রসিদের কারসাজিতে চলে ডিমের বেচাকেনা

ভোক্তাকণ্ঠ ডেস্ক: সরকার দাম নির্ধারণ করে দেওয়ার পরও চট্টগ্রামে ডিমের দাম কমেনি। উল্টো বেশি দামে কিনতে হচ্ছে ভোক্তাদের। বড় বড় পোলট্রি ফার্ম, আড়তদার থেকে শুরু করে পাইকার পর্যন্ত- সবখানেই চলছে একে অন্যকে দোষারোপের খেলা। কিন্তু কেনাবেচার রসিদ চাইতে গেলেই দেখা যাচ্ছে আসল গোঁজামিল এখানেই। কেউ পাকা রসিদ দেন না। আবার যেটা দেন, সেটা প্রদর্শন করেন না।

গত ১৫ সেপ্টেম্বর ডিমের দাম নির্ধারণ করে দেয় সরকার। মূল্য উৎপাদক পর্যায়ে ১০ টাকা ৫৮ পয়সা, পাইকারি পর্যায়ে ১১ টাকা ১ পয়সা এবং খুচরা পর্যায়ে ১১ টাকা ৮৭ পয়সা নির্ধারিত হয়। অথচ চট্টগ্রামের পাহাড়তলীর পাইকারি বাজারেই প্রতিটি ডিম বিক্রি হচ্ছে ১২ টাকা ২০ পয়সায়।

দাম বাড়ার কারণ জানতে চাইলে চট্টগ্রামে ডিমের পাইকারি ব্যবসায়ীরা বিভিন্ন পোলট্রি ফার্মকে, পোলট্রি ফার্মগুলো আবার ডিলারদের, ডিলাররা মধ্যস্বত্বভোগীদের (মিডিয়া), তারা আবার পাইকারদের- এভাবে চলছে পাল্টাপাল্টি দোষারোপ।

অনুসন্ধানে দেখা গেছে, চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীরা বেশির ভাগ ডিম টাঙ্গাইল ও ময়মনসিংহ থেকে সংগ্রহ করেন। এসব ডিম প্রান্তিক খামারিরাই উৎপাদন করেন। কিন্তু চট্টগ্রামের পাইকাররা সরাসরি খামারির কাছ থেকে কিনতে পারেন না। এখানে কাজ করেন কিছু মধ্যস্বত্বভোগী, যা ডিম ব্যবসায়ীদের কাছে ‘মিডিয়া’ নামেই পরিচিত।

টাঙ্গাইলে মো. এরশাদ, মো. সাইফুল, মো. হাসান, মো. ফারুকসহ অন্তত ১০ থেকে ১৫ জন ‘মিডিয়া’ হিসেবে কাজ করেন। পাবনায় মো. রানা, মো. সালামসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় এ রকম অনেকে ‘মিডিয়া’ হিসেবে কাজ করছেন। তারা খামারিদের কাছ থেকে ডিম কিনে দেশের বিভিন্ন পাইকারের কাছে নিজের ইচ্ছামতো দরে বিক্রি করেন। যেমন- পাইকারের কাছে বিক্রি করার সময় রসিদে লেখা থাকে সরকার নির্ধারিত দর, অর্থাৎ ১১ টাকা ১ পয়সা। কিন্তু চট্টগ্রামের পাইকারদের কাছে বিক্রি করেন মূলত ১১ টাকা ৮০ থেকে ১১ টাকা ৮৫ পয়সায়। চট্টগ্রামের পাইকাররা গাড়ি ভাড়া, মজুরি যোগ করে সে ডিম ১২ টাকার ওপরে বিক্রি করেন।

এদিকে, রসিদে জালিয়াতির একই কৌশল অবলম্বন করছে বিভিন্ন পোলট্রি ফার্ম। বিশেষ করে কাজী ফার্ম, ডায়মন্ড এগ, সিপি, নারিশ, প্যারাগন, আমান, রানা ফিড নামক প্রতিষ্ঠানগুলো বিভিন্ন আড়তদারের কাছে ডিম বিক্রি করে। আবার আড়তদাররা পাইকারদের কাছে ডিম বিক্রি করেন। এখানেও চলে রসিদের কারসাজি।

চট্টগ্রামের ডিমের পাইকারি ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, বিভিন্ন পোলট্রি ফার্ম আড়তদারের সঙ্গে যোগসাজশে রসিদে সরকার নির্ধারিত দর দেখালেও বাস্তবে প্রতিটি ডিম বিক্রি করছে ১১ টাকা ৮০ পয়সার ওপর।

এদিকে প্রান্তিক খামারিদের কাছ থেকে মিডিয়ারা ডিম কিনে বেশি দামে বিক্রি করছেন। দরাদরি করতে চাইলে একবাক্যে বলেন, ‘কিনলে কিনেন, না কিনলে নাই, অন্য ক্রেতা আছে।’ কিন্তু ফার্মের আড়তদার বা মধ্যস্বত্বভোগীরা রসিদ দিচ্ছেন ১১ টাকা ১ পয়সার।

এদিকে অভিযান পরিচালনাকালে ম্যাজিস্ট্রেট বা ভোক্তা অধিকারের কর্মকর্তারা রসিদ চান। কেনা ও বেচায় ১ টাকা ২০ পয়সা ফারাক দেখলে গুনতে হয় বড় অঙ্কের জরিমানা, সেই ভয়ে চট্টগ্রামের পাইকারি ব্যবসায়ীরা রসিদ দোকানে রাখছেন না। অথচ আড়তদার, মধ্যস্বত্বভোগী ও করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো রয়ে যাচ্ছেন ধরাছোঁয়ার বাইরে।

ডিমের দামে কারসাজির প্রমাণ খবরের কাগজের কাছে রয়েছে। পাবনার এক আড়তদার গত ২০ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রামে প্রতিটি ‘এ’ গ্রেডের ডিম ১২ টাকা ২০ পয়সায়, ‘বি’ গ্রেডের ডিম ১১ টাকা ৬০ পয়সায় বিক্রি করেছেন। আর এ কারণে পাইকার হয়ে খুচরায় যেতে যেতে ডিমের দাম চলে যাচ্ছে নাগালের বাইরে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ব্যবসায়ী বলেন, ডিমের বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে গেলে শুধু দাম নির্ধারণ করলেই চলবে না। অবশ্যই বিভিন্ন পোলট্রি ফার্ম, আড়তদার, মধ্যস্বত্বভোগীকে আইনের আওতায় আনতে হবে। তাহলেই ডিমের দাম নিয়ন্ত্রণে আসবে। অন্যথায় সবকিছু কাগজে-কলমে থেকে যাবে। ভোক্তারা কখনো সুফল পাবেন না।

পোলট্রি ফার্মগুলো নিজেদের দায় এড়িয়ে গেলেও আড়তদাররা দোষ চাপিয়ে দিচ্ছেন ঢাকার তেজগাঁও ডিম ব্যবসায়ী সমিতির ওপর। সেখানেই ডিমের দর নির্ধারিত হয় বলে জানান তারা।

চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীরা কাজী ফার্মকে সবচেয়ে বেশি দোষারোপ করছেন। জানতে চাইলে কাজী ফার্মসের জোন ম্যানেজার মহিবুল ইসলাম হিরন বলেন, ‘আমরা আড়তদারের কাছে ডিম বিক্রি করার সময় ইআরপি চালান দিয়ে দিই। সেখানে স্পষ্ট লেখা আছে আমরা আড়তদারের কাছে প্রতিটি ডিম ১১ টাকা ১ পয়সায় বিক্রি করছি। কোনো আড়তদার বলতে পারবেন না বেশি দামে ডিম বিক্রি করছি। এখন আমাদের কাছ থেকে ডিম কিনে আড়তদাররা কত দামে বিক্রি করছেন, সেটা তো আমরা নিয়ন্ত্রণ করতে পারি না। এটা সরকারকেই দেখতে হবে। এই আড়তদাররাই ডিমের দাম বাড়াচ্ছেন বা কমাচ্ছেন।’

এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘অনেকে রসিদে সরকার নির্ধারিত দর দেখিয়ে বাড়তি দরে ডিম বিক্রি করছেন- এমন বিষয় আমরা জানতে পেরেছি। তবে আমরা এমন কাজ করছি না, সেটা স্পষ্ট ভাবেই বলতে পারি। আবার প্রান্তিক খামারিরাও বাড়তি দরে ডিম বিক্রি করেন- এমনটা আমরা শুনি। এসব কারণে প্রভাব পড়ে বাজারে।’

করপোরেট প্রতিষ্ঠান রানা ফিডের জেনারেল ম্যানেজার মোহাম্মদ নজরুল বলেন, ‘আমরা মোট চাহিদার ১৫ থেকে ২০ শতাংশ ডিম উৎপাদন করি। বেশির ভাগ ডিম আসে খামারিদের কাছ থেকে। সেখানেই ডিমের দাম বেশি। সরকার ওখানে ডিমের দাম নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। এ কারণে ডিমের দাম বেশি। আমাদের কোম্পানি কিন্তু সরকার নির্ধারিত দরেই ডিম বিক্রি করছে। তবে ডিলারদের কাছ থেকে শুনেছি, কিছু কোম্পানি রসিদে সরকারি দর দেখালেও ভেতরে বাড়তি দরে ডিম বিক্রি করছে। আর এটা যদি হয়ে থাকে, তবে সরকারের উচিত ব্যবস্থা নেওয়া।’

ডায়মন্ড এগের ঢাকার ডিলার মো. কামাল বলেন, ‘আমরা তো কমিশনে ব্যবসা করি। আমরা ১০০টি ডিমে ৫ টাকা লাভ করি। অর্থাৎ আমরা প্রতি ১০০টি ডিম ১ হাজার ১০০ টাকায় কিনে ১ হাজার ১০৫ টাকায় বিক্রি করি। সমস্যা হলো তেজগাঁও ডিম ব্যবসায়ীদের মধ্যে। তারাই ডিমের বাজার নিয়ন্ত্রণ করে। তাদের সঙ্গে আলোচনা করলে হয়তো ডিমের দাম কমে আসবে।’

প্যারাগন এগের জামালপুরের মধুপুর এলাকার ডিলার মো. কুদ্দুছ বলেন, ‘আমি ত্রিশাল থেকে ডিম কিনি। সেখানে ওই কোম্পানির ডিলারের কাছ থেকে সংগ্রহ করি। আবার কিছু ডিম খামারিদের কাছ থেকে সংগ্রহ করি। কোম্পানিগুলো সরকার নির্ধারিত দর মানলেও খামারিরাই তা অনুসরণ করে না। আমি গত ২৫ সেপ্টেম্বর ত্রিশালের ‘মিডিয়া’ রুহুল আমিনের কাছ থেকে প্রতি ১০০ ডিম ১ হাজার ২০০ টাকার ওপরে কিনে এনেছি। এই জায়গায় নজর দিতে হবে সবচেয়ে বেশি।’

টাঙ্গাইলের প্রান্তিক খামারিদের কাছ থেকে ডিম কিনে মিডিয়া হিসেবে চট্টগ্রামের পাইকারের কাছে বিক্রি করেন মোহাম্মদ এরশাদ। তিনি বলেন, ‘আমরা মিডিয়া হিসেবে প্রান্তিক খামারির কাছ থেকে ডিম কিনে আনি। ব্যবসা করার জন্য আমার ডিম প্রয়োজন। আমার মতো অনেকে (মিডিয়া) একই খামারির কাছে গেলে তখন দাম বেড়ে যায়। আবার অধিকাংশ প্রান্তিক খামারির ট্রেড লাইসেন্স নেই। তাই তারা ডিম বিক্রির সময় কোনো রসিদ দিতে পারেন না। এখন কেউ অভিযানে এলে আমি ক্রয় রসিদ দেখাতে পারি না। এভাবে আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি।’

ঢাকার তেজগাঁও ডিম ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি আমানত উল্লাহ বলেন, ‘কাজী ফার্ম সরকার নির্ধারিত দরে ডিম বিক্রি করে। আবার প্যারাগন, সিপি প্রতি ১০০টি ডিম বিক্রি করছে ১ হাজার ১৫০ টাকায়। আমরা প্রান্তিক খামারিদের কাছ থেকে বেশি দামে ডিম কিনে আনি। আবার বিভিন্ন কোম্পানির ডিলাররাও প্রান্তিক খামারিদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাড়তি দরে বিক্রি করছেন। সমস্যা সব দিকেই। সরকারের উচিত খামারি থেকে শুরু করে সব স্তরের ব্যবসায়ীর সঙ্গে আলোচনা করে ডিমের একটি নির্দিষ্ট দাম নির্ধারণ করা। তখন এর সুফল মানুষ পাবে।’

জাতীয় ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের চট্টগ্রাম বিভাগীয় কার্যালয়ের উপপরিচালক ফয়েজ উল্যাহ বলেন, ‘আমরা সম্প্রতি পাহাড়তলী বাজারে অভিযান চালিয়ে পাইকারদের কাছে কোনো ক্রয় রসিদ পাইনি। তারা টাঙ্গাইলের আড়তদারদের দোষারোপ করছিল। গত ২৫ সেপ্টেম্বর আমাদের টাঙ্গাইলের কর্মকর্তা অভিযান পরিচালনা করেন এবং সেখানেও অসংগতি পান। আড়তদাররা বলেছেন প্রান্তিক খামারিরা রসিদ দিতে চায় না। এখন আমরা সেখানেও সবকিছু খতিয়ে দেখব। সেভাবেই নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।’

কনজুমারস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সভাপতি এস এম নাজের হোসাইন বলেন, ‘চট্টগ্রামের পাইকারি ব্যবসায়ীদের আসল অপরাধীদের চিহ্নিত করে দিতে হবে। তারা অভিযানের ভয়ে রসিদ লুকিয়ে রাখলে তো সমস্যার সমাধান হবে না। পাশাপাশি যত পোলট্রি ফার্ম, আড়তদার, মধ্যস্বত্বভোগী আছে, তাদের তালিকা তৈরি করতে হবে। তারা কত দিয়ে ডিম বেচাকেনা করছে, সেটা যাচাই করতে হবে।’

চট্টগ্রাম জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. মো. নজরুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা তো বাজার তদারকি করতে পারি না। তবে আমাদের কাছে খবর আছে, খামারিরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। কারণ এখানে মধ্যস্বত্বভোগী থাকায় খামারিরা ডিমের প্রকৃত দাম পাচ্ছেন না। কাজেই খামারি কত দরে বিক্রি করছেন, মধ্যস্বত্বভোগী ও পাইকার কত দিয়ে কেনাবেচা করছেন- এখানে নজরদারি বাড়ানো প্রয়োজন।’ খবরের কাগজ।