ভোক্তাকণ্ঠ ডেস্ক: ঢাকা সফরে আসা আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) প্রতিনিধিদলকে বিদ্যুৎ বিভাগ জানিয়েছে, বছরে প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকার ভর্তুকির চাপ সামলাতে বছরে চার বার বিদ্যুতের মূল্য সমন্বয় করবে সরকার। এভাবে আগামী তিন বছরে মোট ১২ দফায় বিদ্যুতের দাম উৎপাদন খরচের সমান বা কাছাকাছি পর্যায়ে নিয়ে আসা হবে।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞদের অভিমত, দাম সমন্বয়ের নামে ভর্তুকি কমানোর অর্থ হলো বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি। এর আগেও গত বছরের জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত তিন মাসে তিন দফায় বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছিল। কিন্তু বাড়তি দাম দিয়েও নিরবচ্ছিন্নভাবে গ্যাস ও বিদ্যুৎ না পাওয়ায় মানুষের ভোগান্তি ও ব্যবসার খরচ বেড়ে গেছে।
এ অবস্থায় প্রশ্ন ওঠে- বছরে কয়েক দফায় বিদ্যুতের দাম বাড়লে তার আর্থ-সামাজিক অভিঘাত ঠিক কেমন হবে?
বিষয়টি নিয়ে দ্য ডেইলি স্টার কথা বলেছে জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক এম শামসুল আলম ও অধ্যাপক ম. তামিমের সঙ্গে।
তারা বলছেন, গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির মানে নিত্যপণ্যের দাম বেড়ে যাওয়া। এর আগেও বিদ্যুৎসহ জ্বালানি তেলের দাম একলাফে ৫১ শতাংশ বেড়েছে। এমনিতেই উচ্চমূল্যস্ফীতির চাপে আছে সাধারণ মানুষ। এমন পরিস্থিতিতে বছরে যদি কয়েকবার বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয় তাহলে সেই চাপ ভোক্তারা নিতে পারবে না। অথচ দাম না বাড়িয়েও বিদ্যুত খাতের অনিয়ম-অপচয় রোধ করে উৎপাদন খরচ কমিয়ে আনার মাধ্যমে ভর্তুকি কমানো কিংবা সমন্বয় সম্ভব।
অধ্যাপক শামসুল আলমের ভাষায়, বিদ্যমান প্রেক্ষাপটে বিদ্যুতের দাম সমন্বয় করে ভর্তুকির চাপ কমানো ‘অবাস্তব’ একটি বিষয়। তিনি বলেন, ‘সরকার এটা (ভর্তুকির চাপ কমাতে মূল্য সমন্বয়) করতে পারবে না। এটা অবাস্তব। এখানে (বিদ্যুৎ খাতে) প্রকৃত ব্যয় অপেক্ষা অতিরিক্ত ব্যয়; আমরা যেটাকে লুণ্ঠনমূলক ব্যয় বলছি, সেটা অনেক বেশি। এটি নিয়ে সামাজিক প্রতিবাদ তৈরি হয়েছে। তাই দাম বাড়ানোর প্রক্রিয়া ওই লুণ্ঠনকারীদের সুরক্ষা দেওয়ার নামান্তর বলে আমি মনে করি।’
মূল্য সমন্বয়ের নামে দফায় দফায় বিদ্যুতের দাম বাড়ালে জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে দরিদ্র মানুষের সংখ্যাও বেড়ে যাবে বলে মন্তব্য করেন এই জ্বালানি বিশেষজ্ঞ। বলেন, ‘মানুষ অভাবগ্রস্ত হয়ে গেছে। এটা বাড়তে থাকবে। সরকারের রাজস্বও কমতে থাকবে।’
তিন বছরের জন্য আমরা যে পরিকল্পনা দিয়েছি, ১৩ দফা দাবি জানিয়েছি, সংস্কার প্রস্তাব দিয়েছি তাতে ভর্তুকি শূণ্যের কোঠায় আনা যাবে মূল্যবৃদ্ধি না করেই। তারা (সরকার) মূল্যবৃদ্ধি করে ভর্তুকি কমাবে। আর আমরা সেটা না করে কমাবো। আমরা এই চ্যালেঞ্জটা গ্রহণ করতে চাই। এটা প্রমাণ করতে চাই।
অধ্যাপক শামসুল আলম ভোক্তার অধিকার নিয়ে কাজ সংগঠন কনজুমারস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানি উপদেষ্টা। গত বৃহস্পতিবার বিদ্যুতের মূল্য সমন্বয়ের খবর আসার পর ক্যাবের পক্ষ থেকে তাৎক্ষণিক ভাবে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে একটি সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়।
‘অসাধু বিদ্যুৎ ও জ্বালানি ব্যবসা সুরক্ষায় মূল্যবৃদ্ধি নয়; জ্বালানির সুবিচার চাই’ শীর্ষক ওই সংবাদ সম্মেলনে মূল্যবৃদ্ধির বিকল্প হিসেবে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত সংস্কারে ১৩টি দাবি তুলে ধরে ক্যাব। বলা হয়, ভর্তুকি সমন্বয়ের দুটি উপায় আছে। এর একটি খরচ কমানো। অন্যটি মূল্যবৃদ্ধি। কিন্তু আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) ও সরকার চায় মূল্যবৃদ্ধি। অনিয়ম, অপচয়, দুর্নীতি কার্পেটের নিচে রেখে মূল্যবৃদ্ধি ভোক্তার প্রতি সুবিচার নয়।
ওই সংবাদ সম্মেলনের প্রসঙ্গ উল্লেখ করে শামসুল আলম বলেন, ‘তিন বছরের জন্য আমরা যে পরিকল্পনা দিয়েছি, ১৩ দফা দাবি জানিয়েছি, সংস্কার প্রস্তাব দিয়েছি তাতে ভর্তুকি শূণ্যের কোঠায় আনা যাবে মূল্যবৃদ্ধি না করেই। তারা (সরকার) মূল্যবৃদ্ধি করে ভর্তুকি কমাবে। আর আমরা সেটা না করে কমাবো। আমরা এই চ্যালেঞ্জটা গ্রহণ করতে চাই। এটা প্রমাণ করতে চাই।’
আইএমএফ ২০২৩ সালের ৩০ জানুয়ারি বাংলাদেশের জন্য ৪৭০ কোটি ডলারের ঋণ কর্মসূচি অনুমোদন করে। ঋণপ্রাপ্তির অন্য অনেক শর্তের মধ্যে বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকি কমিয়ে আনা, জ্বালানি তেলের দাম সমন্বয়ে আন্তর্জাতিক রীতিনীতি অনুসরণ করা অন্যতম।
ঋণ কর্মসূচি শুরুর পর দুই কিস্তিতে ১০০ কোটি ডলারের বেশি বাংলাদেশ পেয়েছে। তৃতীয় কিস্তিতে ৭০ কোটি ডলার পাওয়ার কথা চলতি মে মাসে। আইএমএফের বর্তমান দলটি ২৪ এপ্রিল থেকে সরকারের বিভিন্ন দপ্তরের সঙ্গে আলোচনা করছে। এর অংশ হিসেবে তারা বিদ্যুৎ বিভাগের সঙ্গে আলোচনায় অংশ নেয়।
তিন মাস অন্তর বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির পরিকল্পনার বিষয়ে অধ্যাপক ম. তামিমের বক্তব্য হলো, ‘গত বছর (বিদ্যুতের ইউনিটপ্রতি) যে উৎপাদন খরচ হয়েছে সাড়ে ১১ টাকার মতো, সেটা অস্বাভাবিক ভাবে বেশি ছিল। এর আগের বছর একই খরচ সাড়ে পাঁচ টাকা কিংবা ছয় টাকার মধ্যে ছিল। চলতি বছরের প্রথম তিন মাসেও এটা নয় টাকার নিচে নেমে এসেছে। এখন আমরা প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ গ্রাহকের কাছে বিক্রি করছি গড়ে আট টাকা করে।
‘আমার কথা হচ্ছে আমরা ভর্তুকি কমাতে পারি কিংবা পুরোপুরি উঠিয়ে দিতে পারি দাম বৃদ্ধি করে কিংবা উৎপাদন খরচ কমিয়ে। এক্ষেত্রে অবশ্যই সরকারের লক্ষ্য হওয়া উচিত উৎপাদন খরচ কমানো। সেটার জন্য যা করণীয় সেটা করতে হবে। সরকার সেটা সঠিকভাবে করছে কিনা এটা কিন্তু এখন আমরা জানি না।’
এই অধ্যাপকের ভাষ্য, ‘সরকার কীভাবে বিদ্যুতের দাম নির্ধারণ করছে, কোন কোন বিদ্যুৎকেন্দ্র চলছে কিংবা কোনগুলো চলছে না অর্থাৎ এই খাতের পুরো অপারেশনাল বিষয়টা নিয়ে মানুষ অন্ধকারে আছে। তিনি বলেন, ‘বিইআরসির (বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন) মাধ্যমে যখন দাম নির্ধারণ করা হতো, তখন এই জিনিসগুলো সামনে উঠে আসত। ইউলিটি কোম্পানিগুলোর অদক্ষতা থাকলে, সার্বিক ভাবে সিস্টেম পরিচালনার ক্ষেত্রে কোনো রকমের অনিয়ম থাকলে সেগুলো শুনানির ভেতর দিয়ে উঠে আসত। প্রতিটা খরচের জায়গা সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যেত। তখন খরচ কমানোর একটা তাগাদা দেওয়া যেত। কমিশনের সেখানে একটা জোরালো ভূমিকা থাকত। এখন যেহেতু সরকার একক ভাবে দাম নির্ধারণ করছে, সেখানে এটা আর কাজে আসছে না।’
আমরা যদি শুধু যথেচ্ছ ভাবে দাম বৃদ্ধি করি এবং ভর্তুকি কমানোর জন্য বিদ্যুতের দাম মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে নিয়ে যাই তাহলে মানুষের বিদ্যুৎ ব্যবহার কমে যাবে এবং চুরি বাড়বে।
এখন প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের পাইকারি দাম গড়ে ৭ টাকা ৪ পয়সা। তবে আইএমএফের পরামর্শ মেনে ভর্তুকি প্রত্যাহার করা হলে এ দর ১২ টাকার ওপরে নিয়ে যেতে হবে। সে ক্ষেত্রে ভোক্তাপর্যায়ে গড়ে বিদ্যুতের দাম হবে প্রায় ১৫ টাকা, যা এখন ৮ টাকা ৯৫ পয়সা।
ম. তামিমের অভিমত, ‘আমি মনে করি জনগণের ওপর চাপ কমাতে হলে দাম বৃদ্ধি না করে উৎপাদন খরচ কমানোর ওপর মনোযোগ দেওয়া উচিত। সরকার যদি মনোযোগ দেয় তাহলে এটা কমানো সম্ভব।’
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার জ্বালানিবিষয়ক বিশেষ এই সহকারী আরও বলেন, ‘বিদ্যুৎ খাতে সম্পূর্ণ ভর্তুকি উঠিয়ে দেওয়াটাও ঠিক হবে না। বিশেষ করে কৃষিতে ভর্তুকি দিতে হবে, প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য একটা ভর্তুকি দিতে হবে।’
উৎপাদন খরচ কীভাবে কমিয়ে আনা সম্ভব- জানতে চাইলে ম. তামিম বলেন, ‘এখন তো কয়লাভিত্তিক বিদ্যুতের দাম কমে গেছে। উৎপাদন খরচ ১০ টাকায় নেমে এসেছে। যা আগের চাইতে অনেক কম। আগে ১৭-১৮ টাকা হয়ে গিয়েছিল। তার মানে আমাদের সর্বনিম্ন উৎপাদন খরচের বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো সর্বোচ্চ সময় চালাতে হবে। বেশি ব্যয়বহুল কেন্দ্রগুলো কম সময় পরিচালনা করতে হবে।’
এর পাশাপাশি ‘ক্যাপাসিটি পেমেন্টের যে চুক্তিগুলো আছে সেগুলোকে এনার্জি কস্টিংয়ে চলে আসতে হবে’ মন্তব্য করে তিনি আরও বলেন, ‘অর্থাৎ নো ইলেকট্রিসিটি, নো পেমেন্টে সবগুলোকে কনভার্ট করতে হবে। কিছু কনভার্ট হয়েছে। কিন্তু এখনো আমাদের ক্যাপাসিটি পেমেন্ট অনেক হাই। ভর্তুকির একটা বড় অংশ ক্যাপাসিটি পেমেন্টে যাচ্ছে।’
বিদ্যুৎ বিভাগের তথ্য অনুসারে, গত বছরও ৪১ শতাংশ বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা অলস বসে ছিল। তার মানে অলস বসিয়ে রেখে কেন্দ্র ভাড়া দেওয়া হয়েছে।
এভাবে উৎপাদন খরচ কমিয়ে আনতে পারলে জনগণের ওপর থেকে চাপটাও কমে যাবে বলে মনে করেন ম. তামিম। বলেন, ‘কিন্তু আমরা যদি শুধু যথেচ্ছভাবে দাম বৃদ্ধি করি এবং ভর্তুকি কমানোর জন্য বিদ্যুতের দাম মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে নিয়ে যাই তাহলে মানুষের বিদ্যুৎ ব্যবহার কমে যাবে এবং চুরি বাড়বে। যে অতি উচ্চমূল্যে বিদ্যুৎ কিনতে পারবে না কিন্তু বিদ্যুৎ ব্যবহারে যে অভ্যস্ত হয়ে গেছে, তার মধ্যে বিদ্যুৎ চুরি করার একটা প্রবণতা তৈরি হবে স্বাভাবিকভাবেই। কারণ বিদ্যুৎ তো এখন প্রায় মৌলিক চাহিদার একটা অংশ হয়ে গেছে।’
২০২২-২৩ অর্থবছরে বিদ্যুৎ বিক্রি করে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) লোকসান হয়েছে ৪৩ হাজার ৫৩৯ কোটি টাকা। সরকারকে ওই অর্থবছরে ৩৯ হাজার ৫৩৪ কোটি টাকা ভর্তুকি বরাদ্দ রাখতে হয়।