জ্বালানি নিরাপত্তা সমুন্নত রাখা এ সরকারের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার হওয়া উচিত

ড. এম শামসুল আলম: ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির প্রকৌশল অনুষদের অধ্যাপক ও ডিন। কনজুমারস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানি উপদেষ্টা। এর আগে গ্রিন ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশের বিজ্ঞান ও প্রকৌশল অনুষদের অধ্যাপক ও ডিন ছিলেন। অধ্যাপনা করেছেন রুয়েট ও চুয়েটের ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগেও। প্রকাশ হয়েছে তার অনেক গবেষণা নিবন্ধ। সম্প্রতি বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের নানা দিক নিয়ে তিনি কথা বলেছেন গণমাধ্যমের সঙ্গে।

জ্বালানি খাত নিয়ে নতুন সরকারের সামনে কী চ্যালেঞ্জ রয়েছে বলে মনে করেন?

২০০৯ সাল থেকে বিগত সরকারের যাত্রা শুরু হয়েছিল। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের উন্নয়ন সরকারের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকারে ছিল। তখন চরম বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সংকট ছিল। গ্যাসের নতুন রিজার্ভ বা আবিষ্কার, উত্তোলন বৃদ্ধি- সবকিছু থেমে গিয়েছিল। বিদ্যুৎ উৎপাদনক্ষমতা বৃদ্ধি পায়নি বিগত বছরে। এ বিষয়গুলো সামনে নিয়েই তখন জ্বালানি নিরাপত্তার বিষয়টি বিশেষভাবে অগ্রাধিকার পায় এবং সেটাই পাওয়ার কথা। তখনকার অবস্থার চেয়ে এখনকার অবস্থা বর্তমান সরকারের জন্য আরো ভয়াবহ ও জটিল। সরকারের জন্য বার্তা হলো বিগত সরকার যে পরিস্থিতিতে দায়িত্ব নিয়েছিল, তখন জ্বালানি খাত যতটা সংকটে ছিল; বিপন্ন, বিপর্যস্ত ও ঘাটতিতে ছিল তার থেকে এখন সংকট আরো ভয়াবহ ও জটিল। এটি একটি দিক। এ খাতে জ্বালানি সরবরাহের বিষয়টি মাথায় রাখতে হবে। সেই সময় বিদ্যুৎ ও জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির কোনো ফ্যাক্টর বা বিষয় ছিল না। এখনকার সরকারের জন্য বিদ্যুৎ ও জ্বালানির বর্তমান মূল্য, মূল্যবৃদ্ধি এবং এ খাতের ঘাটতি—এ দুটোই চরমভাবে আতঙ্কের মধ্যে এসে গেছে।

জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধিতে জনগণের ওপর কী প্রভাব পড়ে?

বিদ্যুৎ ও জ্বালানির সরবরাহ এ অবস্থায় বৃদ্ধি করতে গেলে ঘাটতি বৃদ্ধি পাবে, ভর্তুকি বৃদ্ধি পাবে ও মূল্যবৃদ্ধির চাপ তৈরি হবে। মূল্যবৃদ্ধি করার মতো অবস্থায় এখন দেশ নেই। দফায় দফায় মূল্যবৃদ্ধির প্রভাব পড়েছে মূল্যস্ফীতিতে। জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়ে, পণ্যের দাম বাড়ে ও উৎপাদন ব্যয় বাড়ে। বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দাম যদি বছরে তিনবার বাড়ানো হয় তাহলে ভয়ংকর পরিস্থিতি হতে পারে। বর্তমানে দেশের ৮০ শতাংশ মানুষ সীমিত আয়ের। সেই সীমিত আয়ের মানুষের কোনো বর্ধিত আয় কিংবা ইনক্রিমেন্ট নেই অথচ মুদ্রার অবমূল্যায়ন ঘটছে, পণ্য ও সেবার দাম বাড়ছে। বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দাম দফায় দফায় মাত্রাতিরিক্ত বাড়ছে। সুতরাং মূল্যবৃদ্ধির বিষয়টি আর সামনে আনার উপায় নেই।

জ্বালানির মূল্য নিয়ন্ত্রণে কী কী উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে? মূল্যবৃদ্ধিতে অর্থনীতিতে কী প্রভাব পড়তে পারে?

সরকারকে যদি মূল্যবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ করতে হয় অর্থাৎ পণ্য, সেবা, ডলারের মূল্যবৃদ্ধি এবং টাকার অবমূল্যায়ন নিয়ন্ত্রণ করতে হয় তাহলে আগামী তিন বছরের মধ্যেই এ সমস্যা সমাধানের কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। নানা ধরনের সংস্কারের মধ্য দিয়ে এটি সুরাহা করা প্রয়োজন। এ সময়ের মধ্যে সরকার কোনোভাবেই বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দাম আর বাড়াবে না। এ সময়ে সরকারকে সব উন্নয়ন প্রকল্প বন্ধ করে এ খাতে ভর্তুকি অব্যাহত রাখতে হবে। এ অঙ্গীকার করেই সরকারকে মাঠে নামতে হবে। এটি সরকারের জন্য কঠিন একটি চ্যালেঞ্জ। আর এ চ্যালেঞ্জ যদি সরকার মোকাবেলা করতে না পারে তাহলে খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত হবে না, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সুরক্ষা হবে না, কর্মসংস্থান হবে না, উৎপাদনশীলতা ব্যাহত হবে। রফতানি হুমকিতে পড়বে এবং আরো আমদানিনির্ভর হতে হবে। জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে দিনশেষে সরকারের আয় আরো সীমিত হয়ে পড়বে। ব্যয় নিয়ন্ত্রণ করে কতটা কৃচ্ছ্রতা সাধন করা যাবে সেটা বলা মুশকিল। অর্থাৎ সংকট নিরসনের সুযোগ বা সম্ভাবনা ক্ষীণ হয়ে আসবে। এ দৃষ্টিকোণ থেকে বিদ্যুৎ ও জ্বালানির সরবরাহ ও রক্ষণাবেক্ষণ নিশ্চিত করা, জ্বালানি নিরাপত্তা সমুন্নত রাখা- এটিই এ সরকারের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার হওয়া উচিত। সরকারের কাজ হবে ব্যয় সাশ্রয় করা ও ব্যয় বৃদ্ধির জায়গাগুলো চিহ্নিত করা। চিহ্নিত করে সেই ব্যয় বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণে আনা।

অন্যান্য দেশের তুলনায় আমাদের দেশে বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ ব্যয় ও উৎপাদন ব্যয় অনেক বেশি। ভোক্তা পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম বাড়ছে। এর কারণ কী?

বণিক বার্তার একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কয়লাভিত্তিক চারটি বড় বিদ্যুৎ কেন্দ্রে ৩৫ হাজার কোটি টাকা ব্যয় বেশি হয়েছে। সেখানে অন্যায় ও অযৌক্তিক ব্যয় সংযোজন হয়েছে। অর্থাৎ লুণ্ঠনমূলক ব্যয় বৃদ্ধি করে এ অর্থ মুনাফা হিসেবে বিনিয়োগকারীর পকেটে গেছে। বিনিয়োগকারী নিয়েছে শুধু তা নয়। বিনিয়োগকারী নির্বাচন প্রক্রিয়ার সঙ্গে যারা জড়িত ছিল তারাও ভাগাভাগি করে নিয়েছে। এ চারটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকেই অনেক অর্থ সাশ্রয় করা যেত। অর্থাৎ চুক্তি রিভিউ করা দরকার। এ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মালিক তো বাইরে থেকে আসেনি। সরকারি কোম্পানিই তো। এই চুক্তিগুলো যদি রিভিউ করা হয় তাহলে ৩৫ হাজার কোটি টাকা না হোক অন্তত ৩০ হাজার কোটি টাকা সাশ্রয় করা সম্ভব। এ সাশ্রয় করতে হলে হিসাবপত্র নিয়ে বসতে হবে। এসব চুক্তি বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) আইন ২০১০-এর আওতায় প্রতিযোগিতাবিহীন বিনিয়োগ করা হয়েছে। কারা বিনিয়োগ করেছে, কী ধরনের ইকুইটি বিনিয়োগ এসেছে, কত শতাংশ সুদে ঋণ নেয়া হয়েছে এবং ইকুইটি বিনিয়োগে কত শতাংশ মুনাফা দেয়া হয়েছে, বিনিয়োগকারীকে কত শতাংশ রেট অব রিটার্ন দেয়া হয়েছে সেগুলো দেখতে হবে। বিইআরসি কর্তৃক ২০২২ সালে নির্ধারিত রেট অব রিটার্ন হচ্ছে ছিল প্রায় ৬ শতাংশ। অথচ প্রতিযোগিতাবিহীন বিনিয়োগে দেয়া হয় ১৬-১৮ শতাংশ।

দ্বিতীয়ত প্রশ্ন হচ্ছে, পিডিবির বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রে জনবল ব্যয় যদি জাতীয় বেতন স্কেলে হয়, তাহলে তাদের জন্য কোম্পানি নামক একটি শব্দ বসিয়ে সব সরকারি কোম্পানি দিয়ে বিদ্যুৎ খাত চালানোর পর তাদের বেতন বেশি দিতে হবে কেন? একটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র চালাতে বড়জোর সুপারিনটেনডেন্ট ইঞ্জিনিয়ার লাগে। তার বেশি লাগে না। একটি বিতরণ কোম্পানি চালাতে লাগে একজন নির্বাহী প্রকৌশলী, ক্ষেত্রবিশেষে একজন সুপারিনটেনডেন্ট ইঞ্জিনিয়ার।

সেখানে বেশি বেশি বেতন দিয়ে অনেকগুলো পরিচালক, ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান প্রকৌশলী রাখা হয়। এভাবে যে ব্যয় বৃদ্ধি করা হয়েছে, সেগুলোকে নিয়ন্ত্রণে আনা দরকার। হিসেবে দেখা গেছে, একটি কোম্পানি বছরে ২০-২২টি সভা করে। প্রতি সদস্য প্রতি সভায় সিটিং ভাতা নেন ১২ হাজার টাকা। বিদ্যুৎ বিভাগের একজন সচিব প্রতি মাসে যদি ১ লাখ ২০ হাজার টাকায় আয় করেন, তাহলে তিনি এ রকম সাতটি কোম্পানির চেয়ারম্যান। অর্থাৎ তার বেতনের চেয়ে তিন-চার গুণ টাকা এভাবে পান।

বিদ্যুৎ বিভাগে ষাট-ঊর্ধ্ব কর্মকর্তা আছেন। তাদের প্রত্যেকেই সরকারের মালিকানা সূত্রে কোনো না কোনো কোম্পানির মালিক হয়ে গেছেন। সেখানে বসে তারা যা খুশি সিদ্ধান্ত নেন। সরকার নামক প্রতিষ্ঠানের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। সুতরাং এসব জায়গায় নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে ব্যয় সাশ্রয় করার কৌশল যদি হাতে নেয়া হয় তাহলে তা সম্ভব।

আমরা বলেছি, বিদ্যুৎ, তেল, গ্যাস, কয়লা খাত ও আমদানীকৃত জ্বালানি ব্যয় সাশ্রয়ের কথা। দেখা যাচ্ছে, ২০২২ সালে আইওসির হিসাবে গ্যাসের উৎপাদন ব্যয় ২ টাকা ৭৭ পয়সা। সেখানে এলএনজি টার্মিনালে গ্যাসিফিকেশন চার্জ ২ টাকা ১৬ পয়সা। সেটা কী করে হয়? সেখানে অন্যায়ভাবে লুণ্ঠনমূলক ব্যয় বৃদ্ধি করে তারা গ্যাসিফিকেশন চার্জ নির্ধারণ করে নিয়েছে। রিগ্যাসিফিকেশন চার্জ ১ টাকার নিচে আসার কথা। বিদ্যুৎ সঞ্চালন চার্জ ২০১৫ সালের তুলনায় তিন-চার গুণ বেড়েছে। বিদ্যুতে ছিল সঞ্চালন চার্জ ১৫ পয়সা, সেখানে বেড়ে হয়েছে ৪৩-৪৪ পয়সা। গ্যাস সরবরাহ তো তিন-চার গুণ বাড়েনি। একেবারে আমদানি পর্যায় থেকে শুরু করে জাহাজ ভাড়া, গাড়ি ভাড়া, তেল ও কয়লার পরিবহন ভাড়া, অবকাঠামো উন্নয়ন ব্যয়, বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ ব্যয় ও বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয়- সব মিলিয়ে পুঙ্খানুপুঙ্খ হিসাব করা হলে সেটি বেরিয়ে আসবে। সেই টাকা যদি সমন্বয় করা হয় তাহলে কোনো অবস্থাতেই বিদ্যুতের দাম বাড়ানো লাগবে না।

জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিতে প্রতিবন্ধকতা কোথায়? সেটি কীভাবে দূর করা যায়?

কোম্পানিগুলোকে এত বেশি মুনাফা কেন দিতে হবে? সরকার এখন মুনাফাভোগী প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। ভোক্তাদের চুষে এ মুনাফা আহরণ করছে, মূল্যহার সমন্বয় করে। ফলে সরকার এখন মুনাফাখোর। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি বিক্রি করে সরকার যদি এভাবে মুনাফা করতে চায়, এভাবে বিদ্যুৎ ও জ্বালানিকে বাণিজ্যিক পণ্য বানাতে চায়, মালিক হিসেবে শোষণ করতে চায়, অসাধু ব্যবসা প্রবর্তন করতে চায় এবং প্রতিযোগিতা আইন অনুসারে লুণ্ঠনমূলক ব্যয় বৃদ্ধি করতে চায়, তাহলে এ খাতে জ্বালানি নিরাপত্তা কীভাবে নিশ্চিত হবে? এ খাতে কীভাবে মূল্যবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ হবে?

এ সরকারকে আগের সরকারের মুনাফাখোর চরিত্রকে আমলে নিতে হবে। এ সরকার কোনো ভাবেই আগের সরকারের চরিত্র অনুসরণ করবে না। ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রের যে রূপান্তর হলো সেই রূপান্তর যে চেতনার ভিত্তিতে হয়েছে সেটা হলো অসমতা ও বৈষম্য। সেই অসমতা ও বৈষম্য যদি দূর করতে হয় তাহলে জ্বালানি খাত থেকেই শুরু করতে হবে। জ্বালানি খাতে প্রতিযোগিতা অনুপস্থিত থাকার কারণেই নানা রকমের অসমতা ও বৈষম্য সৃষ্টি হয়েছে। ফলে এ খাতে প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশ সৃষ্টি করা জরুরি। যেসব ক্ষেত্রে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ও বিনিয়োগকারী নিয়োগ করা হয়েছে, সেসব ক্ষেত্রে বৈষম্য রয়েছে। গোষ্ঠীগতভাবে অনুরাগ দেখানো হয়েছে। লুণ্ঠনমূলক মুনাফা লাভের সুযোগ সৃষ্টি করে তাদের লাভবান করা হয়েছে, যে নিয়োগ করেছে সেও লাভবান হয়েছে। এখানে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত বড় রকমের বৈষম্যের শিকার হওয়ার কারণেই বর্তমানে এ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে ব্যয় বৃদ্ধি, মুনাফা, মূল্যবৃদ্ধি- এসব ঘটনা ঘটছে। সুতরাং রাষ্ট্রের যে রূপান্তর সে রূপান্তরের মধ্যে এ রূপান্তরটা অঙ্গীভূত হতে হবে।

জ্বালানিতে আমদানি নির্ভরতার দিকে যাওয়ার কারণ কী?

কতিপয় গোষ্ঠী সব ক্ষেত্রে অলিগার্ক সৃষ্টি করেছে। এ অলিগার্কদের মধ্যে মন্ত্রী বা সচিবকে আমরা দেখতে পাই। তারা সবাই মিলে একটি গোষ্ঠী তৈরি করেছে। পেছনের বিশেষ গোষ্ঠীকে বিশেষ সুবিধা পাইয়ে দেয়ার জন্য তারা কাজ করছে। যিনি সচিব হয়ে আসেন তিনি এসব প্রক্রিয়া করে কতিপয় গোষ্ঠীর অলিগার্ক, এজেন্ট বা কমিশনভোগী হিসেবে কাজ করছেন। সেসব গোষ্ঠী এ খাতে অসাধু ব্যবসার বিস্তার করেছে। সেই ব্যবসা বিস্তার করার কারণেই দেখা যাচ্ছে যে ইন্টারন্যাশনাল অয়েল কোম্পানির (আইওসি) কাছ থেকে পেট্রোবাংলা যদি গ্যাস ২ টাকা ৭৭ পয়সায় কেনে তাহলে দেশীয়ভাবে গ্যাস তুললে সেখানে কত টাকায় কেনা যাবে? আমদানি বাজারে যখন সবচেয়ে উচ্চ দাম থাকে তখন সেই দাম দেখিয়ে প্রতি কিউবিক মিটার এলএনজি/গ্যাস ৮৫ টাকা কিংবা ৬০ টাকায় কিংবা ৪০ টাকায় কিনে আনা হয় তখন জাহাজ ভাড়া ম্যানুপুলেশন করা যাবে। যেসব জায়গায় বিনিয়োগ করেছেন ইকুইটি মানির ওপর পার্সেন্টেজ নেয়া যাবে, ক্ষতি দেখানো যাবে, নানা নামে নানাভাবে সেই দাম বৃদ্ধি করে সেই গ্যাস ভোক্তা পর্যায়ে পৌঁছাতে পারবেন। সরকার সেখানে তিনবার করপোরেট ট্যাক্স পাবে- আমদানি, সঞ্চালন ও বিতরণ পর্যায়ে। সরকারকে পেট্রোবাংলা আমদানি পর্যায়ে ১৫ শতাংশ ভ্যাট দেবে এবং ভোক্তা দেবে ১৫ শতাংশ। আবার পেট্রোবাংলা, জিটিসিএল ও বিতরণ কোম্পানি দেশীয় গ্যাসের সঙ্গে সে গ্যাস সরবরাহ করে যে লাভ করবে, সেই লাভের ওপর আবার সরকার লভ্যাংশ পাবে। এ রকম সোজাসুজি হিসাবের মাধ্যমে সরকার এ খাতে উন্নয়ন করেছে বা এ খাতের কর্মকাণ্ড চালিয়েছে।

গ্যাস ক্ষেত্র আছে কিন্তু গ্যাসের কোনো মজুদ আবিষ্কার করতে পারেনি। গ্যাস তোলার জন্য বিদ্যুৎ বিলের সঙ্গে গ্যাস উন্নয়ন তহবিলে জনগণ টাকা দিচ্ছে। জ্বালানি নিরাপত্তা বিধানের জন্য প্রতি ইউনিটে ১ টাকা করে দিচ্ছে। তাহলে এসব টাকা কোথায় যায়? এসব টাকা নিজস্ব গ্যাস তুলতে ব্যয় করা হলো না কেন? ২০২২ সালের গণশুনানিতে জানা যায়, গ্যাস উন্নয়ন তহবিলের প্রায় ৬৫ শতাংশ টাকা ব্যয় করা হয়নি। আর ৩৫ শতাংশ টাকা দিয়ে বিদেশী কোম্পানির বিল পরিশোধ করা হয়েছে। অথচ এ টাকায় দেশীয় কোম্পানির সক্ষমতা উন্নয়নের কাজে ব্যবহার হওয়ার কথা ছিল। বাপেক্সের যদি কূপভেদে ব্যয় হয় ৮০-৯০ কোটি টাকা, তাহলে বিদেশী কোম্পানিকে দেয়া হয়েছে ২০০-২৫০ কোটি টাকা। অথচ সেই বিদেশী কোম্পানিকে দিয়েই গ্যাস তোলা হয়, দেশীয় কোম্পানিকে দিয়ে নয়।

আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানির মূল্য বাড়লে দেশীয় বাজারে সঙ্গে সঙ্গেই প্রভাব পড়ে। কিন্তু কমলে সেই প্রভাব পড়ে না কেন?

তেলের ক্ষেত্রে এ ঘটনা বেশি ঘটেছে। এলপিজির ক্ষেত্রেও ঘটছে। পিডিবি বিদ্যুৎ আমদানি করে, পেট্রোবাংলা এলএনজি আমদানি করে, বিপিসি তেল আমদানি করে। আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম বাড়লে বা কমলে দেশের বাজারে কত হবে- সেটা সময়ে সময়ে তৃতীয় পক্ষ নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিইআরসিকে দিয়ে করাতে হবে। যাদের কাছ থেকে তেল কিনবে তাদের প্রতিনিধিদের কাছে সেটা উপস্থাপন করে তারা যে ব্যয় দেখিয়েছে সেটা যৌক্তিক কিনা সেটা যাচাই-বাছাই করে নিশ্চিত হতে হবে বিইআরসিকে। তারপর সেই ব্যয় মূল্যহারে সমন্বয় করবে। আর যৌক্তিক না হলে সমন্বয় করবে না। যেমন ঘটেছিল মেঘনাঘাট সামিটের পাওয়ার প্লান্টের ব্যাপারে। চুক্তিতে ছিল ফার্নেস অয়েলে বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে হবে। বেআইনিভাবে সেই চুক্তি পরিবর্তন করে সম্পূরক চুক্তি করে তারা ডিজেল দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করেছিল। ডিজেলের দামে তারা বিদ্যুতের মূল্য নির্ধারণ প্রস্তাব দিয়েছিল, কিন্তু বিইআরসি সে দাম সমন্বয় করেনি। এটি একটি ব্যতিক্রম উদাহরণ। এ উদাহরণ হরহামেশাই প্রতিষ্ঠিত হতে হবে। সেই ধরনের যোগ্যতা, সক্ষমতা ও স্বচ্ছতা প্রাতিষ্ঠানিকভাবে পেট্রোবাংলা, পিডিবি, বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড, বিইআরসিসহ সব প্রতিষ্ঠানের থাকতে হবে। মন্ত্রণালয়ের যে কর্তৃত্ব এখানে প্রতিষ্ঠিত হয়ে আছে সেটা কমাতে হবে। মন্ত্রণালয় আইনকানুন, পলিসি তৈরি করবে। সেসব আইনকানুন পলিসি অনুযায়ী এসব প্রতিষ্ঠান চলছে কিনা মন্ত্রণালয় শুধু তা দেখভাল করবে। এসব প্রক্রিয়ার মধ্যে মন্ত্রণালয়ের কোনো অংশগ্রহণ থাকবে না। সেটা যদি না থাকে তাহলে এ ধরনের ব্যয় বৃদ্ধির কোনো সুযোগ থাকে না। মূল্যবৃদ্ধি, মূল্য পরিবর্তন, মূল্যহার নির্ধারণের ক্ষমতা নিয়ে গণশুনানি বা ভোক্তার অংশগ্রহণ ছাড়াই মন্ত্রণালয় যে দফায় দফায় বেশি বেশি মূল্যহার নির্ধারণ করে দেশের জনগণের ওপর চাপিয়ে দিচ্ছে, এর থেকে বড় অন্যায় সভ্য সমাজের কোথাও হতে পারে না। যে চেতনার ভিত্তিতে ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থান হয়েছে, সেই চেতনাই অর্থাৎ সব ক্ষেত্রে বৈষম্য ও সমতা নিশ্চিত করতে হবে, যা জনস্বার্থ সংরক্ষণ করবে। ভোক্তার জ্বালানির অধিকার নিশ্চিত হবে এবং ভোক্তা জ্বালানির সুবিচার পাবে।

বিপিসি ২০২৩-২৪ অর্থবছরে লোকসানের প্রক্ষেপণ করে। পরে প্রতিষ্ঠানটি মুনাফা করে। এ ভুল প্রক্ষেপণের কারণ কী?

প্রতিষ্ঠানটি যে ব্যয় করছে সেই ব্যয় যৌক্তিক কিনা। সেই ব্যয় ভোক্তার কাছ থেকে আদায় করা যাবে কিনা। সেসব বিষয় যাচাই-বাছাইয়ের জন্য রয়েছে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)। কিন্তু রেগুলেটরি কমিশনের কাজ বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সরবরাহে লাভ, লোকসান, ব্যয়, মুনাফার হিসাব-নিকাশ করা ও যাচাই-বাছাই করা। কিন্তু পেট্রোলিয়াম পণ্যের ক্ষেত্রে সে সুযোগ পায়নি। ফার্নেস অয়েলের দাম বিপিসি নিজেই নির্ধারণ করে। বিপিসি ১০ টাকার পণ্য জনগণের কাছ থেকে ২০ টাকা নিচ্ছে কি না- সেটা তো কেউ জানে না। ভোক্তা হিসেবে সবার জানার অধিকার রয়েছে। কিন্তু সে অধিকার সংরক্ষণ বিইআরসির আইন দ্বারা নিশ্চিত করতে হবে। কিন্তু বিইআরসি দ্বারা তা নিশ্চিত করানো যায়নি। সুতরাং বিপিসি যখন যা বলছে তাই করে নিচ্ছে। জনগণের কাছ থেকে খেয়ালখুশিমতো টাকা আদায় করে নিচ্ছে। ডিজেল, অকটেন, পেট্রল, কেরোসিনের মূল্য নির্ধারণ প্রস্তাব বিপিসি থেকে মন্ত্রণালয়ে যা পাঠানো হয়, মন্ত্রণালয় তাই দিয়ে দেয়া হয়। মূল্য নির্ধারণের বিষয়টি বিইআরসিকে দিয়ে করতে হবে। ২০০৮-০৯ সালের দিকে গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির প্রস্তাব পেট্রোবাংলা নিয়ে এসেছিল। সেখানে সম্ভবত ভোক্তা পর্যায়ে ৬২ শতাংশ মূল্যবৃদ্ধির প্রস্তাব করেছিল। এরপর গণশুনানিতে প্রমাণিত হলো তাদের কোনো ঘাটতি নেই, বরং বছরে ১৪০ কোটি টাকা লাভ হয়। তাহলে এ রকম দৃষ্টান্ত যে তেলের ব্যাপারে নেই, তা কে বলতে পারে? এখন বিপিসিকে জনগণের সামনে উন্মোচিত হতেই হবে।

বর্তমানে আমাদের রিজার্ভ সংকট রয়েছে। তার পরও জ্বালানির আমদানিনির্ভরতা আরো বাড়ানো হচ্ছে। এই আমদানিনির্ভরতা আমাদের জ্বালানি নিরাপত্তাকে কতটুকু সুসংহত করবে?

এর প্রমাণ এরই মধ্যে হয়ে গেছে। আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি অনিশ্চিত। যে বাজারে মূল্যের ওঠানামা অনিশ্চিত, সেই বাজারের ওপর নির্ভরশীল হয়ে আমরা আমাদের জ্বালানি নিরাপত্তাকে সংকটে ফেলেছি। এর ওপর আরো নির্ভরতা বাড়ালে, সেই পরিকল্পনা তো ভয়াবহ। জ্বালানি খাত সেবামূলক হতে হবে। এবং খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিতে সরকার যে কৌশল গ্রহণ করা হয়েছে, জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিতে সেই কৌশলই গ্রহণ করতে হবে। এ খাতকে বাণিজ্যিক খাত হিসেবে বিবেচনা করার সুযোগ নেই। কস্ট প্রাইসে সরকারকে জ্বালানি সেবা দিতে হবে। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত উন্নয়নে সরকার, পেট্রোবাংলা, পিডিবি, বিপিসি, বিদ্যুৎ ও গ্যাস উৎপাদন, সঞ্চালন ও বিতরণ কোম্পানি, তরল জ্বালানি শোধন, পরিবহন ও বিতরণ কোম্পানি এবং কয়লা খনি কোম্পানি লাভে লাভে সয়লাব হয়ে গেছে। আর এদিকে ক্ষতিতে ক্ষতিতে জনগণ একেবারে নিঃশেষ হয়ে গেছে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণে সরকারকে জ্বালানি রূপান্তরে জনগণকে অগ্রাধিকার দিতে হবে।

সৌজন্যে, বণিক বার্তা।