এম শামসুল আলম ও আনু মুহাম্মদ: দেশে খুচরা ও পাইকারি পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম বাড়িয়েছে সরকার। নতুন দাম ফেব্রুয়ারি মাসের বিল থেকেই কার্যকর হবে। গ্রাহক পর্যায়ে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম গড়ে ৭০ পয়সা বেড়েছে। ইউনিটপ্রতি খুচরা বিদ্যুতের দাম গড়ে ৮ টাকা ২৫ পয়সা থেকে বেড়ে হয়েছে ৮ টাকা ৯৫ পয়সা। গ্রাহক পর্যায়ে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম গড়ে বেড়েছে সাড়ে ৮ শতাংশ। পাইকারি পর্যায়ে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছে গড়ে ৫ শতাংশ। এতে পাইকারি বিদ্যুতের দাম প্রতি ইউনিট ৬ টাকা ৭০ পয়সা থেকে বেড়ে হয়েছে ৭ টাকা ৪ পয়সা।
গত ১৫ বছরে এ নিয়ে মোট ১০ বার বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হলো। অর্থনীতিবিদ ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ক্রমান্বিত মূল্যস্ফীতির এই সময়ে বিদ্যুতের দাম বাড়ানো দেশের অর্থনীতির ওপর বিরাট আঘাত আনবে। ভোক্তা যেমন সরাসরি আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে তেমনি ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের জন্য বাজারে টিকে থাকা চ্যালেঞ্জ হবে। একই সঙ্গে দেশীয় অর্থনীতিতে আমদানিনির্ভরতাও বাড়বে। এভাবে ঘন ঘন বিদ্যুতের দাম বাড়ানোকে জনগণের ওপর সরকারের এক ধরনের ‘জুলুম’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছে তারা।
এ বিষয়ে কথা হয় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক শিক্ষক ও অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ এবং জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও কনজুমারস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সদস্য অধ্যাপক এম শামসুল আলমের সঙ্গে।
অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেন, ‘এর আগে নয় বার বিদ্যুতের দাম বেড়েছে, তো শেষ হয়নি। কয়েক মাস পরে আবার বাড়বে, তার কয়েক মাস পর আবারও বাড়বে, এটা অব্যাহত ভাবে বাড়তে থাকবে। সরকার যে মহাপরিকল্পনার অধীনে বিদ্যুৎ-জ্বালানি খাত পরিচালনা করছে সেটাতে অবিরাম মূল্যবৃদ্ধি অনিবার্য। দাম বাড়বে কিন্তু বিদ্যুৎ যে নিশ্চিতভাবে পাওয়া যাবে সেটাও হবে না।’
আমাদের চাহিদার তুলনায় অনেক বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘প্রায় জায়গায় লোডশেডিং হচ্ছে আবার বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছে। দাম বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে যে লোডশেডিং হবে সেটাও বলা হচ্ছে। এই যে বিশৃঙ্খলা, নৈরাজ্য, স্ববিরোধিতা- এগুলো পরিকল্পনার কারণেই হচ্ছে। বাংলাদেশের কিছু ব্যবসায়ী গোষ্ঠী এবং বিদেশি কিছু কোম্পানির স্বার্থকেই এখানে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। দাম বাড়তে থাকবে এটার অনিবার্য ফলাফল হলো ঋণগ্রস্ত মানুষের সংখ্যা বাড়তে থাকবে, মানুষের বোঝা বাড়বে, জিনিসপত্রের দাম সামাল দিতে গিয়ে চিকিৎসার সংকট তৈরি হবে।’
জিনিসপত্রের দাম কমানোর প্রতি সরকারের কোনো আগ্রহ নেই উল্লেখ করে এই অর্থনীতিবিদ বলেন, ‘রমজান ছাড়াও বেশ কিছুদিন ধরে জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে। মূল্যবৃদ্ধির ফলে যারা মুনাফা করছে সরকার তাদের স্বার্থহানি করতে চায় না। রমজানের সময় যে দাম বাড়ার তৎপরতা বাড়ে সেটাও জানা কথা। এবার তেল, গ্যাস, বিদ্যুৎতের বাম একসঙ্গে বাড়িয়ে মনে হচ্ছে সরকার জনগণের বিরুদ্ধে একটা যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। এখন পরিবহন ব্যয়, বাসাভাড়া, জিনিসপত্রের দাম সবকিছুই বাড়বে।’
তিনি বলেন, ‘বড় বড় যারা ব্যবসায়ী, শিল্পপতি রয়েছেন তারা ব্যাংক থেকে টাকা মেরে দিতে পারেন। সরকারের সঙ্গে আপস নাও করতে পারেন। তাদের তো কোনো অসুবিধা নেই। কিন্তু মাঝারি বা ছোট শিল্প, উৎপাদক, কৃষক এদের উৎপাদনশীলতা, প্রতিযোগিতার ক্ষমতা, বিনিয়োগ সব কিছু আঘাতপ্রাপ্ত হবে। সামগ্রিক অর্থনীতিতে বড় ধরনের আঘাত আসবে।’
বিদ্যুতের দাম বাড়ানো জনগণের সঙ্গে প্রতারণার শামিল উল্লেখ করে অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেন, ‘এটা খুবই প্রতারণামূলক। প্রতারণামূলক এ কারণে যে বিদ্যুৎ খাতে উৎপাদন খরচ আগের তুলনায় অনেক বেশি বেড়েছে। এই উৎপাদন খরচ কিন্তু জনগণকে বিদ্যুৎ দেওয়ার জন্য বাড়েনি, উৎপাদন খরচ বাড়ার অন্যতম কারণ আমদানিনির্ভর, ঋণনির্ভর ও বিদেশি কোম্পানিনির্ভর। এই তিন ‘নির্ভর’ বিদ্যুৎ-জ্বালানি পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে।’
তিনি বলেন, ‘দেশের গ্যাস সম্পদ অনুসন্ধান ও উত্তোলনের জাতীয় সক্ষমতা বাড়ানোর কোনো ব্যবস্থাই সরকার করেনি। নবায়নযোগ্য জ্বালানি নিয়ে সরকার আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে যে ধরনের কথা দিয়ে আসে দেশে এসে তার কোনো প্রতিফলন থাকে না। এই দুটি বাদ দিয়ে তারা আমদানিনির্ভর যেমন এলএনজি আমদানি করছে, কয়লানির্ভর প্রকল্প করছে, আমদানির ওপর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র করছে। এর সবগুলোই বিদেশি কোম্পানিনির্ভর। এটির কারণে বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচ বেড়ে গেছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘যদি নিজেদের গ্যাস উত্তোলন অনুসন্ধানের ব্যবস্থা করা হতো, নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাতে অগ্রগতি হতো তাহলে বিদ্যুতের দাম বরং কমানো সম্ভব হতো। বিদ্যুৎখাতে যে ভর্তুকি দেওয়া হচ্ছে তা জনগণের জন্য নয়, এটি একটি নির্দিষ্ট গোষ্ঠীকে বা ব্যবসায়ীদের মোটা অংকের লাভ দেওয়ার জন্য দেওয়া হচ্ছে।’
অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেন, ‘বিদ্যুৎকেন্দ্রে ক্যাপাসিটি চার্জ এমনভাবে দেওয়া হচ্ছিল যে, তোমার কাছ থেকে বিদ্যুৎ না নিলে তোমাকে পয়সা দেবো। এই চুক্তিটা উদ্দেশ্যমূলক ছিল। দায়মুক্তি আইনের অধীনে এই চুক্তিগুলো করা হয়েছে, যার কারণে ক্যাপাসিটি চার্জ কোটি টাকা দেওয়া হচ্ছে। এতে বিদ্যুৎ সমিতির সমাধান সেভাবে হচ্ছে না কিন্তু জনগণের ওপর চাপ দিন দিন বাড়ছে। আইএমএফ ও সরকার ভর্তুকি কমানোর কথা বলে কিন্তু ভর্তুকির কারণ দূর করার কোনো কথা বলে না। এর অর্থ হচ্ছে দাম বাড়তে থাকবে, কিছু গোষ্ঠী ব্যবসা করবে এবং জনগণের ওপর যে চাপ সেটা অসহ্যের দিকে চলে যাবে।’
বিদ্যুতের দাম বাড়ায় দেশ আরও আমদানিনির্ভর হবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘দেশের মধ্যে যারা স্থানীয়ভাবে উৎপাদন করে, বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি তাদের ওপর বড় ধরনের আঘাত আনবে। বিশেষ করে যারা মাঝারি শিল্প তারা অনেক ক্ষেত্রে মার খেয়ে যাবে। এমনিতে আমদানিনির্ভরতা তো অনেক বাড়ছে। সবকিছুতেই আমাদের নির্ভরতার একটা প্রবণতার দিকে যাচ্ছে। ফলে অর্থনীতির ভিত্তির ওপর আঘাত আসবে।’
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও কনজুমারস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সদস্য অধ্যাপক এম শামসুল আলম বলেন, ‘ভোক্তাদের আয় বাড়ছে না। ভোক্তা যে পরিমাণ বেতন পায় সেই বেতন দিয়ে আগে যে পরিমাণ পণ্য কিনতো এখন বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর পরে তার চেয়ে কম পরিমাণ পণ্য কিনবে। বাজারে কেনাবেচা কমে যাবে। এতে ভোক্তারা ভোগপণ্য থেকে বঞ্চিত হলো। বাজারে কেনাবেচা যদি কমে যায় তাহলে সরকারের রাজস্ব আয় কমে যাবে। কারণ ভ্যাট ও ট্যাক্সের পরিমাণ কমে যাবে।’
তিনি বলেন, ‘বিনিয়োগকারীদের ব্যবসা ঝুঁকির মধ্যে পড়বে। কারণ পণ্য কেনাবেচা কম হলে তাদেরও আয় কমবে, লাভ কম হবে। উৎপাদন ব্যয় বাড়ার কারণে উৎপাদিত পণ্যের দামও বেড়ে যাবে। বাজারে যদি পণ্যের চাহিদা কমে যায় তাহলে উৎপাদনকারীর উৎপাদনও কম করতে হবে। তাতে তারাও আয় হারাবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘এতে সরকারের আয় কমবে, সরকার যে বাজেট করেছে সেই বাজেটে ঘাটতি দেখা দেবে। বাজেট ঘাটতি বাড়লে সরকার টাকা ছাপিয়ে সেই ঘাটতি পূরণ করবে। তখন টাকার মান আরও কমবে। সরকারের আমদানি করার ক্ষমতা কমবে। এরকম পরিস্থিতিতে সরকারের আর্থিক সক্ষমতা দুর্বল হবে। সরকারের ব্যয় বাড়বে, আয় কমবে। ভোক্তার যেমন আয় কমছে ব্যয় বাড়ছে, সরকারেরও তুলনামূলক আয় কমবে।’
শামসুল আলম বলেন, ‘এ ঘটনা যদি চলতেই থাকে তাহলে আয় বাড়লে যেমন প্রবৃদ্ধি বাড়ে তেমনি ভাবে আয় কমলে তখন প্রবৃদ্ধি কমতে থাকবে। অর্থনীতির বিপর্যয়ও চলে আসতে পারে। অলরেডি আমরা মোকাবিলা করছি সে অবস্থা থেকে উত্তরণের। দিন দিন এটি আরও কঠিন হয়ে যাবে। আমরা এটি আশঙ্কা করছি।’
তিনি বলেন, ‘উৎপাদিত পণ্যের বাজার যদি সংকুচিত হয়ে আসে মাঝারি শিল্পের জন্য টিকে থাকা কষ্টকর হবে, ঝুঁকি বাড়বে। কারণ সুবিধাজনক অবস্থা সংকুচিত হয়ে আসছে। বড় কোম্পানির সমস্যাগুলো দৃশ্যমান হতে সময় লাগে কিন্তু ছোট কোম্পানির সমস্যাগুলো খুব সহজে দৃশ্যমান হয়।’
বিদ্যুতের দাম যদি যৌক্তিক হয় তাহলে বাড়তে পারে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘এখন দাম বাড়ানো যৌক্তিক কি না সেটি তো ভোক্তাকে বুঝতে দেওয়া হলো না। যখন খুশি তখন দাম বাড়ানো এক ধরনের জুলুম। গণশুনানির মাধ্যমে দাম বাড়ালে ভোক্তার অংশগ্রহণ নিশ্চিত হতো। ভোক্তা তখন অনুধাবন করতে পারতো তার থেকে যৌক্তিক মূল্য নেওয়া হচ্ছে কি হচ্ছে না। এখন তো ভোক্তাকে বাধ্য করা হচ্ছে, ভোক্তার ওপর জুলুম করা হচ্ছে। জুলুম করে পয়সা আদায় করা লুণ্ঠনের শামিল।’ জাগোনিউজ।