ভোক্তাকণ্ঠ রিপোর্ট: অসাধু ব্যবসায়ীদের ব্যবসায়ীক সুরক্ষার জন্যে দেশে বিদ্যুৎ-জ্বালানির মূল্য বৃদ্ধি করা হচ্ছে বলে দাবি করেছে কনজুমারস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)। তাই ভোক্তাদের অধিকার সুরক্ষায় আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ভর্তুকি কমানোর শর্তের অজুহাতে বিদ্যুৎ-জ্বালানীর মূল্য বৃদ্ধি না করে বরং অনিয়ম ও দুর্নীতি বন্ধের মাধ্যমে ঘাটতি পূরণের আহ্বান জানিয়েছে সংগঠনটি।
বৃহস্পতিবার দুপুরে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সাগর-রুনী মিলনায়তনে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এ দাবি জানায় ক্যাব।
লিখিত বক্তব্যে ক্যাবের জ্বালানি উপদেষ্টা ড. এম শামসুল আলম বলেন, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি দ্রুত সরবরাহ আইন ২০১০ এর আওতায় প্রতিযোগিতাহীন ব্যাক্তিখাত বিনিয়োগে খাতটির উন্নয়ন অব্যাহত আছে৷ তাতে বিনিয়োগকারীরা খেয়াল-খুশি মত বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সরবরাহ ব্যয় বৃদ্ধি করে লুন্ঠনমূলক মুনাফা বৃদ্ধির সুযোগ নিচ্ছে। ফলে আর্থিক ঘাটতি দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। আর তা সমন্বয়ে মূল্য ও ভর্তুকি উভয় বৃদ্ধি পাচ্ছে। ঘাটতি নিয়ন্ত্রণে আনা যাচ্ছে না।
তিনি আরও বলেন, সরকার এখন ৪.৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ঋণের জন্য দিশেহারা হয়ে আইএমএফ এর পেছনে দৌড়াচ্ছে। সেখানে জনগণের স্বার্থ ও কল্যাণ তথা জ্বালানি নিরাপত্তা সুরক্ষা নিশ্চিত করা এখন আর সরকারের জন্য ততটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। তাই ভোক্তারা চরম উদ্বেগের মধ্যে রয়েছে। এই অবস্থায় জাতীয় জ্বালানি নিরাপত্তা হারানোর ভয়ে ভীত হয়ে আমরা সরকারের প্রতি জানাচ্ছি, ‘অসাধু বিদ্যুৎ ও জ্বালানি ব্যবসায় লাগাম দিন, মূল্য বৃদ্ধি থেকে সরে আসুন- মানুষকে অভয় দিন’।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. এজাজ হোসাইন বলেন, সরকার যে মূল্য বৃদ্ধি করবে (বিদ্যুৎ-জ্বালানীর), সেটা আমি দেব। কিন্তু তার মধ্যে যে চুরি ও অপচয় রয়েছে, তার দায় কেন আমি নেব? জ্বালানি নেই, তবুও পাওয়ার প্লান্ট করা হচ্ছে। আইএমএফ-বিশ্ব ব্যাংক কেন অনিয়মের খোঁজ নেয় না। বাংলাদেশে এখনো ৩০ শতাংশ ফার্নেস অয়েল দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হচ্ছে। কিন্তু পৃথিবীর কোথাও ৫ শতাংশের বেশি নেই। এই সকল বিষয়ে দাতা সংস্থাগুলো কেন প্রদক্ষেপ নিচ্ছে না?
তিনি আরও বলেন, ২৫ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে লাভ কি, যদি উৎপাদন না করা যায়। আমি মনে করি, দেশে ১৫ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কেন্দ্র থাকলেই এনাফ (সম্ভব)। কারণ এর বেশিতো আর দেশে উৎপাদন হচ্ছে না। মাঝে মধ্যে ১৬ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের তথ্য পাওয়া যায়। বাকি সময়ে ১২/ ১৩ হাজার মেগাওয়াট’ই উৎপাদন হয়। তাহলে বাড়তি অপচয়ের বিষয়ে আইএমএফ কেন দেখছে না?
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক এম এম আকাশ বলেন, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি একটি স্টেটেটিক পণ্য বা সেবা। তাই নোটিশের মাধ্যমে এই মূল্য বৃদ্ধি গ্রহণ যোগ্য নয়। এটা বিইআরসির গণশুনানির মাধ্যমে মাধ্যমে হবে, আর সেটাই কাম্য। কিন্তু নির্বাহী আদেশে বিইআরসির শক্তিকে খর্ব করে রাখা হয়েছে। এখন বিদ্যুৎ- জ্বালানীর দাম বাড়ছে নির্বাহী আদেশে। এর মাধ্যমে অধিকার হারাচ্ছে জনগণ।
এএলআরডির নির্বাহী পরিচালক সামসুল হুদা বলেন, পৃথিবীর কোন দেশ আইএমএফের শর্তে ঋণ নিয়ে উন্নতি করেছে, এমন নজির কোথাও নেই। আর এই বিষয়ে সরকারকে নজর রাখা দরকার। তাই তাদের শর্তের বেড়াজালে- দেশকে বিপদে ফেলবেন না। কারণ তাদের শর্ত জনগণের স্বার্থে নয়।
ক্যাবের সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, আইএমএফ বলেছে মূল্য বৃদ্ধির মাধ্যমে ভর্তুকি কমানোর। কিন্তু এটা যুক্তি সঙ্গত নয়। এটা সুবিচারও নয়। তাই আমরা আইএমএফকে বলবো- (দাম বাড়ানোর শর্ত না দিয়ে) কোথায় অসঙ্গতি আছে, সেটা খুঁজে বের করতে।
তিনি আরও বলেন, জ্বালানি খাতে সরকারের অনেক অর্জন রয়েছে। কিন্তু যথাসময়ে যথাযথ সিদ্ধান্ত নিতে সরকার ব্যর্থ হয়েছে বা অনিহা রয়েছে। ফলে তার দায়ভার নিতে হচ্ছে ভোক্তাকে। আইএমএফের পরামর্শে গ্যাস-বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধি না করে বরং জ্বালানি খাতের অপচয় রোধ ও সচ্ছতা নিশ্চিত করতে পারলে মূল্য বৃদ্ধি না করেই ভর্তুকি কমানো সম্ভব।
সংবাদ সম্মেলনে মূল্যবৃদ্ধি না করে ৩ বছরের মধ্যে ভর্তুকি শূন্যে নামিয়ে আনার লক্ষ্যে ক্যাবের পক্ষ থেকে ১৩ দফা দাবি তুলে ধরা হয়। তা হলো:
১. বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাত উন্নয়নে প্রতিযোগিতাবিহীন যেকোনো ধরনের বিনিয়োগ আইন দ্বারা নিষিদ্ধ হতে হবে।
২. জ্বালানি অধিকার সংরক্ষণ ও জ্বালানি সুবিচারের পরিপন্থি হওয়ায় (ক) দ্রুত বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সরবরাহ (বিশেষ বিধান) আইন ২০১০ রদ হতে হবে, এবং (খ) বাংলাদেশ রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) আইন ২০০৩ সংশোধনক্রমে সংযোজিত ধারা ৩৪ক রহিত হতে হবে। বিদ্যুৎ ও জ্বালানির মূল্যহার নির্ধারণের একক এখতিয়ার বিইআরসি’কে ফিরিয়ে দিতে হবে।
৩. গ্যাস উন্নয়ন তহবিল, বিদ্যুৎ উন্নয়ন তহবিল ও জ্বালানি নিরাপত্তা তহবিলের অর্থ যথাক্রমে বাপেক্সের গ্যাস অনুসন্ধান, পিডিবি’র বিদ্যুৎ উৎপাদন ও জ্বালানি আমদানিতে ঋণ নয়, ভোক্তার ইকুইটি বিনিয়োগ হিসেবে গণ্য হতে হবে।
৪. মুনাফা ব্যতীত কস্ট বেসিসে ৫০ শতাংশের অধিক বিদ্যুৎ ও গ্যাস উৎপাদন সরকারের একক মালিকানায় হতে হবে। কস্ট প্লাস নয়, সরকার শুধু কস্ট বেসিসে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সেবা দেবে।
৫. প্রাথমিক জ্বালানি মিশ্রে স্বল্প ও মধ্যমেয়াদি পরিকল্পনায় এলএনজি, কয়লা ও তেলের অনুপাত কমাতে হবে। নিজস্ব গ্যাস অনুসন্ধান ও মজুদ বৃদ্ধি এবং নবায়যোগ্য বিদ্যুৎ উৎপাদন দ্বারা বিদ্যুৎ ও জ্বালানি আমদানি নিয়ন্ত্রণে রেখে আমদানি ব্যয় কমাতে হবে।
৬. সরকার ব্যক্তিখাতের সঙ্গে যৌথ মালিকানায় বিদ্যুৎ ও জ্বালানি ব্যবসা-বাণিজ্যে জড়িত হবে না এবং সরকারি মালিকানাধীন কোনো কোম্পানির শেয়ার ব্যক্তি খাতে হস্তান্তর করবে না- আইন দ্বারা তা নিশ্চিত হতে হবে। দ্বিতীয় তেল-শোধনাগার এস আলম গ্রুপের সঙ্গে নয়, সরকারের একক মালিকানায় হতে হবে।
৭. বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতভুক্ত সরকারি ও যৌথ মালিকানাধীন সকল কোম্পানির পরিচালনা বোর্ড থেকে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি উভয় বিভাগের সকল আমলাদের প্রত্যাহার করতে হবে।
৮. নিজস্ব কারিগরি জনবল দ্বারা স্বাধীনভাবে উভয় খাতের কোম্পানি/সংস্থাসমূহের কার্যক্রম পরিচালিত হতে হবে। সে জন্য মন্ত্রণালয়কে শুধুমাত্র বিধি ও নীতি প্রণয়ন এবং আইন, বিধি-প্রবিধান অনুসরণ ও রেগুলেটরি আদেশসমূহ বাস্তবায়নে প্রশাসনিক নজরদারি ও লাইসেন্সিদের জবাবদিহি নিশ্চিত করার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকতে হবে। পাশাপাশি রেগুলেটর হিসেবে বিইআরসিকে সক্রিয়, স্বাধীন ও নিরপেক্ষ হতে হবে।
৯. জলবায়ু তহবিলসহ সংশ্লিষ্ট অন্যান্য উৎস থেকে ক্ষয়ক্ষতি বাবদ ঋণ নয়, ক্ষতিপূরণ প্রাপ্তি/আদায় নিশ্চিত হতে হবে এবং সে ক্ষতিপূরণ ক্ষতিগ্রস্তদের সক্ষমতা উন্নয়ন ও নবায়নযোগ্য জ্বালানির বাজার সম্প্রসারণে বিনিয়োগ আইন দ্বারা নিশ্চিত হতে হবে।
১০. বিদ্যুৎ, জীবাশ্ম ও নবায়নযোগ্য জ্বালানি উন্নয়ন নীতি, আইন, বিধি-বিধান ও পরিকল্পনা জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় সম্পাদিত প্যারিস চুক্তির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে হবে।
১১. বিদ্যুৎ ও জ্বালানি উন্নয়নে সম্পাদিত সকল চুক্তি বিধিবদ্ধ প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতার সঙ্গে সম্পাদনের লক্ষ্যে যথাযথ আইনি প্রক্রিয়ায় অনুমোদিত মডেল চুক্তি মতে হতে হবে, তাহলে আদানির বিদ্যুৎ ক্রয়চুক্তির মতো জনস্বার্থবিরোধী চুক্তি প্রতিরোধ করা যাবে।
১২. ইতোমধ্যে (ক) বাপেক্স ও সান্তোসের মধ্যে মগনামা-২ অনুসন্ধান কূপ খননে সম্পাদিত সম্পূরক চুক্তি, (খ) আরইবি ও সামিট পাওয়ার লি.-এর মধ্যে সম্পাদিত বিদ্যুৎ ক্রয় সম্পূরক চুক্তি, (গ) পিডিবি ও সামিট পাওয়ার লি.-এর মধ্যে সম্পাদিত মেঘনাঘাট পাওয়ার প্লান্টের বিদ্যুৎ ক্রয় সম্পূরক চুক্তি (ঘ) পিডিবি ও আদানির মধ্যে সম্পাদিত বিদ্যুৎ ক্রয়চুক্তি বেআইনি ও জনস্বার্থবিরোধী এবং জ্বালানি সুবিচারের পরিপন্থি প্রতীয়মান হওয়ায় এসব চুক্তি বাতিল হতে হবে। অনুরূপ অভিযোগে অভিযুক্ত অন্যান্য চুক্তিসমূহও যাচাই-বাছাইক্রমে বাতিল হতে হবে। সেই সাথে জ্বালানি সনদ চুক্তি ১৯৯৪ স্বাক্ষরে সরকারকে বিরত থাকতে হবে।
১৩. জ্বালানি নিরাপত্তা সুরক্ষার লক্ষ্যে বিদ্যুৎ ও জ্বালানির মূল্যহার বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণের জন্য ‘Energy Price Stabilized Fund’ গঠিত হতে হবে।
সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন সাধারণ সম্পাদক বীর মুক্তিযোদ্ধা এডভোকেট হুমায়ুন কবির ভূঁইয়া ও সাংগঠনিক সম্পাদক সৈয়দ মিজানুর রহমান রাজুসহ আরো অনেকে।