ভোক্তাকণ্ঠ ডেস্ক: রাজধানীর মোহাম্মদপুরের বাসিন্দা গৃহিনী খাদিজা ইসলাম দুই চুলায় রান্না করেন। বছরের বড় একটি সময় গ্যাসের চাপ থাকে না। সম্প্রতি এ সমস্যা আরও বেড়েছে। ফলে প্রতিদিনই রান্না করার জন্য রীতিমতো যুদ্ধ করতে হচ্ছে তাকে। ত্যক্ত-বিরক্ত খাদিজা শেষ পর্যন্ত বলেই বসলেন, আর পারছি না, এ ভোগান্তি আর কত দিন?
শুধু খাদিজা ইসলামই নন, বতর্মানে রাজধানীর অধিকাংশ গৃহিনীর অভিজ্ঞতা একই রকম। দিনের বড় একটি সময় রাজধানীর বাসা-বাড়িতে গ্যাস থাকছে না। এ সমস্যাটা সকাল থেকে সন্ধ্যা রাত পর্যন্ত থাকে। গভীর রাতে গ্যাসের চাপ স্বাভাবিক হয়।
খাদিজা ইসলাম বলেন, দিনের যে সময় চুলায় গ্যাসের দরকার পড়ে সে সময়েই গ্যাস থাকে না। সকাল ও দুপুরের খাবার রান্না করতে খুবই কষ্ট হচ্ছে। রাতের দিকে একটু গ্যাস আসে। তাই দিয়ে কোনোমতে রান্না করে নিই। কিন্তু এভাবে কয়দিন চলবে সেটাই ভাবছি।
কল্যাণপুরের বাসিন্দা বেসরকারি চাকরিজীবী সুলতানা করিম। প্রতিদিনই অফিস যাওয়ার আগে পরিবারের জন্য খাবার তৈরি করেন তিনি। কিন্তু গ্যাস সংকটের কারণে খাবার রান্না করতে তাকে বেগ পোহাতে হচ্ছে।
সুলতানা বলেন, সাধারণত সকালে অফিস যাওয়ার আগে সকাল ও দুপুরের খাবার এক সঙ্গে তৈরি করে যাই। কিন্তু এখন চুলায় একেবারেই গ্যাস থাকছে না। ফলে রান্না করতে খুব সমস্যা হচ্ছে। এমনও হয়েছে যে বাইরে থেকে খাবার কিনে আনতে হয়েছে।
ব্যবহার করতে হচ্ছে সিলিন্ডার, বাড়ছে খরচ
বর্তমানে বাসা-বাড়িতে পাইপলাইনের গ্যাসের একটি চুলা ব্যবহারের খরচ ৯৯০ টাকা ও দুইটি চুলা ব্যবহারের খরচ ১ হাজার ৮০ টাকা। চুলায় গ্যাস থাকুক বা না থাকুক, প্রতিমাসেই বিল পরিশোধ করতে হয়। কিন্তু পাইপলাইনে প্রায় সময় গ্যাস না থাকার ফলে বাধ্য হয়ে ব্যবহার করতে হচ্ছে এলপি গ্যাস সিলিন্ডার, যা বাড়িয়ে দিচ্ছে খরচ।
ভোক্তাপর্যায়ে প্রতি মাসে এলপি গ্যাসের দাম নির্ধারণ করে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)। চলতি মাসে ১২ কেজি এলপিজির দাম নির্ধারণ করা হয়েছে ১ হাজার ৩৬৬ টাকা। বছরজুড়ে পণ্যটির দাম এর আশেপাশেই ঘোরাফেরা করে। যদিও গ্রাহকদের কাছ থেকে গড়ে ১৫০০ টাকা করেই নেন স্থানীয় ব্যবসায়ীরা।
বাসা-বাড়িতে সবচেয়ে বেশি ১২ কেজি সিলিন্ডারের গ্যাস ব্যবহার করা হয়। ফলে সিলিন্ডারের দাম ও পাইপলাইন গ্যাসের বিল মিলিয়ে হিসেবের অঙ্কটা থাকে আড়াই হাজার টাকার কাছাকাছি।
গ্রাহকরা বলছেন, এমনিতেই বাজারে সব জিনিসের দাম বাড়তি। সেই তুলনায় আয় রোজগার বাড়েনি। মাসের শুরুতেই বেতনের টাকা শেষ হয়ে যায়। এ অবস্থায় লাইনের গ্যাস রেখে সিলিন্ডার ব্যবহার করায় বাড়তি চাপ পড়ছে পাইপলাইনের গ্যাসের সরবরাহ ঠিক থাকলে সিলিন্ডারের বাড়তি খরচের বোঝা টানতে হতো না তাদের।
ধানমন্ডির বাসিন্দা আফরোজা আক্তার বলেন, প্রতিমাসে গ্যাসের বিল দিতে হয়, কিন্তু গ্যাস থাকে না। দিনের যে সময়টায় আমাদের গ্যাস দরকার তখনই পাওয়া যায় না। না খেয়ে তো আর থাকা যাবে না, তাই বাধ্য হয়ে সিলিন্ডার কিনে রান্না করছি।
বিপাকে হোটেল-রেস্তোঁরা, সিলিন্ডারেই ভরসা
গ্যাসের এই সংকটের ফলে বিপাকে পড়েছেন হোটেল-রেস্তোঁরার ব্যবসায়ীরাও। অনেক হোটেলেই পাইপলাইন গ্যাসের সংযোগ আছে, আবার অনেক হোটেলেই নেই। তবে এখন সবারই ভরসার জায়গা হয়ে উঠেছে সিলিন্ডার গ্যাস।
গ্যাস সংকটের এই সময়ে রাজধানীর বিভিন্ন হোটেলে ঘুরে দেখা যায়, রান্নাবান্নার কাজে অধিকাংশ হোটেল ব্যবহার করছে সিলিন্ডার গ্যাস। কেউ কেউ অবশ্য কাঠের চুলাও ব্যবহার করছেন। তবে স্বল্প সময়ে রান্নার ক্ষেত্রে সিলিন্ডার গ্যাসই প্রাধান্য পাচ্ছে।
সাধারণত হোটেলগুলোতে ৩৫ থেকে ৪৫ কেজি সিলিন্ডারের গ্যাস ব্যবহার করা হয়। এর চেয়ে কমেও ব্যবহার করেন অনেকে।
বিইআরসির ঘোষণা অনুযায়ী, বর্তমানে ৩৫ কেজি এলপিজি সিলিন্ডারের দাম ৩ হাজার ৯৮৫ টাকা ও ৪৫ কেজি সিলিন্ডারের দাম ৫ হাজার ১২৪ টাকা। ২৫ কেজি সিলিন্ডার ২ হাজার ৮৪৭ টাকা ও ৩০ কেজি সিলিন্ডার ৩ হাজার ৪১৬ টাকা।
পাইপলাইনে গ্যাস না থাকায় যেমন ভোগান্তিতে পড়ছে হোটেলগুলো,তেমনি সিলিন্ডারের ব্যবহারও বাড়িয়ে তুলছে খরচ।
মোহাম্মদ টাউন হলে অবস্থিত জান্নাত হোটেলের ম্যানেজার সাইদুল বলেন, আমাদের হোটেলে পাইপলাইনের গ্যাস আছে। কিন্তু সবসময় তাতে গ্যাস থাকে না। তাই সিলিন্ডার গ্যাসও ব্যবহার করতে হয়। এতে আমাদের খরচ বেড়ে যায়।
কৃষি মার্কেটে অবস্থিত বিসমিল্লাহ হোটেলের স্বত্ত্বাধিকারী শহীদ বলেন, আমাদের এখন সিলিন্ডারই ভরসা। কারণ কখন গ্যাস আসবে সে আশায় বসে থাকলে ব্যবসা চালানো সম্ভব না। যথাসময়ে খাবার তৈরি করতে না পারলে তো কাস্টমার আসবে না।
যে কারণে এ গ্যাস সংকট
আবাসিকের পাশাপাশি বাণিজ্যিক খাতেও গ্যাসের এই সংকটের মূল কারণ হিসেবে উঠে এসেছে গ্যাসের সরবরাহ কমে যাওয়া।
পেট্রোবাংলার তথ্য মতে, দেশে দৈনিক গ্যাসের চাহিদা ৩৮০ কোটি ঘনফুট। এর মধ্যে দেশীয় উৎপাদন ও এলএনজি থেকে আসে মোট ৩০০ কোটি ঘনফুট গ্যাস। সম্প্রতি ঘটে যাওয়া ঘূর্ণিঝড় রেমালে কক্সবাজারের মহেশখালীতে অবস্থিত সামিট গ্রুপের মালিকানাধীন এলএনজি টার্মিনালটি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় তা থেকে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়।
অন্যদিকে মঙ্গলবার রাতে এক দুর্ঘটনায় আনোয়ারা-ফৌজদারহাট পাইপলাইনটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এতে করে জাতীয় গ্রিডে এলএনজি সরবরাহ আরও কমে গেছে। সবমিলিয়ে এখন দৈনিক গ্যাস সরবরাহের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২২৫ কোটি ঘনফুটে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সামিটের এলএনজি টার্মিনালটি চলতি মাসের মাঝামাঝি সময়ে কার্যক্রমে ফিরতে পারে। এছাড়া ক্ষতিগ্রস্ত পাইপলাইন মেরামতে ইতোমধ্যে কাজ করছে গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড। তবে তা মেরামতে আরও তিনদিন সময় লাগবে। অর্থাৎ সবমিলিয়ে সপ্তাহের আগে পরিস্থিতি উন্নয়নের তেমন সম্ভাবনা নেই।
এ বিষয়ে পেট্রোবাংলার পরিচালক (অপারেশন এন্ড মাইনস) মো. কামরুজ্জামান খান বলেন, গ্যাস সরবরাহ কিছুটা কমে গেছে। এলএনজি টার্মিনাল থেকে সরবরাহ বন্ধ আছে। এছাড়া পাইপলাইনেও একটা দুর্ঘটনা হয়েছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে আরও কিছুদিন সময় লাগতে পারে। ঢাকা পোস্ট।