বিদ্যুতের দামবৃদ্ধি: দায় কার, ভুগছে কে?

শুভ কিবরিয়া: বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচ যেসব কারণে বাড়ছে, সেই অনিয়ম, দুর্নীতি, অদক্ষতা, অপচয়, ভুল পরিকল্পনা রোধ করে বিদ্যুতের উৎপাদন খরচ কমানোর দিকে সরকারের মনোযোগ নেই। বিদ্যুতের চাহিদা সরকার মেটাতে পারছে না। তার হাতে উৎপাদন সক্ষমতা আছে, কিন্তু তারপরও লোডশেডিং করতে হচ্ছে। এই গরমে গ্রামে এমন মাত্রায়ও লোডশেডিং করতে হয়েছে, যা সহনযোগ্য নয়।

সরকারের হাতে উৎপাদনের সামর্থ্য আছে, কিন্তু সরকার ভোক্তার চাহিদা মেটাতে পারছে না। শুধু তাই নয়, একদিকে যেমন সরকার চাহিদা মতো ভোক্তাকে মানসম্মত, নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ দিতে পারছে না, ব্যর্থ হচ্ছে উত্তম গ্রাহক সেবা দিতে, অন্যদিকে সরকার বিদ্যুতের দাম বাড়িয়েই চলেছে। বছরের পর বছর সরকার বলেছে, একসময় সরকার সবাইকে সাশ্রয়ী মূল্যে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ দেবে। কিন্তু বাস্তবে মানুষের অভিজ্ঞতা অন্যরকম।

কেন এ রকম হলো, কেন সরকার চাহিদা মতো মানুষকে বিদ্যুৎ দিতে ব্যর্থ হচ্ছে, কেন তাকে বার বার বিদ্যুতের দাম বাড়াতে হচ্ছে? এতবার বিদ্যুতের দাম বাড়াতে হয়েছে এবং হচ্ছে যে, সরকার এখন এইকাজে তার মুখের বয়ানও বদলে ফেলছে। বলছে, আমরা বিদ্যুতের দাম বাড়াচ্ছি না। বিদ্যুতের মূল্য সমন্বয় করছি।

একদিকে সরকার বিদ্যুতের ভর্তুকি ওঠানোর কথা বলছে, অন্যদিকে বারংবার বিদ্যুতের দাম বাড়াচ্ছে। তাহলে এতো উন্নয়ন, এতো চিৎকার, এতো উৎসব আয়োজনের পরেও বিদ্যুৎ খাত নিয়ে এভাবে জনগণকে চাপের মুখে ফেলছে কেন সরকার? সেইসব বিবেচনায় যাওয়ার আগে বিদ্যুৎ খাতের কিছু তথ্য ও পরিসংখ্যানে নজর বুলাতে পারি।

১. ২০২২-২৩ অর্থবছরে (৩০ জুন ২০২৩ পর্যন্ত) বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড যে বার্ষিক প্রতিবেদন তৈরি করেছে তাতে দেখা যাচ্ছে, এখন আমাদের বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষমতা হচ্ছে ২৪ হাজার ৯১১ মেগাওয়াট। আমরা সর্বোচ্চ উৎপাদন করে সরবরাহ করেছি ১৫ হাজার ৬৪৮ মেগাওয়াট। অর্থাৎ যেদিন এই সর্বোচ্চ উৎপাদন হয়েছে সেদিনও প্রায় ৯ হাজার ২৬৩ মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতার বিদ্যুৎকেন্দ্রকে বসিয়ে রাখতে হয়েছে।

উল্টোদিকে, এই হিসাব বলছে আমাদের যা দরকার তার চাইতে প্রায় ৩৮ শতাংশ বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা তৈরি করে আমরা বসে আছি। ফলে এই অব্যবহৃত বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতার যে খরচ, তার পরিচালনার জন্য যে খরচ, ওই বিদ্যুৎ সঞ্চালনের যে খরচ, সরবরাহের জন্য যে খরচ তার সবটার সরবরাহ-সেবা না পেয়েই ভোক্তাদের বহন করতে হচ্ছে।

লক্ষণীয়, যখন বিদ্যুতের দাম নির্ধারণ করা হয় তখন এসব আগাম উৎপাদন-পরিচালন-সরবরাহ সক্ষমতার হিসাব ধরেই বিদ্যুতের দাম ভোক্তার ঘাড়ে চাপানো হয়। ফলে ২০২২-২৩ অর্থবছরে ভোক্তারা বিদ্যুতের যে দাম দিয়েছে, তার মধ্যে এই অব্যবহৃত বিদ্যুতের বাড়তি মূল্যও তাদের বহন করতে হয়েছে।

২. এই যে ২০২২-২৩ অর্থবছরে পিডিবির হিসাব মতে সামর্থ্যের মাত্র ৬২ শতাংশ ব্যবহার করা হলো এবং বাকিটা অব্যবহৃত থাকল, সেটার জন্য বসিয়ে বসিয়ে অনেক বিদ্যুৎকেন্দ্রকে ক্যাপাসিটি চার্জ বা তার বসে থাকার খরচ বহন করতে হয়েছে ভোক্তাকে।

বিদ্যুৎকেন্দ্র উৎপাদন করুক বা না করুক, চুক্তি অনুসারে বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোকে যে ক্যাপাসিটি চার্জ দেওয়া হয়, তার যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন আছে বহুদিন ধরেই। তবুও এটা চলছেই। ২০২২–২৩ অর্থবছরে পিডিবি ২৬ হাজার কোটি টাকার বেশি খরচ করেছে বিদ্যুৎকেন্দ্রের ভাড়া পরিশোধে।

৩. বলা হচ্ছে, বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকি রাখা হবে না। বিশেষ করে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) চাপে সরকার এই ভর্তুকি উঠিয়ে দিচ্ছে। সরকার বিদ্যুতের দাম বাড়িয়ে ভর্তুকিকে ব্যাল্যান্স করতে চায়।

কথা হচ্ছে, ভর্তুকিই-বা দিতে হচ্ছে কেন? আসলে আমাদের বিদ্যুৎ উৎপাদনের যে খরচ, তারচেয়ে কম টাকায় বিদ্যুৎ বিক্রি করা হয়। ফলে একটা ঘাটতি বা লোকসান থাকে। সেটা মেটাতেই ভর্তুকি দেওয়া হয়। পিডিবির হিসাব মতে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে বিদ্যুৎ বিক্রি করে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) লোকসান হয়েছে ৪৩ হাজার ৫৩৯ কোটি টাকা। সরকারকে ওই অর্থবছরে ৩৯ হাজার ৫৩৪ কোটি টাকা ভর্তুকি বরাদ্দ রাখতে হয়।

৪. ২০২২-২৩ অর্থবছরে পিডিবির প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ কেনায় খরচ হয়েছিল ১১ টাকা ৩৩ পয়সা। উল্লেখ্য, পিডিবি নিজে বিদ্যুৎ উৎপাদন করে, আবার দেশের মধ্যে বেসরকারি উৎপাদকদের কাছ থেকে উৎপাদিত বিদ্যুৎ কেনে এবং ভারত থেকেও আমদানি করে। এই সব খাতের বিদ্যুৎ ক্রয়ের গড় হিসাবেই পিডিবির গত বছরের প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম পড়েছে ১১ টাকা ৩৩ পয়সা।

আর পিডিবি দেশের সব বিদ্যুৎ সরবরাহকারীর কাছে ওই বিদ্যুৎ পাইকারি হারে বিক্রি করেছে গড়ে প্রতি ইউনিট ৭ টাকা ৪ পয়সা করে। ফলে তার প্রতি ইউনিটে লোকসান হয়েছে, ৪ টাকা ২৯ পয়সা। সেই লোকসানই সে এখন উঠাতে চায় ভোক্তার বিদ্যুতের দাম উপর্যুপরি বাড়িয়ে। এই কাজে তাকে পরামর্শ ও চাপ দিচ্ছে আইএমএফ।

৫. এতদিন নিয়ম ছিল, বিদ্যুতের দাম বাড়াতে হলে প্রস্তাব নিয়ে যেতে হবে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনে (বিইআরসি)। সেখানে প্রস্তাবকারীরা প্রকাশ্যে গণশুনানিতে তাদের যুক্তি ও তথ্য উপস্থাপন করবেন। ভোক্তা, ব্যবসায়ী, সুধীজন এই দাম বাড়ানোর বিপক্ষে তাদের যুক্তি ও তথ্য দেবেন। সব পক্ষের যুক্তি শোনার পরে বিইআরসি তাদের কারিগরি কমিটির মূল্যায়ন সাপেক্ষে বিদ্যুতের দাম নির্ধারণ করবেন।

বিইআরসি আইনের যে ধারা বলে এই প্রক্রিয়ায় বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দাম নির্ধারণ করা হতো, সরকার সেই ধারাকে সংশোধন করে প্রয়োজনে দাম বাড়ানোর সব ক্ষমতা নিজের হাতে নিয়ে নেয়। এখন বিদ্যুৎ ও জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের একটি আদেশ বলেই সরকার যখন প্রয়োজন মনে করবে, যতবার প্রয়োজন মনে করবে, ততবার বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দাম বাড়াতে পারবে।

কেনার ক্ষেত্রে পণ্য বা সেবার দাম, মান ও মাপ সঠিক কি না, তা যাচাই-বাছাই করা ভোক্তার আইনি অধিকার। সংবিধানের ক্ষমতাবলে রাষ্ট্র আইন দ্বারা সেই অধিকার নিশ্চিত করেছে। বিদ্যুৎ ও জ্বালানির ক্ষেত্রে বিইআরসি আইন ২০০৩-এ তা নিশ্চিত করা হয়েছিল। কিন্তু ২০২৩ সালে ওই আইনের ৩৪ ধারা পরিবর্তন করে ভোক্তার সেই অধিকার খর্ব করেছে সরকার।

৩৪ ধারার বিধান মতে, ভোক্তা মূল্যবৃদ্ধির প্রস্তাবের ওপর অনুষ্ঠিত গণশুনানিতে অংশগ্রহণ করতে পারতো। মূল্যবৃদ্ধি ন্যায্য ও যৌক্তিক কি না, সে ব্যাপারে মতামত দিতে পারতো। সেই মতামত ন্যায্য ও যৌক্তিক না হলে প্রতিকারের জন্য আদালতের শরণাপন্ন হতে পারতো। কিন্তু ওই ধারা পরিবর্তনের ফলে ভোক্তার সেই অধিকার খর্ব হয়েছে এবং সরকার বা মন্ত্রণালয় ইচ্ছামতো বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর আইনি সুযোগ গ্রহণ করেছে।

৬. শুধু বিইআরসির আইন-ই নয়, সরকার বিদ্যুৎ ও জ্বালানি দ্রুত সরবরাহ (বিশেষ বিধান) আইন ২০১০ তৈরি করেছে। এই আইনের আওতায় প্রতিযোগিতাবিহীন, টেন্ডারবিহীনভাবে ব্যক্তিখাত বিনিয়োগে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত উন্নয়ন অব্যাহত আছে। তাতে বিনিয়োগকারীরা খেয়াল-খুশি মতো বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সরবরাহ ব্যয় বৃদ্ধি করে অন্যায্য মুনাফা বৃদ্ধির সুযোগ নিচ্ছে।

ফলে আর্থিক ঘাটতি দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। সেটা সমন্বয়ের জন্য মূল্য ও ভর্তুকি উভয় বৃদ্ধি পাচ্ছে। ঘাটতি নিয়ন্ত্রণে আনা যাচ্ছে না। ভোক্তা অধিকার নিয়ে যারা কাজ করেন, তারা একে লুণ্ঠনমূলক ব্যয় ও লুণ্ঠনমূলক মুনাফা নামে অভিহিত করেছেন।

৭. গত দেড় দশকে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি দ্রুত সরবরাহ (বিশেষ বিধান) আইন ২০১০-এর আওতায় বিদ্যুৎ খাতে অনেক নীতিগত ও ব্যবহারিক পরিবর্তন এসেছে। ফলে, আমাদের বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যক্তিখাতের অংশ বিপুল পরিমাণে বেড়েছে। বিদ্যুৎ আমদানির ব্যবস্থা চালু হয়েছে।

পিডিবির ২০২২-২৩ সালের বার্ষিক প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে, যে মূল্যে দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে, আমদানি করতে তারচেয়ে কম মূল্য দিতে হচ্ছে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে পিডিবির প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ কিনতে খরচ হয়েছিল ১১ টাকা ৩৩ পয়সা। সেসময় ভারত থেকে আমদানিকৃত প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের খরচ পড়েছে ৮ টাকা ৭৭ পয়সা। এই ধারা চলতে থাকলে, দেশের বিদ্যুৎ খাত বড় আমদানির বাজারে পরিণত হয়ে যেতে পারে।

দুই.
ভোক্তারা মানসম্পন্ন, সাশ্রয়ী মূল্যে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ যখন পাচ্ছে না, তখন সরকার ঢাকা সফররত আইএমএফ প্রতিনিধিদলকে জানিয়েছে, ভর্তুকির চাপ সামলাতে বছরে চারবার মূল্য সমন্বয় করে বিদ্যুতের দাম বাড়াবে। আগামী তিন বছর এই প্রক্রিয়ায় মোট ১২ দফায় বিদ্যুতের দাম নিয়ে আসা হবে উৎপাদন খরচের কাছাকাছি।

প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের পাইকারি দাম এখন গড়ে ৭ টাকা ৪ পয়সা। আইএমএফের পরামর্শ মেনে ভর্তুকি প্রত্যাহার করা হলে এ দর ১২ টাকার ওপরে চলে যাবে। সে ক্ষেত্রে ভোক্তা পর্যায়ে গড়ে বিদ্যুতের দাম হবে প্রায় ১৫ টাকা, যা এখন ৮ টাকা ৯৫ পয়সা।

বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচ যেসব কারণে বাড়ছে, সেই অনিয়ম, দুর্নীতি, অদক্ষতা, অপচয়, ভুল পরিকল্পনা রোধ করে বিদ্যুতের উৎপাদন খরচ কমানোর দিকে সরকারের মনোযোগ নেই। চাহিদা না থাকলেও দরপত্র ছাড়া একের পর এক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করে এ খাতের খরচ আরও বাড়ানো হচ্ছে, সেই প্রক্রিয়াকে রোধ করার কোনো চেষ্টাও সরকারের নেই।

কার দায় কার ওপর চাপাচ্ছে সরকার, সেটাও বিবেচনায় নেওয়ার ইচ্ছে তাদের নেই। বিদ্যুতের দাম বাড়লে প্রতিটি জিনিসের মূল্যে যে প্রভাব পড়ে, জনজীবনে যে চাপ পড়ে, রপ্তানিযোগ্য পণ্য যে প্রতিযোগিতা থেকে ছিটকে পড়ে- সেসব বিপদকেও গায়ে মাখতে নারাজ সরকার। তারা এখন আইএমএফের তৃতীয় কিস্তির ৭০ কোটি ডলার পাওয়ার বিবেচনাকেই সর্বোচ্চ প্রাধান্য দিয়েছে।

সিনিয়র সাংবাদিক, তড়িৎ প্রকৌশলী।

সৌজন্যে, ডেইলি স্টার বাংলা।