অনুমোদন দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ ধরনের পানীয়তে উদ্দীপক কিছু উপাদান থাকে, যা নেশাজাতীয়। ফলে এতে করে একদিকে মাদকাসক্তির প্রবণতা বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে; অন্যদিকে রয়েছে স্বাস্থ্যঝুঁকি।
বর্তমানে দেশে পেপসি, কোকাকোলা, আরসি ইত্যাদি কার্বোনেটেড বেভারেজ বা কোল্ড ড্রিংকসের অনুমোদন রয়েছে। এসব পানীয়ের মান নির্ধারণ করে দিয়েছে বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশন (বিএসটিআই)। তবে বিএসটিআই এখনো এনার্জি ড্রিংকসের মান নির্ধারণ করেনি। ফলে দেশে এনার্জি ড্রিংকস বৈধ নয়।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, কোল্ড ড্রিংকস ও এনার্জি ড্রিংকসের মধ্যে উপাদানগত কিছু পার্থক্য রয়েছে। এনার্জি ড্রিংকসে টওরিন, ইনোসিটল ও গ্লুকোরোনোল্যাকটোন নামক উদ্দীপক উপাদান থাকে, যা কোল্ড ড্রিংকসে থাকে না। এগুলো নেশাজাতীয়। এ ছাড়া এনার্জি ড্রিংকসে ক্যাফেইন থাকবে প্রতি লিটারে ৩০০ মিলিগ্রাম পর্যন্ত। বিদ্যমান আইনে কোনো পানীয়ের প্রতি লিটারে ১৪৫ মিলিগ্রামের বেশি ক্যাফেইন থাকতে পারবে না।
জানা গেছে, বিএসটিআইয়ের কারিগরি কমিটি এনার্জি ড্রিংকসের মান তৈরির জন্য একটি খসড়াপত্র তৈরি করেছে। সে অনুযায়ী, প্রতি লিটার এনার্জি ড্রিংকসে টওরিন ২ হাজার মিলিগ্রাম, গ্লুকোরোনোল্যাকটোন ১ হাজার ২০০ মিলিগ্রাম, ক্যাফেইন ৩০০ মিলিগ্রাম ও ইনোসিটল ১০০ মিলিগ্রাম থাকবে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ক্যাফেইন, টওরিন, ইনোসিটল ও গ্লুকোরোনোল্যাকটোন- এসবই নেশাজাতীয় উপাদান। এগুলো উচ্চ রক্তচাপ, হৃদ্রোগজনিত সমস্যা ও মস্তিষ্কবিকৃতির মতো স্বাস্থ্যঝুঁকি সৃষ্টি করে।
এনার্জি ড্রিংকসে স্কুলশিশুদের ঝুঁকি
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফুড টেকনোলজি ও গ্রামীণ শিল্প বিভাগের অধ্যাপক মো. আবদুল আলীম বলেন, ১ লিটার কোল্ড ড্রিংকসে এখন সর্বোচ্চ ১৪৫ মিলিগ্রাম ক্যাফেইন ব্যবহার হয়। সেখানে ১ লিটার এনার্জি ড্রিংকসে ক্যাফেইনসহ এ চারটি উপাদানের পরিমাণ দাঁড়াবে ৩ হাজার ৬০০ মিলিগ্রামে।
আবদুল আলীমের মতে, এনার্জি ড্রিংকস অনুমোদন দিলে নেশাজাতীয় দ্রব্যের একটা ককটেল খাওয়ানো হবে। তিনি বলেন, এনার্জি ড্রিংকসের অনুমোদন পেলে খুবই খারাপ প্রভাব পড়বে। যখন কেউ অল্প বয়সে এনার্জি ড্রিংকস গ্রহণ করবে, বয়স বাড়লে তখন তার এটায় চলবে না, তখন নেশার জন্য তার অন্য মাদকের দরকার হবে।
আলোচনার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত হবে
এনার্জি ড্রিংকসের মান প্রণয়নের জন্য যেসব প্রতিষ্ঠান সুপারিশ করেছে, তাদের অন্যতম বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ। তবে তারা মনে করে, এর একটা মান থাকা উচিত।
এনার্জি ড্রিংকসে কোনো স্বাস্থ্যঝুঁকি আছে কি না- এমন প্রশ্নে চেয়ারম্যানের পক্ষে নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের পরিচালক (খাদ্য পরীক্ষাগার নেটওয়ার্ক সমন্বয়) সহদেব চন্দ্র সাহা বলেন, ‘এটাকে (এনার্জি ড্রিংকস) অনিরাপদ বলে আমরা মনে করি না। এনার্জি ড্রিংকসের আন্তর্জাতিক মান আছে। আমরা সেই অনুযায়ী সুপারিশ করেছি। মান তৈরি করবে কি না, সেটা বিএসটিআইয়ের ব্যাপার।’
বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে বিএসটিআই মহাপরিচালকের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। মহাপরিচালকের পক্ষে বিএসটিআইয়ের পরিচালক মো. নূরুল আমিন বলেন, এটার (এনার্জি ড্রিংকসের মান প্রণয়ন) বিষয়ে এখনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি।
গত বছরের ২০ ডিসেম্বর এনার্জি ড্রিংকস পণ্যের মান ঠিক করার লক্ষ্যে শিল্প মন্ত্রণালয়ে একটি সভা হয়। ওই সভার প্রসঙ্গ টেনে নূরুল আমিন বলেন, ‘সেখানেও কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। এটা আরও যাচাই-বাছাই হবে। এটা পেন্ডিং (ঝুলন্ত) অবস্থায় আছে।’
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ওই সভায় যেসব সিদ্ধান্ত হয়েছে, আন্তর্জাতিক অঙ্গণের সঙ্গে দেশের বাণিজ্য সম্প্রসারণ, দেশের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপট ও জনসাধারণের স্বাস্থ্যঝুঁকি বিবেচনায় এনার্জি ড্রিংকস পণ্যের মান প্রণয়নের বিষয়টি বিবেচনা করা হবে। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞ ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আরও আলোচনা করে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
এনার্জি ড্রিংকসের মান নির্ধারণ নিয়ে করা খসড়া স্থগিত আছে বলে জানান বিএসটিআইয়ের মান শাখার উপপরিচালক (কৃষি ও খাদ্য) এনামুল হক। তিনি বলেন, মান তৈরির জন্য খসড়া তৈরির নির্দেশ ছিল। তারপরে আপত্তি আসে। এখন খসড়া আপাতত স্থগিত আছে।
এনামুল হক বলেন, বিএসটিআইয়ের মান অনুযায়ী কার্বোনেটেড বেভারেজে প্রতি লিটারে সর্বোচ্চ ১৪৫ মিলিগ্রাম ক্যাফেইন ব্যবহার করা যায়।
‘দেশীয় বেভারেজ শিল্পের ক্ষতি হবে’
২০১৮ সালের অক্টোবরে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) এনার্জি ড্রিংকসের মান নির্ধারণের জন্য বিএসটিআইকে অনুরোধ জানায়। এ নিয়ে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ ও শিল্প মন্ত্রণালয় একাধিক সভা করেছে। নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষও এনার্জি ড্রিংকসের মান প্রণয়নের সুপারিশ করেছে। গত বছরের এপ্রিলে এনার্জি ড্রিংকসের মান প্রণয়নের অনুরোধ জানিয়ে বিএসটিআইকে চিঠি দেয় ভারতের অস্ট্রিয়া দূতাবাস। সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানায়, অস্ট্রিয়ার একটি কোম্পানি বাংলাদেশে এনার্জি ড্রিংকস রপ্তানি করতে চায়।
বিজনেস ইনিশিয়েটিভ লিডিং ডেভেলপমেন্ট (বিল্ড) নামের একটি প্রতিষ্ঠানও গত বছরের মে মাসে শিল্প মন্ত্রণালয়কে এনার্জি ড্রিংকসের মান নির্ধারণের অনুরোধ জানিয়ে চিঠি দেয়। এরপর বিএসটিআইকে এ বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে বলে শিল্প মন্ত্রণালয়।
জানতে চাইলে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মুস্তাকীম বিল্লাহ ফারুকী বলেন, ‘আমাদের সংজ্ঞা অনুযায়ী মাদকের যে উপাদানের কথা বলা হয়েছে, তা থাকলে সেটা মাদক হিসেবে বিবেচিত হবে। মাদকের আইটেম অনুমতি দেবে কি না, সেটা পরের বিষয়।’
দেশে এনার্জি ড্রিংকসের মান নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা নেই
গত বছরের অক্টোবরে বাংলাদেশ বেভারেজ ম্যানুফ্যাকচারার্স এসোসিয়েশন (বিবিএমএ) এনার্জি ড্রিংকসের মান প্রণয়ন না করার অনুরোধ জানিয়েছে। এরপরের মাসে শিল্প মন্ত্রণালয়কেও চিঠি দিয়েছে সংগঠনটি। ওই চিঠিতে বলা হয়েছে, ২০১৮ সালে ১৭ অক্টোবর নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ গণবিজ্ঞপ্তি দিয়ে এনার্জি ড্রিংকসের আমদানি ও বিক্রি নিষিদ্ধ করেছে। এমন প্রেক্ষাপটে এনার্জি ড্রিংকসের মান প্রণয়নের জন্য খসড়া তৈরি করায় বিষয়টিকে ‘অসাধু চক্রের পাঁয়তারা’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে চিঠিতে।
বিবিএমএর সাধারণ সম্পাদক ও আকিজ ফুড অ্যান্ড বেভারেজ লিমিটেডের চেয়ারম্যান শেখ শামীম উদ্দিন বলেন, এনার্জি ড্রিংকসের অনুমোদন দেওয়া হলে দেশীয় বেভারেজ শিল্প ক্ষতির সম্মুখীন হতে পারে। ১৫ হাজার কোটি টাকার এই শিল্পের সঙ্গে ৫ লাখ মানুষ জড়িত।
এনার্জি ড্রিংকস অনেক দেশে নিষিদ্ধ উল্লেখ করে শেখ শামীম উদ্দিন বলেন, স্বাস্থ্যঝুঁকি বিবেচনায় আগের টেকনিক্যাল কমিটি ক্যাফেইনের মাত্রা দুই ধাপে কমিয়ে প্রতি লিটারে ১৪৫ মিলিগ্রাম নির্ধারিত করে এবং সব উদ্দীপক উপাদান বাদ দেয়। কিন্তু বর্তমান খসড়ায় ক্যাফেইনের মাত্রা ৩০০ রাখা হয়েছে। আরও কিছু উদ্দীপক উপাদানও রাখা হয়েছে। তিনি এনার্জি ড্রিংসের অনুমোদন না দেওয়ার দাবি জানান। প্রথম আলো।