ভোক্তাকণ্ঠ ডেস্ক: টানা চার মেয়াদে আওয়ামী লীগের সরকার পরিচালনার শুরুটা হয়েছিল ২০০৯ সালে। শুরু থেকেই সরকার মানুষের দোড়গোঁড়ায় বিদ্যুৎ পৌঁছে দেওয়ার চ্যালেঞ্জ নিয়েছিল। সেই চ্যালেঞ্জ উতরে দেশের শতভাগ মানুষ এখন বিদ্যুৎ সুবিধার আওতায়। গত ১৪ বছরে বিদ্যুতের উৎপাদন, বিতরণ সব সূচকেই উন্নতি দৃশ্যমান। অগ্রাধিকার ভিত্তিতে এ খাতে সরকারের অর্থ বরাদ্দও বেড়েছে কয়েকগুণ।
দেশে ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা ও আবাসনের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে বিদ্যুতের চাহিদা৷ চাহিদা পূরণে উৎপাদন বাড়াতে গত ১৪ বছরে বিদ্যুৎকেন্দ্রের সংখ্যা যেমন বাড়ানো হয়েছে, তার বিপরীতে গ্রাহক সংখ্যাও বেড়েছে বহুগুণ। এসময়ে উৎপাদন ও চাহিদা বৃদ্ধির পাশাপাশি দফায় দফায় বিদ্যুতের দামও বাড়ানো হয়েছে। নতুন করে আরও এক দফা দাম বাড়ানোর চিন্তা করছে সরকার।
বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের বিদ্যুৎ বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, দেশে ২০০৯ সাল থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত ১২৫টি নতুন বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে৷ ২০০৯ সালে দেশে মোট বিদ্যুৎকেন্দ্রের সংখ্যা ছিল ২৭টি৷ তা বেড়ে এখন ১৫২টি হয়েছে৷ সেসময় বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর উৎপাদন ক্ষমতা ছিল চার হাজার ৯৪২ মেগাওয়াট৷ বর্তমানে দেশের ক্যাপটিভ ও নবায়নযোগ্য জ্বালানিসহ বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ২৯ হাজার ৭২৭ মেগাওয়াট৷ সে হিসাবে গত ১৪ বছরে দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন বেড়েছে ২৪ হাজার ৭৮৫ মেগাওয়াট৷
তৎকালীন সময়ে দেশে একদিনে সর্বোচ্চ তিন হাজার ২৬৮ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন ছিল ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি৷ এরপর সর্বশেষ সর্বোচ্চ উৎপাদন হয় ২০২৩ সালের ১৯ এপ্রিল৷ ওইদিন উৎপাদিত বিদ্যুতের পরিমাণ ছিল ১৫ হাজার ৬৪৮ মেগাওয়াট৷ এছাড়া গত ১৪ বছরে সঞ্চালন লাইন আট হাজার কিলোমিটার থেকে বেড়ে ১৪ হাজার ৯৬০ কিলোমিটারে উন্নীত হয়েছে৷ এসময়ে গ্রিড সাব-স্টেশন ক্ষমতা (এমভিএ) ১৫ হাজার ৮৭০ থেকে বেড়ে হয়েছে ৬৬ হাজার ১৫০ এমভিএ। তখন বিদ্যুৎ আমদানি করা না হলেও জনগণের চাহিদার প্রতি নজর রেখে সরকার বিদ্যুৎ আমদানির সিদ্ধান্ত নিয়েছিল৷ সেই সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে এখন দুই হাজার ৬৫৬ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানি করা হয়৷
আলোচিত সময়ে বেড়েছে বিদ্যুৎ বিতরণ লাইনের পরিমাণও৷ ১৪ বছর আগে যেখানে বিদ্যুৎ বিতরণ লাইন ছিল দুই লাখ ৬০ হাজার কিলোমিটার, সেটি এখন বেড়ে ছয় লাখ ৪৩ হাজার কিলোমিটার। সরকারের ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছে দেওয়ার পরিকল্পনার সফলতার অংশ হিসেবে দেশে এখন শতভাগ মানুষ বিদ্যুৎ সুবিধার আওতায় এসেছে৷
গত ১৪ বছরে বেড়েছে মাথাপিছু বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতাও৷ ২০০৯ সালে মাথাপিছু বিদ্যুৎ উৎপাদন (কিলোওয়াট ঘণ্টা) ছিল ২২০, এখন তা ক্যাপটিভ ও নবায়নযোগ্য জ্বালানিসহ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬২০৷ এসময়ে গ্রাহক সংখ্যা দুই লাখ ৩৪ হাজার থেকে বেড়ে হয়েছে চার লাখ ৭৩ হাজার৷ ২০০৮-০৯ অর্থবছরে বিদ্যুৎ বিতরণের সিস্টেম লস ১৪ দশমিক ৩৩ শতাংশ থাকলেও সেটি কমে এখন দাঁড়িয়েছে ৭ দশমিক ৬৫ শতাংশে৷
বিদ্যুৎ উৎপাদন, বিতরণ সব সূচকেই উন্নতি যেমন হয়েছে, একই সঙ্গে এ খাতে সরকারের বরাদ্দের পরিমাণও বেড়েছে কয়েকগুণ। ২০০৯ সালে বিদ্যুৎ খাতে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) ছিল দুই হাজার ৬৭৭ কোটি টাকা। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে এ খাতে এডিপি বরাদ্দ ধরা হয়েছে ৩৫ হাজার ৪৪০ দশমিক ৪৫ কোটি টাকা৷
বিদ্যুৎ বিভাগ সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মানুষের ঘরে ঘরে সরকারের বিদ্যুৎ পৌঁছে দেওয়ার পরিকল্পনা এবং বিদ্যুৎ খাতকে অগ্রাধিকার বিবেচনায় বাড়তি বরাদ্দসহ সময়োপযোগী সিদ্ধান্তে এ খাতের অগ্রগতি সাধিত হয়েছে৷
গত ১৪ বছরে বিদ্যুৎ উৎপাদন ও চাহিদা যেমন বেড়েছে, এসময়ে শতগুণেরও বেশি বেড়েছে বিদ্যুতের দাম৷ গত ১৪ বছরে দেশে বিদ্যুতের দাম বেড়েছে ৯ বার। এসময়ে বিদ্যুতের দাম পাইকারি পর্যায়ে ১১৮ শতাংশ আর গ্রাহক পর্যায়ে বেড়েছে ৯০ শতাংশ। ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে পাইকারি পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম ৮ দশমিক ৩৯ শতাংশ বাড়ানো হয়। একই সঙ্গে খুচরা পর্যায়ে দাম বাড়ানো হয় ৫ দশমিক ৩ শতাংশ। নতুন দাম ওই বছরের মার্চে কার্যকর হয়। পরে আরেক দফা পাইকারিতে দাম বাড়ানো হয় ২০২২ সালের ডিসেম্বরে৷
সরকারের নির্বাহী আদেশে সর্বশেষ গত বছরের ১২ জানুয়ারি গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর ঘোষণা আসে। সে সময় বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের এ সংক্রান্ত এক প্রজ্ঞাপনে আবাসিক গ্রাহক পর্যায়ে শূন্য থেকে ৫০ ইউনিট ব্যবহারকারী লাইফলাইন গ্রাহকদের বিদ্যুতের দাম ইউনিটপ্রতি ৩ টাকা ৭৫ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ৩ টাকা ৯৪ পয়সা, শূন্য থেকে ৭৫ ইউনিট ব্যবহারকারীর বিদ্যুতের দাম ইউনিটপ্রতি ৪ টাকা ১৯ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ৪ টাকা ৪০ পয়সা, ৭৬ থেকে ২০০ ইউনিট ব্যবহারকারীর ইউনিটপ্রতি ৫ টাকা ৭২ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ৬ টাকা ১ পয়সা, ২০১ থেকে ৩০০ ইউনিট ব্যবহারকারীর ইউনিটপ্রতি ৬ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৬ টাকা ৩০ পয়সা, ৩০১ থেকে ৪০০ ইউনিটের জন্য ইউনিটপ্রতি ৬ টাকা ৩৪ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ৬ টাকা ৬৬ পয়সা, ৪০১ থেকে ৬০০ ইউনিটের জন্য ইউনিটপ্রতি ৯ টাকা ৯৪ পয়সা থেকে ১০ টাকা ৪৫ পয়সা এবং ৬০০ ইউনিটের বেশি বিদ্যুৎ ব্যবহারকারী আবাসিক গ্রাহকদের বিদ্যুৎ বিল ইউনিটপ্রতি ১১ টাকা ৪৯ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ১২ টাকা ৩ পয়সা করা হয়।
তথ্য বলছে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে বিদ্যুৎ খাতে ৪২ হাজার ৮৯৩ কোটি টাকা ভর্তুকি দিয়েছে সরকার৷ তবে নতুন করে জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকি কমিয়ে আনতে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) শর্ত পূরণের চাপ রয়েছে সরকারের ওপর। এরই মধ্যে সরকার সংস্থাটির কাছে রাজস্ব আয় বাড়ানোর পাশাপাশি ব্যয় ও ভর্তুকি যৌক্তিকীকরণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে৷ এর পরিপ্রেক্ষিতে গত বছরের ডিসেম্বরে বাংলাদেশের জন্য ঋণের দ্বিতীয় কিস্তির অর্থ ছাড়ের সিদ্ধান্ত অনুমোদন করে আইএমএফ।
তখন সংস্থাটির এক প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশ সরকার সব ধরনের জ্বালানি পণ্যের ওপর ভর্তুকি প্রত্যাহারের পরিকল্পনা নিয়েছে এবং এ জন্য একটি ফর্মুলাভিত্তিক দর সমন্বয় পদ্ধতি গ্রহণ করা হবে। ২০২৪ সালের মার্চের মধ্যে এটি বাস্তবায়ন করা হবে। এছাড়া বিদ্যুৎ খাতের ভর্তুকি কমাতে বিদ্যুতের দাম সমন্বয় ও বিদ্যুৎকেন্দ্রের চুক্তি নবায়নের সময় ক্যাপাসিটি চার্জ অন্তর্ভুক্ত না করার বিষয়েও আইএমএফের কাছে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে বাংলাদেশ।
বিদ্যুৎ খাতে ক্রমান্বয়ে ভর্তুকি কমিয়ে আনার চিন্তা করছে সরকার৷ এরই ধারাবাহিকতায় দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের পর অর্থনৈতিক চাপের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় আবারও বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হতে পারে। শিগগির সরকারের নীতি নির্ধারণী পর্যায় থেকে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত আসার কথা রয়েছে। মার্চে নতুন এই দাম সমন্বয়ের কাজ শুরু হতে পারে৷ তবে বিদ্যুতের দাম একবারে না বাড়িয়ে ধাপে ধাপে বাড়ানোর পরিকল্পনা করা হচ্ছে বলে জানা গেছে৷
বিদ্যুৎ বিভাগের জ্যেষ্ঠ সচিব মো. হাবিবুর রহমান বলেন, ২০৩০ সালের মধ্যে ৪০ হাজার এবং ২০৪১ সালের মধ্যে ৬০ হাজার মেগাওয়াট উৎপাদনের পরিকল্পনা রয়েছে৷ আগামী প্রজন্ম যেন বিদ্যুৎ সংকটে না পড়ে সেজন্য আমরা কাজ করে যাচ্ছি৷
দাম বাড়ানোর বিষয়ে তিনি বলেন, বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর পরিকল্পনা আছে, তবে কবে নাগাদ বাড়ানো হবে সেটি বলা যাচ্ছে না৷
জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মুদ্রাস্ফীতি এমনিতেই বাড়ছে৷ বাজারে জিনিসপত্রের দামও চড়া৷ নতুন করে বিদ্যুৎতের দাম বাড়ানো হলে অর্থনীতির সব খাতেই এর প্রভাব পড়বে৷ দাম আরও বেড়ে যেতে পারে সব ধরনের পণ্যের৷ এতে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে নতুন চ্যালেঞ্জে পড়তে হবে সরকারকে৷ সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের জীবনযাপন হবে আরও কষ্টকর।
কনজুমারস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্যেষ্ঠ সহ-সভাপতি ও জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক এম শামসুল আলম বলেন, বিদ্যুৎ খাতে বিভিন্ন সময়ে যৌক্তিক ব্যয় অপেক্ষা অযৌক্তিক ও অন্যায় ব্যয় সংযোজন হয়েছে। সেই ব্যয় বৃদ্ধির কারণে সরবরাহ ব্যয় ও ঘাটতি বেড়েছে৷ আবার ঘাটতি সমন্বয়ের জন্য ভর্তুকি বেড়েছে এবং মূল্যবৃদ্ধি হয়েছে৷ আমরা হিসাব করে দেখেছি, বছরে ৪০ হাজার কোটি টাকার মতো অতিরিক্ত ব্যয় সংযোজন হয়েছে৷ প্রতিযোগিতাবিহীন বিনিয়োগ আকর্ষণ করে এ ধরনের উন্নয়ন করায় এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। অযৌক্তিক ও অন্যায় ব্যয় সংযোজন থেকে বিদ্যুৎ খাত মুক্ত করতে না পারলে ব্যয় ও ভর্তুকি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকবে এবং সেটি অবধারিত৷
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. ম. তামিম বলেন, বিদ্যুতের দাম বাড়লে সাধারণ মানুষ সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে৷ কেননা বিদ্যুতের ওপর নির্ভরশীল সব উৎপাদন প্রতিষ্ঠানের উৎপাদিত দ্রব্যের দাম বেড়ে যাবে৷ অতীতে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর আগে বিইআরসিকে (বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন) জানানো হতো৷ প্রতিষ্ঠানটি গণশুনানির আয়োজন করতো৷ তখন দাম বাড়ানো নিয়ে তর্ক-বিতর্কের সুযোগ ছিল৷ এখন আর সেই সুযোগ নেই৷ এসব বিষয়ে কিছুই জানানো হয় না৷
বিদ্যুতের দাম না বাড়িয়ে উৎপাদন খরচ কমানোর ওপর গুরুত্বারোপ করে তিনি বলেন, বিদ্যুতের দাম না বাড়িয়ে সঠিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে উৎপাদন খরচ কমানোর পরিকল্পনা করতে হবে। কারণ, দাম বাড়ালে তার মাশুল গুনতে হবে সাধারণ মানুষকে। জাগোনিউজ।