ভোক্তাকণ্ঠ ডেস্ক: রমজানের শুরু থেকে ওয়াসার পানি নিয়ে কষ্টে আছি। এখন ‘মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা’ হয়ে এসেছে লোডশেডিং। সারাদিনে ছয় থেকে আটবার লোডশেডিং হচ্ছে। বাচ্চা দুটোকে নিয়ে সারারাত জেগে থাকতে হয়। নিস্তার নেই ইফতার-সেহরিতেও।”
এভাবেই তীব্র লোডশেডিংয়ে নিজেদের বিপর্যস্ত দিনলিপির বিবরণ দিচ্ছিলেন চট্টগ্রামের আগ্রাবাদ এলাকার গৃহবধূ ইফফাত সুলতানা।
শুধু আগ্রাবাদ নয়, বন্দর নগরী চট্টগ্রামে অধিকাংশ এলাকায় দিনে আট থেকে ১০ বার বিদ্যুৎ বিভ্রাটের ঘটনা ঘটছে। মধ্যরাতেও লোডশেডিং হওয়ায় প্রচণ্ড গরমে বাসিন্দারা রাতে ঘুমাতে পারছেন না। বিদ্যুৎ থাকছে না সেহরি-ইফতারের সময়ও। গ্রামাঞ্চলের পরিস্থিতি আরও খারাপ। একবার বিদ্যুৎ চলে গেলে সহজে আসছে না।
বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) সিস্টেম কন্ট্রোল সূত্র জানিয়েছে, শনিবার ছুটির দিনে পিক আওয়ারে (সন্ধ্যায়) চট্টগ্রামে বিদ্যুতের চাহিদা ছিল এক হাজার ২৮০ মেগাওয়াট। এর বিপরীতে জাতীয় গ্রিড থেকে পাওয়া গেছে ৯০০ মেগাওয়াট। ফলে ওই সময়ে চট্টগ্রামে লোডশেডিং হয়েছে ৩৮০ মেগাওয়াট। এছাড়া সারাদিনে কমবেশি ১৫০ থেকে ২০০ মেগাওয়াট লোডশেডিং করা হয়েছে।
বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড চট্টগ্রাম দক্ষিণ অঞ্চলের (বিতরণ) তথ্য অনুযায়ী, চট্টগ্রামে সবচেয়ে বেশি ছয় ঘণ্টা লোডশেডিং করা হচ্ছে নগরের বাকলিয়া ও কল্পলোক আবাসিক এলাকায়। এলাকাটি নগরের ঘনবসতিপূর্ণ জনপদগুলোর একটি। এর বাইরে পাথরঘাটা, স্টেডিয়াম, ষোলশহর, কালুরঘাট, বাকলিয়া, মাদারবাড়ি, আগ্রাবাদ, হালিশহর, পাহাড়তলী, খুলশী, রামপুর, নিউমুরিং বিদ্যুৎ সরবরাহকেন্দ্রগুলো পাঁচ ঘণ্টা পর্যন্ত লোডশেডিং করতে বাধ্য হচ্ছে।
শহরের বাইরে বিদ্যুৎ সরবরাহ ইউনিট- ফৌজদারহাট, হাটহাজারী, মোহরা, বাড়বকুণ্ড, সন্দ্বীপ, পটিয়া, সাতকানিয়া, দোহাজারীতে তিন-পাঁচ ঘণ্টা লোডশেডিং করা হচ্ছে বলে জানিয়েছে বিদ্যুৎ বিতরণ বিভাগ (চট্টগ্রাম দক্ষিণ অঞ্চল)। একইভাবে রাঙ্গামাটি, বান্দরবান, খাগড়াছড়ি ও কক্সবাজার বিতরণ বিভাগ তিন -চার ঘণ্টা লোডশেডিংয়ের তথ্য জানিয়েছে।
তবে বিদ্যুৎ বিভাগের এই বিবরণের সঙ্গে বাস্তবতার মিল নেই বলছেন ভোক্তারা। নগর ও জেলার কয়েকটি এলাকার বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে এই তথ্য জানা গেছে।
চান্দগাঁও আবাসিক এলাকার বাসিন্দা মনোয়ারা বেগম জাগো নিউজকে বলেন, ‘সারাদিনে পাঁচ ঘণ্টাও বিদ্যুৎ থাকে না। দিনে-রাতে কম করে ১০-১২ বার বিদ্যুৎ যায়। একবার গেলে এক থেকে দেড় ঘণ্টা পরে আসে।’
প্রায় একই অভিজ্ঞতা নগরের ষোলশহর এলাকার বাসিন্দা পোশাক কারখানার কর্মী নার্গিস আক্তারের। তিনি বলেন, ‘এই রমজানে ইফতারের সময় এবং সেহরিতে বিদ্যুৎ না থাকার মতো বিড়ম্বনা আর নেই। বাধ্য হয়ে রাত জেগে রান্নাবান্না করতে হয়। সকালে কাজে যেতে দেরি হয়ে যায়।’
বিদ্যুৎখাত সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, চাহিদার চেয়ে গ্যাসের সরবরাহ কম। তাই গ্যাসভিত্তিক কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন কম হচ্ছে। এতে কিছুটা ঘাটতি তৈরি হচ্ছে। বিদ্যুৎ খাতে দিনে গ্যাসের চাহিদা ২৩২ কোটি ঘনফুট। এবার গ্রীষ্মে পিডিবি অন্তত ১৫০ কোটি ঘনফুট সরবরাহের দাবি জানিয়েছে। এখন সরবরাহ করা হচ্ছে ৮৮ কোটি ঘনফুট। ফলে গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতার অর্ধেকের বেশি বসিয়ে রাখতে হচ্ছে।
বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড চট্টগ্রাম দক্ষিণ অঞ্চলের (বিতরণ) প্রধান প্রকৌশলী রেজাউল করিম বলেন, ‘বিদ্যুৎ পরিস্থিতি নিয়ে আমরা দুদিন ধরে নাজেহাল অবস্থায় আছি। জাতীয় গ্রিড থেকে প্রয়োজনীয় বিদ্যুৎ সরবরাহ পাওয়া যাচ্ছে না। গতকাল (৩০ মার্চ) আমাদের চাহিদা ছিল সাড়ে ১২শ মেগাওয়াটের বেশি, কিন্তু আমরা পেয়েছি ৯০০ মেগাওয়াট। ফলে বিভিন্ন এলাকায় রেশনিং করে লোডশেডিং করতে হচ্ছে।’
এদিকে সপ্তাহখানেক ধরে চট্টগ্রামের গ্রামাঞ্চলে লোডশেডিং অসহনীয় হয়ে উঠেছে। দিন-রাত মিলিয়ে কোথাও কোথাও ছয় থেকে সাত ঘণ্টা, কোথাও ১২ থেকে ১৩ ঘণ্টা বিদ্যুৎ থাকছে না।
লোডশেডিং নিয়ে দুর্ভাবনায় আছেন বোয়ালখালী উপজেলার কধুরখীল গ্রামের সেচপাম্প মালিক মোহাম্মদ আশরাফ। রোববার (৩১ মার্চ) তিনি ভোক্তা বলেন, ‘গতকাল মাত্র ১০ শতাংশ জমিতে সেচ দিতে আমাকে বিদ্যুতের জন্য পাঁচ ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হয়েছে। এ সময়ে তিন-চারবার বিদ্যুৎ আসছে গেছে। এখনো ঠিকমতো গরম পড়েনি, তাতেই যদি এত ঘন ঘন বিদ্যুৎ চলে যায়, গরমের সময় কী অবস্থা হবে তা নিয়ে টেনশনে আছি।’
দু-তিন দিন ধরে বোয়ালখালীতে দৈনিক ছয়-সাত ঘণ্টা করে লোডশেডিং হচ্ছে বলেও জানান মোহাম্মদ আশরাফ।
ভোক্তা-অধিকার সংগঠন কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) ভাইস প্রেসিডেন্ট এস এম নাজের হোসাইন বলেন, ‘সরকারি তথ্যের চেয়ে বাস্তবে আরও বেশি লোডশেডিং হচ্ছে। নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎসেবা পাওয়া যাচ্ছে না, তবুও বাড়তি উৎপাদন সক্ষমতার মূল্য দিতে হচ্ছে। নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ না দিয়েই দাম বাড়ানো হচ্ছে দফায় দফায়।’