বকেয়া পড়ায় সরবরাহ সীমিত করেছে ভারত, আশা যোগাচ্ছে নেপালের বিদ্যুৎ

ভোক্তাকণ্ঠ ডেস্ক: ভারত থেকে সরকারি ভাবে এক হাজার ১৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানি করে বাংলাদেশ। এর মধ্যে পশ্চিমবঙ্গ দিয়ে এক হাজার মেগাওয়াট এবং ত্রিপুরা দিয়ে ১৬০ মেগাওয়াট আমদানি করা হয়। ত্রিপুরা স্টেট ইলেকট্রিসিটি কর্পোরেশন লিমিটেডের (টিএসইসিএল) কাছ থেকে এ বিদ্যুৎ কেনে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বিপিডিবি)। কিন্তু টিএসইসিএলের কাছে ১০০ কোটি রুপি বকেয়া থাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ সীমিত করে দিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।

ভারতীয় সংবাদ সংস্থা এএনআইকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে টিএসইসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) দেবাশীষ সরকার জানিয়েছেন, আর্থিক ভাবে সমস্যায় থাকায় বিপিডিবি বিলটি পরিশোধ করতে পারছে না।

ভারতের কাছে বিদ্যুতের ১০০ কোটি রুপির বিল বকেয়ার মধ্যেই নেপাল থেকে ৬৫০ কোটি টাকার জলবিদ্যুৎ আমদানির বিষয়টি চূড়ান্ত করেছে সরকার। আগামী পাঁচ বছর দেশটি থেকে বিদ্যুৎ কিনবে বিপিডিবি। গত মাসে সংস্থাটির বোর্ড সভায় বিদ্যুতের দর-সংক্রান্ত প্রস্তাবটি চূড়ান্ত করা হয়। বিদ্যুৎ ক্রয়ের এ প্রস্তাব সরকারি ক্রয়-সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটিতে উপস্থাপনের জন্য মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পাঠিয়েছে বিদ্যুৎ বিভাগ।

বর্তমানে দেশে আমদানি করা বিদ্যুতের পুরোটাই আসছে ভারত থেকে। এর মধ্যে দেশটির সঙ্গে সরকারি বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তি রয়েছে এক হাজার ১৬০ মেগাওয়াট আর বেসরকারি বিদ্যুৎ কেন্দ্র আদানির ঝাড়খণ্ড বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ আসছে এক হাজার ৪৯৬ মেগাওয়াট।

তবে বিদ্যুৎ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, চলতি বছরের জানুয়ারি পর্যন্ত জিটুজি চুক্তির আওতায় ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানির বিল বকেয়া ছিল এক হাজার ৯০০ কোটি টাকার বেশি। আর ঝাড়খণ্ডে আদানি গ্রুপের বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে কেনা বিদ্যুতের বিল বকেয়া পড়েছে চার হাজার ১৪০ কোটি টাকা।

টিএসইসিএল জানিয়েছে, ত্রিপুরা থেকে ১৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সরবরাহের চুক্তি অনুসারে বর্তমানে সংস্থাটি ১০০ থেকে ১১০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সরবরাহ করছে। সংস্থাটির প্রধান বলছেন, এখন পর্যন্ত তারা জানুয়ারি মাসের বিল পেয়েছেন। এরপরও তিন থেকে চার মাসের বিল বকেয়া রয়েছে। যা সংস্থাটির আর্থিক অবস্থায় প্রভাব ফেলছে। এ কারণে বাংলাদেশে বিদ্যুৎ সরবরাহ সীমিত করে দেওয়া হয়েছে।

অন্যদিকে, নেপাল থেকে বিদ্যুৎ আমদানির আলোচনাটি বেশ পুরোনো। ২০১৪ সালে বাংলাদেশ ও নেপাল বিদ্যুৎ খাতে সহযোগিতার লক্ষ্যে একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করে। ওই সমঝোতার আওতায় দুই দেশের মধ্যে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে বিদ্যুৎ আমদানির বিষয়ে আলোচনা হয়। এমনকি নেপালে জলবিদ্যুৎ প্রকল্পে বাংলাদেশের বিনিয়োগের বিষয়টিও উঠে আসে। তবে, এক দশক ধরে এসব আলোচনা চললেও তার বাস্তবায়ন এত দিনে হয়নি।

গত ৩১ জানুয়ারি সচিবালয়ে বাংলাদেশে নেপালের রাষ্ট্রদূত ঘনশ্যাম ভান্ডারীর সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাতে নেপাল থেকে জলবিদ্যুৎ আমদানির অগ্রগতির বিষয়টি জানান বিদ্যুৎ জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ। তিনি বলেন, নেপাল থেকে ভারত হয়ে ৪০ মেগাওয়াট জলবিদ্যুৎ আমদানির সব প্রক্রিয়া প্রায় শেষ পর্যায়ে। আরও ৫০০ মেগাওয়াট জলবিদ্যুৎ আমদানির বিষয়টির অগ্রগতি দৃশ্যমান।

নেপাল থেকে বাংলাদেশে বিদ্যুৎ আমদানি শুরু হলে দেশে মোট আমদানি বিদ্যুতের পরিমাণ দাঁড়াবে প্রায় দুই হাজার ৭০০ মেগাওয়াট। যা বাংলাদেশের গ্রিডভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতার প্রায় ১১ শতাংশ।

ত্রি-পক্ষীয় চুক্তির মাধ্যমে নেপালের এ ৪০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ দেশে আসবে। দেশটির সঙ্গে বাংলাদেশের সরাসরি সীমান্ত না থাকায় এক্ষেত্রে ভারতীয় সঞ্চালন লাইন ব্যবহার করা হবে। কুষ্টিয়ার ভেড়ামারার এইচভিডিসি স্টেশন (সাব-স্টেশন) ব্যবহার করে এ বিদ্যুৎ আসবে দেশে। এ ক্ষেত্রে ট্রেডিং মার্জিন ও সঞ্চালন চার্জ দিতে হবে প্রতিবেশী দেশটিকে।

বিদ্যুৎ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, নেপাল থেকে বিদ্যুৎ আমদানিতে বিদ্যুতের দাম ধরা হয়েছে প্রতি কিলোওয়াট ঘণ্টা ৬ দশমিক ৪০ ইউএস সেন্ট। আর সঞ্চালন লাইন ব্যবহারের জন্য এনভিভিএন (এনটিপিসি বিদ্যুৎ ভ্যাপর নিগম) ট্রেডিং মার্জিন দশমিক শূন্য ৫৯৫ ভারতীয় রুপি (প্রতি কিলোওয়াট)। এর সঙ্গে সঞ্চালন চার্জ যুক্ত হবে। প্রতি কিলোওয়াট সঞ্চালন চার্জ কত হবে সেটি বিপিডিবির কাগজপত্রে উল্লেখ না থাকলেও ভারতীয় সেন্ট্রাল ইলেকট্রিসিটি রেগুলেটরি অথরিটির হিসাব অনুযায়ী এ চার্জ যুক্ত হবে।

তবে, প্রশ্ন উঠছে পিডিবি’র এমন আর্থিক দুরবস্থার মধ্যে নেপাল থেকে বিদ্যুৎ আমদানি কতটুকু যুক্তিযুক্ত হবে। সাধারণত উচ্চ দামে বিদ্যুৎ কিনে কম দামে বিক্রি করে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড। এতে প্রতি মাসে সংস্থাটির ঘাটতি থাকছে গড়ে তিন হাজার ৬০০ কোটি টাকার বেশি। এ ঘাটতি মেটাতে প্রতি মাসে প্রচুর ভর্তুকি দরকার হয়। তবে, ভর্তুকি নিয়মিত ছাড় করছে না অর্থ মন্ত্রণালয়। এতে সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন বিদ্যুৎ কেন্দ্রের বিল পরিশোধ করতে পারছে না প্রতিষ্ঠানটি। সবমিলিয়ে গত জানুয়ারি পর্যন্ত পিডিবি’র কাছে বিভিন্ন সংস্থার পাওনা দাঁড়িয়েছে ৪১ হাজার কোটি টাকার বেশি।

পিডিবি’র প্রতি মাসে গড় বিল পরিশোধ করতে হয় আট হাজার ৭০০ কোটি থেকে আট হাজার ৮০০ কোটি টাকা। তবে, এ খাতে গড়ে রাজস্ব আয় পাঁচ হাজার ১০০ কোটি থেকে পাঁচ হাজার ২০০ কোটি টাকা। অর্থাৎ প্রতি মাসে ঘাটতি থাকছে তিন হাজার ৬০০ কোটি টাকা। এরই মধ্যে ১০ হাজার ৫৯৯ কোটি টাকা বন্ড ইস্যু করা হয়েছে। এরপরও অর্থ মন্ত্রণালয়ের কাছে প্রাপ্য ভর্তুকির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩৫ হাজার ৯১২ কোটি টাকা।

যদিও গত অর্থবছরের জন্য অর্থ মন্ত্রণালয় ২৯ হাজার ৫১০ কোটি ৬৯ লাখ টাকা ভর্তুকি এরই মধ্যে প্রদান করেছে। তবে, এখনও প্রাপ্য ভর্তুকির মধ্যে গত অর্থবছরের ফেব্রুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত আংশিক বকেয়া রয়েছে, যার পরিমাণ ১৪ হাজার নয় কোটি টাকা। আর চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত প্রাপ্য ভর্তুকির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২১ হাজার ৯০৩ কোটি টাকা।

আর্থিক এ অবস্থার মধ্যেও আমদানির পরিমাণ আরও বাড়াচ্ছে পিডিবি। নতুন এ চাপ সামলানো সম্ভব কি না— এমন প্রশ্নে বিপিডিবির কেউ কথা বলতে রাজি হননি।

তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আর্থিক সমস্যা কাটিয়ে উঠতে পারলে নেপালের জলবিদ্যুৎ আমদানি একটি ইতিবাচক দিক হয়ে উঠতে পারে।

জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ড. ইজাজ হোসেন বলেন, পিডিবি যে আর্থিক সমস্যার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, সেটা একটা সময় পর কাটিয়ে ওঠা যাবে বলে আশা করা যাচ্ছে। আমরা বরাবরই বলছি, কয়লাভিত্তিক ও আমদানি নির্ভরতা থেকে বেরিয়ে আসার জন্য। এখন ভারতের সঙ্গে যেহেতু চুক্তিভিত্তিক বিদ্যুৎ আমদানির প্রক্রিয়া চলছে, সুতরাং বকেয়া পরিশোধের বিষয়টি জরুরি।

তবে, নেপালের বিদ্যুৎ নবায়নযোগ্য জ্বালানির মধ্যে পড়ছে। ব্যাপারটা ইতিবাচক। পিডিবির উচিত পুরো ব্যাপারটাকে একটা সামঞ্জস্যপূর্ণ অবস্থায় নিয়ে আসা- বলেন এ জ্বালানি বিশেষজ্ঞ। ঢাকা পোস্ট।