ভোক্তাকণ্ঠ ডেস্ক: দেশের বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত বিপুল পরিমাণ দেনা নিয়ে বিপাকে পড়েছে। একদিকে তারা টাকার অভাবে বেসরকারি কেন্দ্রগুলোকে বিদ্যুতের দাম যথাসময়ে দিতে পারছে না; অন্যদিকে মার্কিন ডলারের অভাবে বকেয়া রাখতে হচ্ছে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের বিদেশি কোম্পানিগুলোর পাওনা।
সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো থেকে পাওয়া সর্বশেষ হিসাবে, দেশে উৎপাদনরত বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) কাছে পাওনা প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকা। পিডিবি বাংলাদেশ তেল, গ্যাস, খনিজ সম্পদ কর্পোরেশনের (পেট্রোবাংলা) কাছে গ্যাস বিল বকেয়া রেখেছে প্রায় ৮ হাজার কোটি টাকা।
ভারতের আদানির কাছে বিদ্যুতের দাম বকেয়া পড়েছে ৫০ কোটি ডলারের মতো (প্রায় সাড়ে ৫ হাজার কোটি টাকা)। জ্বালানি তেল আমদানিকারক সরকারি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশনের (বিপিসি) কাছে বিদেশি সরবরাহকারীরা পাবে প্রায় ২৭ কোটি ডলার (প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকা)। আর বাংলাদেশে গ্যাস উত্তোলনকারী মার্কিন কোম্পানি শেভরন গ্যাসের দাম বাবদ পাবে ২০ কোটি ডলার (প্রায় ২ হাজার ২০০ কোটি টাকা)।
এর বাইরে আরও কিছু খাতে বকেয়া রয়েছে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বকেয়া বাড়তে থাকলে জ্বালানি সরবরাহকারীদের আস্থা কমতে থাকে। তারা দীর্ঘমেয়াদি সরবরাহ চুক্তি করতে আগ্রহী হয় না। জ্বালানি সরবরাহে তারা গড়িমসিও করে। বকেয়া দিতে দেরি হলে চুক্তি অনুযায়ী জরিমানাও দিতে হয়। ব্যাংকগুলো নতুন আমদানির ঋণপত্র খোলার ফি বাড়িয়ে দেয়।
এদিকে, আগামী মার্চে গরমের মৌসুম শুরু হচ্ছে। তখন বিদ্যুৎকেন্দ্র চালাতে বাড়তি জ্বালানির প্রয়োজন হবে, আমদানি বাড়াতে হবে গ্যাস, কয়লা ও জ্বালানি তেল। টাকার অভাব ও ডলার–সংকটের মধ্যে বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য পর্যাপ্ত জ্বালানি আমদানি করা যাবে কি না, তা নিয়ে সংশয় তৈরি হয়েছে। জ্বালানির অভাবেই গত বছর গরমে বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রয়োজন অনুযায়ী চালানো সম্ভব হয়নি। এতে ঢাকায় দিনে ২ থেকে ৩ ঘণ্টা এবং গ্রামে ৮ থেকে ১০ ঘণ্টাও লোডশেডিং করতে হয়েছিল।
বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ গতকাল শনিবার রাতে বলেন, কিছু সমস্যা আছে, তা সমাধান করার চেষ্টা করা হচ্ছে। কিছু কিছু করে ডলার পাওয়া যাচ্ছে, যা দিয়ে বকেয়া শোধ করা হচ্ছে। বাকিটা অর্থ বিভাগের সঙ্গে আলোচনা করে সমাধান করা হবে। তিনি বলেন, সরকার বন্ড দিয়ে বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রের বকেয়া কিছুটা পরিশোধের ব্যবস্থা করেছে। বিদেশি পাওনা পরিশোধে তো ডলার লাগবে।
কেন বকেয়া?
সরকার বিদ্যুৎ বিক্রি করে উৎপাদন খরচের চেয়ে কম দামে। বাকি টাকা ভর্তুকি দেয় অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ। তবে যথেষ্ট রাজস্ব আদায় হচ্ছে না বলে অর্থ বিভাগ বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকির টাকা যথাসময়ে দিতে পারছে না।
বিশেষজ্ঞদের মতে, বিদ্যুৎকেন্দ্র বসিয়ে রেখে কেন্দ্র ভাড়া (ক্যাপাসিটি চার্জ) দিতে হয় বলে ভর্তুকির পরিমাণ অনেক বেড়ে গেছে, যা নিয়ে নাখোশ অর্থ বিভাগ। ২০২২-২৩ অর্থবছরে সরকারি ও বেসরকারি খাতে কেন্দ্র ভাড়ার পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২৬ হাজার কোটি টাকার বেশি।
অন্যদিকে, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে বিদেশি কোম্পানির দেনা পরিশোধে ব্যাংক প্রয়োজন অনুযায়ী মার্কিন ডলার দিতে পারছে না। বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে ২০২১ সালে বৈদেশিক মুদ্রার মজুত বা রিজার্ভ ছিল ৪৮ বিলিয়ন (১০০ কোটিতে ১ বিলিয়ন) ডলারের বেশি, যা এখন ২৫ বিলিয়নে নেমেছে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) সূত্র মেনে করা হিসাবে রিজার্ভ দাঁড়িয়েছে ২০ বিলিয়ন ডলারে।
বিশেষজ্ঞরা এই সংকটের জন্য বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে আমদানিনির্ভরতাকে দায়ী করে থাকেন। তাঁরা মনে করেন, দেশে গ্যাস উত্তোলনে জোর না দিয়ে সরকার আমদানির পথ বেছে নিয়েছে। তার নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে এখন।
কার কত বকেয়া?
দেশে সরকারি ও বেসরকারি খাতে বিদ্যুৎকেন্দ্র রয়েছে। ভারত থেকেও বিদ্যুৎ আমদানি হয়। সব বিদ্যুৎ কেনে পিডিবি। সংস্থাটির সর্বশেষ গত মাস ডিসেম্বরের হিসাবে, তাদের কাছে বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকা পাবে। দীর্ঘদিন ধরে অর্থ বিভাগ ভর্তুকিবাবদ যথেষ্ট টাকা না দেওয়ায় এই বকেয়া জমেছে।
অর্থ বিভাগ ভর্তুকির টাকা দিতে না পেরে এখন বন্ড (সঞ্চয়পত্রের মতো আর্থিক পণ্য) ছাড়ছে, যা দিয়ে বিদ্যুৎ ও সার খাতে দেনা পরিশোধ করা হবে। ইতিমধ্যে দুই হাজার কোটি টাকার বন্ড ছাড়া হয়েছে বিদ্যুৎকেন্দ্রের দেনা পরিশোধে।
বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রের মালিকদের সমিতি বাংলাদেশ ইনডিপেনডেন্ট পাওয়ার প্রডিউসারস অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি ইমরান করিম বলেন, বন্ডের কাজটা ধীরগতিতে হচ্ছে। ১২ হাজার কোটির মধ্যে ২ হাজার কোটি টাকার বন্ড দিয়েছে। বাকিটাও দ্রুত করা দরকার। এরপরও বকেয়া থাকবে পাওনার অর্ধেক। তিনি বলেন, এবারের গ্রীষ্ম মৌসুম দীর্ঘ হতে পারে। পাওনা পরিশোধ করা না হলে বিদ্যুৎকেন্দ্র চালানো কঠিন হবে।
বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য জ্বালানি তেল, কয়লা আমদানিসহ অন্যান্য প্রয়োজনে কত ডলার লাগতে পারে, তা বছর শুরুর আগেই জানিয়েছিল পিডিবি। চলতি অর্থবছরে (২০২৩-২৪) গত ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রথম ছয় মাসে তাদের চাহিদা ছিল ৩৭৩ কোটি ডলার। আগামী ছয় মাসে চাহিদা আরও বেশি হবে বলে কর্মকর্তাদের প্রক্ষেপণ রয়েছে। তবে নিয়মিত ডলার পাচ্ছে না পিডিবি। এতে আমদানি করা বিদ্যুতের দাম নিয়মিত পরিশোধ করতে পারছে না সংস্থাটি।
ভারত থেকে ১ হাজার ১৬০ মেগাওয়াট করে বিদ্যুৎ আমদানি হচ্ছে কয়েক বছর ধরে। এর সঙ্গে গত বছরের মার্চ থেকে যুক্ত হয়েছে ঝাড়খন্ডের গোড্ডায় নির্মিত আদানির বিদ্যুৎকেন্দ্র। বিদ্যুৎ বিভাগ সূত্র জানিয়েছে, গত ডিসেম্বরের হিসাবে আদানির বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিল প্রায় ৫০ কোটি ডলার বকেয়া পড়েছে এবং তা বাড়ছে। তবে এখনো চাহিদামতো বিদ্যুৎ সরবরাহ অব্যাহত রেখেছে আদানি।
অবশ্য কয়লা আমদানি করতে না পারায় গত বছর একাধিক দফায় কিছু কিছু সময়ের জন্য বন্ধ ছিল রামপাল ও পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্র (একটি ইউনিট)।
ভুল নীতি নেওয়া হচ্ছে বিদ্যুৎ খাতে
দেশে এখন দিনে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা আছে ২৬ হাজার মেগাওয়াটের বেশি। কিন্তু প্রয়োজনের সময় জ্বালানির অভাবে চাহিদামতো বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যায় না। দিনে সর্বোচ্চ বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়েছে গত বছরের ১৯ এপ্রিল, ১৫ হাজার ৬৪৮ মেগাওয়াট। এরপর এখন পর্যন্ত দিনে সর্বোচ্চ উৎপাদন করা হয়েছে সাড়ে ১৪ হাজার মেগাওয়াট। গড়ে ২৫ শতাংশ বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা জ্বালানির অভাবে বন্ধ রাখতে হয়েছে গত গ্রীষ্ম মৌসুমে।
এদিকে জ্বালানি তেল বিক্রি করে দেড় বছর ধরে মুনাফা করছে বিপিসি। তবে প্রায় দুই বছর ধরে আমদানি করা জ্বালানি তেলের বিল পরিশোধে নিয়মিত ডলার পাচ্ছে না কর্পোরেশনটি। বকেয়া বিল পরিশোধে জ্বালানি তেল সরবরাহকারী বিদেশি কোম্পানির চাপ বাড়ছে। বিকল্প হিসেবে চীনের সঙ্গে ইউয়ান ও ভারতের সঙ্গে রুপিতে লেনদেনে গত বছরের মে মাসে জ্বালানি বিভাগে প্রস্তাব দিয়েছিল বিপিসি। তা এখনো চূড়ান্ত হয়নি।
বিপিসি সূত্র বলছে, প্রতি মাসে ৫ লাখ টন পরিশোধিত জ্বালানি তেল ও ১ লাখ টন অপরিশোধিত জ্বালানি তেল আমদানি করতে ১৭ থেকে ১৮টি ঋণপত্র খোলার দরকার হয় তাদের। কিন্তু ডলারের অভাবে ব্যাংকগুলো নিয়মিত গড়িমসি করে। একটি ঋণপত্রের মূল্য পরিশোধে ২৫ থেকে ৩০ দিন সময় লাগছে।
বিপিসির হিসাবে, গত বৃহস্পতিবার পর্যন্ত বিদেশি কোম্পানির বকেয়া বিল জমেছে ২৭ কোটি ডলার। কর্মকর্তারা বলছেন, বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে মাঝেমধ্যে দুই কোটি ডলার করে ছাড় করা হয়। তবে তা দিয়ে বকেয়া পুরোটা পরিশোধ করা যাচ্ছে না। বিদেশি কোম্পানিগুলো বকেয়া না পেলে জ্বালানি তেল সরবরাহ না করার বিষয়ে সতর্ক করছে।
দেশে উত্তোলন করে শেভরন তার ভাগের গ্যাস সরকারের কাছেই বিক্রি করে। সরকার তাদের মূল্য পরিশোধ করে ডলারে। দেশে উৎপাদিত গ্যাসের ৫৫ শতাংশ সরবরাহ করে শেভরন। প্রতি মাসে তাদের গড়ে প্রায় পাঁচ কোটি ডলার বিল পরিশোধ করতে হয়।
জ্বালানি বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, শেভরনকে কয়েক মাস ধরে বিল দেওয়া হচ্ছে। তবে আগের বকেয়া জমে আছে। পরিমাণ ২০ কোটি ডলারের বেশি।
পেট্রোবাংলা সূত্র জানিয়েছে, তারা পিডিবির কাছে যেমন ৮ হাজার কোটি টাকার বেশি গ্যাস বিল পাবে, তেমনি সরকারি সার কারখানার কাছে পাওনা ২ হাজার কোটি টাকার বেশি। বারবার তাগাদার পরও সেই টাকা পাওয়া যাচ্ছে না।
ডলারের সংকটে ২০২২ সালের জুলাইয়ে খোলাবাজার থেকে তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাস (এলএনজি) আমদানি বন্ধ করে দেয় সরকার। তখন গ্যাস–সংকট শুরু হলে ব্যবসায়ীরা বাড়তি দাম দিতে সম্মত হন, তবে নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস চান। সরকার দাম বাড়িয়ে দেয় গড়ে ৮০ শতাংশ। কিন্তু গ্যাস–সংকট রয়েই গেছে।
‘দাম বাড়িয়ে সমস্যার সমাধান হবে না’
বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে আমদানিনির্ভরতা এবং বিদ্যুৎ খাতে প্রয়োজনের অতিরিক্ত সক্ষমতা ও বিপুল কেন্দ্র ভাড়া দেশের অর্থনীতিকেই চাপে ফেলেছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। তাঁরা বলছেন, জ্বালানি খাতেই বছরে ১২ বিলিয়ন (১ হাজার ২০০ কোটি) ডলারের সমপরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা দরকার। এত ডলার জোগান দেওয়া কঠিন।
বেসরকারি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) জ্যেষ্ঠ গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, বিদ্যুৎ-জ্বালানি খাতের আর্থিক পরিস্থিতি লেজেগোবরে অবস্থায়। সক্ষমতা বাড়িয়ে বিদ্যুৎকেন্দ্রের ভাড়া দিতে দিতে পিডিবি এখন শ্বেতহস্তী হতে যাচ্ছে। তিনি বলেন, বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দাম বাড়িয়ে সরকার হয়তো আর্থিক সাশ্রয় করতে পারবে, কিন্তু সমস্যার সমাধান হবে না। প্রথম আলো।